ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কোথায় রেখে যাচ্ছি?
মোহাম্মদ গোলাম হোসেন ফারহান
আমার একটা মেয়ে আছে আট মাস বয়স। ওকে নিয়ে আমার অনেক চিন্তা হয়। কোন শহরে আমি ওকে রেখে যাবো। এই শহরতো একটি মৃত্যুর কূপ। রাস্তা ঘাটের কথা না হয় বাদই দিলাম। যে বাড়িতে আমরা থাকি সে বাড়িটাও কি নিরাপদ? আমার মত একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার থাকতেও আমার বাবা ফ্ল্যাট কেনার সময় দেখতে চায়নি তাদের ডিটেইল প্ল্যান। আমারও কিছুই করার ছিল না। সাধ আর সাধ্যের কাছে "রিস্ক" ব্যাপারটা আমাদের কাছে আজ তুচ্ছ।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মানেই টাকা মেরে খাওয়ার ধান্দা। এই দেশে এক একটা সাধারণ ভবন তুলতে ভবন মালিকেরা যেখানে কোটি টাকা খরচ করতে প্রস্তুত সেখানে একজন ভালো কনসালটেন্ট দ্বারা ভবনের ডিজাইন করানো তাদের কাছে বিলাসিতা। সয়েল টেস্ট এর কথা বললে চোখ কপালে উঠে যায়। ঢাকা শহরে সাড়ে তিনলক্ষর অধিক ভবন আছে যার মধ্যে তিন থেকে ৬ তলা ভবনের সংখ্যাই বেশি। এবং এই ভবন গুলোর বেশিরভাগই করা হয়েছে কোন রকম ডিটেইল প্ল্যান ছাড়া।
২ থেকে ৫ কাঠা প্লটের উপর ৫-৬ তলা বাড়ি করা এখন মিস্ত্রীদের কাছে ডাল-ভাত। সেখানে বাড়ির মালিক একজন কনসালটেন্ট কাছে ডিজাইন করাইতে চাইলে মিস্ত্রী ভাইয়েরা ক্ষেপে যায়। তাদের নাকি প্র্যাকটিকাল অভিজ্ঞতা বেশি আর ইঞ্জিনিয়াররা খালি বই পড়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। ব্যাপারটা আমার কাছে যেমন অবমাননাকর, তেমনি হাস্যকর। সয়েল টেস্ট তাদের কাছে তুচ্ছ ব্যাপার। মিস্ত্রি ভাইয়েরা নাকি মাটি দেখেই বলে দিতে পারে এইটা ভিটা মাটি নাকি ভরাট মাটি। ভিটা মাটি হইলে শ্যালো ফাউন্ডেশন দিয়ে ৫-৬ তলা বাড়ি তোলা তাদের কাছে কোন ব্যাপারই না। অথচ, ঢাকা সিটির মাত্র ৩৫ ভাগ মাটি ভালো মাটি বা শক্ত মাটি। এক্সটেন্ডেন্ট ঢাকা বলতে আমরা যা বুঝি তার প্রায় সবটাই বালু দিয়ে ভরাট করা। তাতে কি বিল্ডিং তো দাঁড়াইয়া থাকে। আমিও বলি, বিল্ডিং তো দাঁড়াইয়া আছে কিন্তু সেটা কতক্ষণ? কোন রকম মাটির ধারণ ক্ষমতা বিবেচনায় না আনা, বি-এন-বি-সির কোড না মানা, ওভার ডিজাইনের অতিরিক্ত ওজন বহন করা এসব ভবন গুলো কতদিন পারবে তাদের বাসিন্দাদের আগলে রাখতে?
একটা বড় ভূমিকম্প আঘাত হানলে এই শহর কি পারবে তার বুকে এই দুর্বল স্থাপনা গুলো ধরে রাখতে? ‘‘২০০৯ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে ভবনগুলো নিয়ে জরিপ করা হয়৷ তাতে দেখা যায় যে, আগামীতে যদি ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে তিন লাখ ২৬ হাজার ভবনের মধ্যে ৭২ হাজার ভবন তাৎক্ষণিকভাবে ধসে পড়ব৷ একেবারে অক্ষত থাকবে খুব কম সংখ্যক ভবন৷ এছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে৷ ঘটবে মানবিক বিপর্যয়ও৷'' ২০১০ সালে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৮০ হাজার এই সংখ্যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে অনেক বেশি।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিবের মতে, ঢাকা শহরের ৮০% ভবনের রাজউকের ঠিকভাবে অনুমোদন নেই, আর যেগুলোর আছে তার ৬০ ভাগই সেই পরিকল্পনাকে মডিফাইড বা তার সাথে তাদের ইচ্ছা মতো প্ল্যান করে ভবন তুলেছে যা একবারও আমরা ভাবিনা। ভূমিকম্পের কথা আমাদের পাত্তার মধ্যেই থাকেনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এবং ইউএনডিপি-র দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এ কে এম মাকসুদ কামাল এর মতে "বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই ১২টি ভূমিকম্প ফাটল আছে৷ এ সব জায়গায় ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে৷ ঢাকার অদূরে মধুপুর ফাটল খুব বিপজ্জনক৷ প্রতি ১০০ বছর পর পর ফাটল থেকে বড় আকারের ভূমিকম্প হয়৷ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প হয়েছে৷ তাই আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে আছি আমরা৷'' আমাদের ভবন মালিকেরা আর মিস্ত্রী ভাইয়েরা কি প্রস্তুত আছেন এই ধাক্কা সামলাতে? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারবে না।
আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ বিএসসি কমপ্লিট করার পর থেকেই কাজ করছি বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস ইন্ডাস্ট্রিতে অর্থাৎ রড-সিমেন্ট জগতে। প্রফেশনাল দায়িত্ব পালনে মাঝে মাঝেই আমাকে যেতে হয় ক্লাইন্টের কাস্টমার কমপ্লেইন হ্যান্ডেল করতে কনস্ট্রাকশন সাইট গুলোতে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে যদি আমি সুপারভিশনের কথা বলি তা এক কথায় “ভয়াবহ”। কনসালটেন্ট ছাড়া যেসব বাড়ি বানানো হয় সেগুলোকে আল্লাহর নামে ছেড়ে দিচ্ছে সবাই, সেখানে যা খুশি তাই হচ্ছে। সুপারভিশনে কেউ কেউ হয়তো একজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেন যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় অনভিজ্ঞ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, যারা নিজেরাই ওই হেড মিস্ত্রির কথায় চলে। এত কিছুর পরেও যেসব মালিক পক্ষ একজন অভিজ্ঞ বিএসসি অথবা এমএসসি ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে সুপারভিশনের কাজ করাচ্ছেন তাদের পক্ষেও এই শ্রমিক শ্রেণীকে কমান্ড দেওয়া কতটুকু যে কষ্টের তা ভাষায় বলে বুঝানো যাবেনা। কথাই কেউ শুনতে চায় না। রড-সিমেন্টের সিলেকশন থেকে শুরু করে,কংক্রিট মিক্স ডিজাইন ম্যাইনটেইন,সাটারিংয়ের ভুল রোধ করা,নির্ভুল রডের কাজ,ক্লিয়ার কভার,লেপিং,কর্নার রেইনফোর্সমেন্ট,কলাম হুক, চেয়ার, ব্লক কোন কিছু নিয়েই কারও কোন মাথা ব্যাথা নেই। গাঁথুনি-প্লাস্টারিং-সল্ট রেজিস্টেন্স,করোশন এগুলাতো বাদই।
সাধারণ মানুষের একটা সাধারণ ধারণা হলো ইঞ্জিনিয়ারের তত্বাবধায়নে বাড়ি বানালে খরচ অনেক বেশি।তারা মনে করে ৪ তলা ৫ তলা বাড়ি বানানোর জন্য একজন ইঞ্জিনিয়ারের হেল্প নেওয়া অনেকটাই অহামিকা এবং অপ্রয়োজনীয়। প্ল্যান করে অনুমোদন নেওয়া তাদের কাছে একটা বাড়তি ঝামেলা মনে হয়। যা আসলে শুধু ভুলই নয়, অনেক বড় ভুল। ধরেন, একজন ব্যক্তি ৩ কাঠা জায়গার উপরে একটি ৬ তলা বাড়ি বানাতে চায়। তার এই পুরো বাড়ি কমপ্লিট করতে ১ থেকে ১.৫ কোটি টাকা কমপক্ষে খরচ হবে। সেখানে সয়েল টেস্ট করতে মাত্র খরচ হবে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
একজন কনসালটেন্ট বা তার ফার্ম সেই সয়েল টেস্ট রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে বাড়ির আর্কিটেকচারাল, আর-সি-সি, ইলেক্ট্রিকাল, প্লাম্বারিং এর ডিজাইন করতে সাধারণত নেয় প্রতি স্কয়ারে ন্যূনতম ২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। সে হিসাবে ৪৩,০০০ টাকা থেকে ১০৫,০০০ টাকা। আর ধরেন সুপারভিশনের জন্য তাকে ১৫ বার নিয়ে আসলেন সেখানে আরও ১৫ থেকে ৩০,০০০ টাকা খরচ হল।
অর্থাৎ দেখা যায় সর্বমোট মাত্র ৬৫,০০০ টাকা থেকে ১,৫০,০০০ টাকা আপনাকে খরচ করতে হবে পুরো ভবনের নিরাপত্তা ও দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য যা কিনা একই সাথে নির্মাণ কাজের জন্য সাশ্রয়ী। বাস্তবিকভাবে যার খরচ আরও কম, অর্থাৎ ৫০,০০০ থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যেই ইঞ্জিনিয়ারদের পার্ট চুকানো সম্ভব যা কিনা বর্তমান বাজারের মাত্র ১-১.৫ টন রডের সমমূল্যর সমান, যেখানে প্রায়ই দেখা যায় একজন মিস্ত্রি এই কাজটি করতে কমপক্ষে ৫-৭ টন রড বেশিই লাগায়।
আমার সবচেয়ে বেশি আফসোস লাগে আমার আর্কিটেক্ট বন্ধুদের জন্য। এই দেশে তাদের মত অবহেলিত বোধয় আর কেউ নেই। কিছু শৌখিন আর হাই-রাইজড স্ট্রাকচারাল ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের কনসালটেন্সি কেউই নেয় না। অথচ, কতই না মননশীল আর মেধাবী ছিল তারা। আমরা যারা নিজেদেরকে অত্যন্ত চালাক মনে করি, আসলে আমরা কতই না বোকা !
চালাক যদি কেউ থেকে থাকে তারা হল বাংলাদেশের বেশিরভাগ ডেভেলপারস কোম্পানি গুলো আর নিম্নমানের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান গুলো। তারা যা ইচ্ছা তাই করে আপনার আমার জমি ডেভেলপ করে দিচ্ছে, বানিয়ে দিচ্ছে আমাদের স্বপ্নের বাড়ি। যেখানে নাই কোন ডিজাইনের ঠিক ঠিকানা, নাই কোন ভালো ম্যাটেরিয়ালসের নিশ্চয়তা। তারা যে কি কি করে আমাদের সাথে তা ভাবতেও ঘৃণা হয়। আমরাও নিরুপায় ফ্ল্যাট কেনার সময় এতো কিছু দেখার উপায় বা সময় আমাদের হাতে নেই, আমরা শুধু টাকার ব্যাপারটা দেখি। ঠিকাদারদের দিয়ে দেই বাড়ি বানাইতে, তারা যা বুঝাইয়া দেয় তাই বুঝি সেটা চেক করে দেখার চিন্তাও আমাদের নেই।
বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশ এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের সদস্য সংখ্যা ১০২০০ এর কিছু বেশি এবং আর্কিটেকচার ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশ এর সদস্য সংখ্যা হচ্ছে ৪৫০০ এর মত। কনসালটেন্সির জন্য সাধারণত উনাদের চেয়ে ভালো পাওয়ার কথা না। কারণ একমাত্র এই দুইটা প্রতিষ্ঠানই মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে কমপক্ষে বিএসসি বা আন্ডারগ্রাজুয়েট কমপ্লিট করা ছাত্র ছাত্রীদের মেম্বার করেন। এবং পরবর্তীতে তারাই আজ বাংলাদেশের কনস্ট্রাকশন সেক্টরকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। একবার ভেবে দেখুন, আপনার বাড়ি বানানোর শুরুতেই একজন জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মাটি পরীক্ষা করে মজবুত একটা ফাউন্ডেশনের সাজেশন দিয়ে দিলো, তারপর একজন আর্কিটেকচার একটা সুন্দর-মনোমুগ্ধকর বাড়ির ডিজাইন করে দিলো আর তার উপর ভিত্তি করে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার পুরো বাড়ির ডিটেইল প্ল্যানিং করলো এবং একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের সুপারভিশনে তা বাস্তবে রূপ নিলো।আর এই পুরো প্রসেসের খরচ আপনার নির্মাণ কাজের মাত্র শতকরা ১-১.৫ ভাগ!
এই বাড়িটা বেশি দৃঢ় এবং স্থায়ী হবে নাকি হেডমিস্ত্রীর আন্দাজ আর অভিজ্ঞতার বাড়িটি দৃঢ় এবং স্থায়ী হবে? একটা বাড়ি, একটা নির্মাণ, এক একটি স্বপ্ন, যেই স্বপ্নের সাথে মিশে আছে অনেক গুলো মানুষের জীবন। আমরা সেই স্বপ্ন নিয়ে খেলছি হেলায় ফেলায়। কাদের হাতে তুলে দিচ্ছি আমাদের ভবিষ্যৎ? কোথায় রেখে যাচ্ছি আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ? দায় কি শুধু সরকারের আর সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোর ? আমাদের দোষ গুলো ঢাকবো কি দিয়ে?
লেখক : প্রকৌশলী। বি,এস,সি ইন সিভিল (আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়),এম-আই-ই-বি-৪০৪১২, এম,বি,এ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), সিনিয়র বিজনেস ডেভলপমেন্ট অফিসার,কে-এস-আর-এম, সাবেক এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার,বিজনেস এক্সপানশন এন্ড টেকনিক্যাল সাপোর্ট,ই-সি-এই-এল, সাবেক বিজনেস ডেভলপমেন্ট এন্ড টেকনিক্যাল সাপোর্ট টিম মেম্বার,বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস ডিভিশন,আনোয়ার গ্রূপ।
এইচআর/এমএস