পরাজিত বিএনপির রাজনৈতিক অর্জন

মোস্তফা হোসেইন
মোস্তফা হোসেইন মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশিত: ০৯:২৮ এএম, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

সিটি নির্বাচনে বিএনপির দুই মেয়র প্রার্থীর পরাজয় হলেও রাজনৈতিক অর্জন কম নয় তাদের। দীর্ঘ সময় ধরে ধীরগতিসম্পন্ন রাজনৈতিক দলটির মূল্যায়ন হচ্ছে- ব্যর্থ হিসেবে। কিন্তু এবার সিটি নির্বাচনে তাদের কিছু অর্জন এবং দিকনির্দেশনা তৈরি হয়েছে। যা থেকে দলটি এগিয়ে যাওয়ার পথ পেতে পারে। দিকনির্দেশনাগুলো রাজনৈতিক বিশ্লেষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেও গণ্য হতে পারে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দক্ষতা প্রশ্নাতীত নয়। সিনিয়র নেতাদের গুটিয়ে থাকা কিংবা নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখার পেছনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অদুরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকেই মূলত দায়ি করা হয়। সেক্ষেত্রে এই নির্বাচন তৃতীয় একটি পথ খুলে দিয়েছে। আরো সোজা করে যদি বলি, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন যে দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন তা নতুন প্রজন্মের বিএনপি কর্মীদের কাছে বড় প্রাপ্তি হিসেবে গণ্য।

বলতে গেলে, সিটি নির্বাচনে ইশরাক হোসেন একাই লড়াই করেছেন। বিএনপির সিনিয়র নেতারা তাকে সমর্থন দিলেও নির্বাচনী মাঠে তাদের পেয়েছেন কম। তার প্রচারণা মাঠে মধ্যবয়সী তরুণ নেতাদের তিনি পেয়েছেন মোটামুটি। লক্ষণীয় হচ্ছে- উচ্চশিক্ষিত ইশরাক হোসেন বিএনপির ব্যঙ্গ করা মাধ্যম প্রযুক্তি মাধ্যমকে ব্যবহার করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। ডিজিটাল প্রচারণা তার প্রমাণ বহন করে। তাবিথ আউয়াল এক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন।

ইশরাক হোসেন রাজনৈতিক চাচাদের যথাযথ সন্মান দিয়েই নতুনদের সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে ভুল করেননি। আমি মনে করি ইশরাক হোসেনের বড় অর্জন এখানে। তার সহযোগী এই নেতাকর্মীদের তিনি যদি কাজে লাগাতে পারেন আর সিনিয়রদের যদি পরামর্শক হিসেবে কাছে পান তাহলে বিএনপি আজকে যে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে তা থেকে আগামীতে উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হবে।

প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে টানার সুযোগ গ্রহণ করেছেন ইশরাক হোসেন। আবারো বলতে হবে- এই নির্বাচনে বিএনপির বড় অর্জন হচ্ছে, নতুন কর্মী সৃষ্টি।

অন্যদিকে তাদের দলের ভিতরে অনৈক্য ছিলো তাদের এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে বড় প্রতিবন্ধকতা। ইশরাক হোসেন তার পূর্বপ্রজন্মের দেয়ালটা ভাঙতে সক্ষম হয়েছেন এটাও বলা যায়। একসময় মহানগরের দুই জাদরেল নেতা মির্জা আব্বাস ও মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো। বলতে দ্বিধা নেই মহানগরের এই বিভক্তি বিএনপিকে কেন্দ্রীয়ভাবেও দুর্বল করতে সহায়তা করেছিলো। সেই বড় বাধাটিও কিন্তু এই নির্বাচনের সূত্রে ডিঙ্গিয়ে যেতে পেরেছে বিএনপি। তার বাবার সহকর্মীদের বাবার মতো সন্মান জানানোর কাজটিও তিনি করেছেন বলে শোনা যায়।

ইশরাক হোসেনের নির্বাচনী পরিচালক ড. মোশাররফ হোসেন নিজেও কিছুদিন আগেও বিএনপির নেতাদের দুর্বলতা এবং অদক্ষতা সম্পর্কে প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেছিলেন। সেই মোশাররফ হোসেনই নতুন নেতৃত্বকে পরিচালনা করে নতুন কর্মীবাহিনী গড়ে তুলেছেন স্বাচ্ছন্দে না হলেও মোটামুটি সফলভাবে। তিনি ইশরাক হোসেনকে সামনে নিয়ে এই নতুনদের সমাগম ঘটিয়ে দলের স্থবিরতা কাটিয়ে তোলতে সক্ষম হয়েছেন এটা স্বীকার্য। এদিক থেকে বিবেচনা করলে মোশাররফ হোসেনের পূর্বভাবনারও বাস্তবায়নের পথ খোলাসা হয়েছে।

ইশরাক হোসেনের ব্যক্তিগত ইমেজ তৈরি হয়েছে এটাও মনে করা যায়। এখন প্রশ্ন হলো বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এই নতুনদের কিভাবে ব্যবহার করবেন। তারা কি নতুনদের এগিয়ে আসার সুযোগ করে দেবেন?

উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন বিএনপির আরেক সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এই নেতাও জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে নেতৃত্বে পরিবর্তনের কথা বলেছেন।

নতুন প্রজন্মের রাজনীতিবিদ তাবিথ আওয়াল মাধ্যমে নতুনদের কাছে টানার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও তিনি সফল হয়েছেন। যদিও দক্ষিণের তুলনায় উত্তরের সাফল্য কিছুটা কম বলেই মনে হয়। কিন্তু তাবিথ আওয়াল পোড় খাওয়া কর্মীদের একিভুত করে কর্মচঞ্চল করতে সক্ষম হয়েছেন এটাতো মানতে হবে। সুতরাং উত্তরের সাফল্য তুলনামূলক কম হলেও বিএনপির জন্য ইতিবাচক সুযোগ এখানেও তৈরি হয়েছে।

মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকার দূরত্বের প্রভাব পড়েছিলো বিএনপিতে। যে কারণে ২০১৪-১৫ সালে বিএনপি’র আন্দোলনে ঢাকায় সুফল আনতে পারেনি। এবার মির্জা আব্বাসই শুধু নয় তার স্ত্রীসহ ঘনিষ্ঠজন ইশরাক হোসেনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বলা যায় এর প্রভাব সাধারণ কর্মীদের মধ্যেও দেখা গিয়েছে। নির্বাচনী মাঠে তাদের কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তারই প্রমাণ দেয়।

অন্যদিকে দুই বছর পর্যন্ত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য বিএনপি দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু আন্দোলন বলতে যা বোঝায় তা সংগঠিত করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের মিছিলে তারা খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনের বিষয়টিকে জুড়ে দিয়ে কর্মীদের এই দাবিতে উজ্জীবিত করার সুযোগও পেয়েছে।

প্রয়োজনীয় পুলিং অ্যাজেন্ট ছিল না বিএনপির। একটা বড় দলের জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনক। বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয় ওইসব কেন্দ্র থেকে তাদের অ্যাজেন্টকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা এই দাবির পক্ষে জোরালো প্রমান দিতে পারেনি। এটা হয়েছে তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে। যার দায় নতুন দুই মেয়রপ্রার্থীর ওপর বর্তায় না। কিন্তু বিএনপি তাদের এই দুর্বল দিকটি স্পষ্টভাবে দেখেছে।

এটাও সত্য যে আওয়ামী লীগসহ দেশের ছোট বড় রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে গেলো বছর সংগঠনকে শক্তিশালী করার কাজে আন্তরিক ছিলো বিএনপি তেমনটি ছিলো না। সেক্ষেত্রে হামলা মামলার যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয় তাকে মেনে নিলেও আন্তরিকতায় যে ঘাটতি ছিলো তা হয়তো তারা মেনে নেবেন। ওই সময় নয়াপল্টনকেন্দ্রিক আন্দোলনকে বাইরে নিতে তারা স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছেন। এই মুহূর্তে তাবিথ আউয়াল এবং ইশরাক হোসেন যে ইমেজ তৈরি করেছেন তাকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি মহানগরে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে পারে। এবং সেই সুযোগও তাদের তৈরি হয়েছে। সেক্ষেত্রে হামলা মামলাকে সঙ্গে নিয়েই সাংগঠনিক ভিত্তিকে মজবুত করতে পারে তারা।

নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি হরতাল আহ্বান করেছিলো। অনেকেই বলছেন- বিএনপির রাজনীতি ইশরাক-তাবিথের হাত থেকে কেন্দ্রে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো ব্যর্থতাই ভর করেছে দলীয় কর্মসূচিতে। তার মানে আন্দোলনের আরেকটি সুযোগও হাতছাড়া করলো বিএনপি। এই কর্মসূচিতে বিএনপির এমপিগণ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের যদি সম্মিলিতভাবে পাওয়া যেতো তাহলে হয়তো ভিন্ন চিত্র হতে পারতো। ইশরাক হোসেন বিএনপি অফিসকে কিছুটা উত্তেজিত করতে পারলেও তাবিথ আউয়াল নিজেই এসেছেন দুপুরে। নয়া পল্টনে বিএনপির বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশ তাদের দশ মিনিট সময় দিলেও ৩ মিনিটেই তারা নিজ দফতরে ফিরে গিয়ে হরতাল কর্মসূচির শেষ পেরেকটি নিজেরাই মেরে দিলেন।

নির্বাচনে বিএনপি কর্মীদের যে উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে তাকে কাজে লাগাতে হলে, তাদের নতুন করে ভাবতে হবে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বক্তব্য এবং বিএনপিপক্ষীয় বুদ্ধিজীবী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মন্তব্য অনুযায়ী বিএনপিতে নেতৃত্বকে ঢেলে সাজানো সম্ভব হলেই তাদের এগিয়ে যাওয়া দ্রুততর হতে পারে। নতুনকে দিয়েই নতুন দিনে চলা সম্ভব। পুরনো ধ্যানধারণা সেক্ষেত্রে সহযোগী হতে পারে- মূল নিয়ামক নয়। আর তেমন হলেই হয়তো বিএনপি আবারো ওঠে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।

লেখক- সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।