করোনায় বস্তিবাসীদের জীবন ও জীবিকা

ডা. পলাশ বসু
ডা. পলাশ বসু ডা. পলাশ বসু , চিকিৎসক ও শিক্ষক
প্রকাশিত: ০৯:২০ এএম, ১৯ আগস্ট ২০২০

বস্তিবাসী বলতেই শহরে বসবাসরত নিম্নবিত্ত মানুষ, দরিদ্র বা হতদরিদ্রদের কথা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। জীবন যাদের মোটামুটিভাবে গতর খাঁটুনির উপর দিয়ে চলে। ঘিঞ্জি এলাকায় গাদাগাদি করে বসবাস করেন এ মানুষগুলো। শহরে থাকলেও আধুনিক সকল সুযোগসুবিধা থেকে তারা বঞ্চিতই থেকে যান। চিকিৎসা, শিক্ষা থেকে শুরু করে মৌলিক মানবাধিকার সবকিছুতেই তাদের পিছিয়ে পড়ার গল্পটা আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে। এর সাথে আছে নানাধরনের সমাজ বিনষ্টকারী উপাদানের হাতছানি- মাদক, অস্ত্র, নারীঘটিত বিষয় ইত্যাদি।

প্রশ্ন হচ্ছে, করোনার এই মহামারির সময়ে আমাদের বস্তিবাসী মানুষগুলো কেমন আছেন? যেখানে করোনা থেকে রেহাই পেতে "সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং" এর কথা বলা হচ্ছে, বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি পালনের কথা সেসব কি বস্তিবাসীদের পক্ষে মেনে চলা সম্ভব? তাদের অবস্থা কেমন, তারা কিভাবেই বা আছেন এ মহামারির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে বা কতটুকু সচেতনতার কাজই বা ধরে ধরে এসব বস্তিতে চলেছে- সে প্রশ্ন রেখেই চলুন আমরা বিশ্বের অন্য দেশের বস্তিবাসীরাই বা কেমন আছে করোনার এ নিদানকালে তাও একটু জেনে আসি।

এটা ঠিক যে দিন যত যাচ্ছে পৃথিবীব্যাপী মানুষের সংখ্যাও তত বাড়ছে। বাড়ছে বস্তিবাসীদের সংখ্যাও। ধারণা করা হয়ে থাকে সারাবিশ্বে বর্তমানে ১০০ কোটি মানুষ বস্তিতে বাস করেন। বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালে এই সংখ্যা ২০০ কোটিতে ঠেকবে। এই যে ১০০ কোটি বস্তিবাসী মানুষ তার মধ্যে মাত্র ৫ টি বস্তিতেই বসবাস করছেন প্রায় ৬০ লাখ মানুষ।

এগুলো হচ্ছে মুম্বাইয়ের ধারাবি, পাকিস্তানের ওরাঙ্গি টাউন, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের খায়েলিৎসা, মেক্সিকোর নেজা ও কেনিয়ার কিবেরা। করোনা তো এসব দেশেও আঘাত হেনেছে। বলা হচ্ছে কেনিয়ার কিবেরা বস্তি ছাড়া অন্য চারটি বস্তিতেই বেশ কঠিন আঘাত হেনেছে করোনা। অন্যদিকে কিবেরা বস্তি মহামারি প্রতিরোধের রোলমডেল হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেটা কিভাবে সম্ভবপর হলো- আসুন সেটাও একটু জেনে আসি।

কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এলাকা কিবেরা। এটি হচ্ছে কেনিয়ার বৃহত্তম বস্তি। একই সাথে পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম বস্তিও এটি। ১৩ মার্চ কেনিয়ার প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। তারপরই সকল জনসাধারণের মতোই ভীত হয়ে পড়ে কিবেরার বস্তি এলাকার মানুষেরাও। ধীরে ধীরে সেখানে জনসচেতনতা তৈরি, দৃশ্যমান জায়গায় সচেতনতামূলক পোস্টার লাগানো, মাস্ক, হাত ধোঁয়ার জন্য সাবান-পানি এসবের জোগান দিয়ে তা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার ফলে সেখানে করোনা আক্রমন অনেক কম হয়েছে।

অন্যদিকে মুম্বাই এর ধারাবি বস্তিতে কিন্তু এ সংক্রমণ অনেক বেশি হয়েছে। ফলে ধারাবি বস্তির ৩ টি জায়গার মানুষের এন্টিবডি টেস্ট করে দেখা গেছে প্রায় ৫০% ই পজেটিভ এসেছে। তার মানে হচ্ছে অন্ততপক্ষে এ বস্তির ৫০ ভাগ মানুষ এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্ত হয়ে উঠেছেন।

এদিকে আমাদের দেশে জুনের ১ তারিখ থেকে সবকিছু ওপেন হওয়ার পরে ঠিক কি অবস্থায় নিম্নআয়ের এ মানুষগুলো আছেন, করোনা সংক্রমণ সেখানে কতটা হলো সেটা নিয়ে এতদিন ধারণাগত বিষয় চালু থাকলেও সম্প্রতি আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআরবি এর যৌথ গবেষণার ফলাফল আমরা জানতে পেরেছি। সোয়া ৩ হাজার পরিবারের ১২ হাজার মানুষের উপরে পরিচালিত সে গবেষণায় দেখা গেছে- ঢাকার প্রায় ৯ শতাংশ মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। সে হিসেবে ঢাকায় দেড় কোটি লোকের বসবাস ধরলে করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা হবে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ। আর ২ কোটি ধরলে এ সংখ্যা আরো বেশি হবে।

অন্যদিকে, এ গবেষণা বলছে বস্তিবাসীর মধ্যে করোনার সংক্রমণের হার ৬ শতাংশ। তবে গবেষণায় নাকি এটাও দেখা গেছে ৮০ ভাগ করোনারোগী উপসর্গহীন।এটা খুবই চিন্তার বিষয়। কারণ এরাই পরিবারে, সমাজে এ ভাইরাসটি নীরবে ছড়িয়ে যাচ্ছেন। ফলে পরিবারের বয়স্ক মানুষজন বাসার বাইরে না গিয়েই করোনাক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। গত ১৮ এপ্রিল থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে ।

সে হিসেবে ৮ মার্চে সংক্রমণ ধরা পড়ার পরে ২৬ মার্চ থেকে ২ মাস যেহেতু ছুটি ছিল ফলে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে পুরো মে মাসের সময়কাল এবং জুন থেকে সবকিছু ওপেন হওয়ার পর থেকে ৫ জুলাই অবধি মানে ৩৫ দিনের একটা ”নিউ নরমাল” খোলা সময় এ জরিপের ভেতরে পড়েছে। ধারনা করছি, এ কারণেই হয়ত বর্তমানে করোনার বিস্তার অনুযায়ী আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম এসেছে। তবে, আশা করি এমন গবেষণা চলমান থাকবে পুরো সময়েই। তাহলে সামনের দিনগুলোতে আমরা পরিষ্কার একটা ধারণা পেতে পারি করোনার বিস্তৃতি নিয়ে। ধারণা করেতে পারি এটা কমছে নাকি বাড়ছে। কমলে বা বাড়লে সেটার গতিপ্রকৃতি কেমন ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কেও জানতে পারব। ভ্যাকসিন পাওয়ার আগ অবধি এটা চলমান রাখাটা তাই খুব দরকার।

সেই সাথে করোনার বিস্তার ঠেকাতে প্রশাসনিক উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা তৈরির কাজ নিরন্তরভাবে করে যেতে হবে। জনসাধারণকে মাস্ক পরতে বাধ্য করতে হবে বৃহত্তর স্বার্থেই। বস্তি এলাকায় ও নিম্ন আয়ের মানুষদের মাঝে কাপড়ের মাস্ক তৈরি করে ফ্রি বিতরণ করা যেতে পারে। এতে করে তারা সেটা ধুঁয়ে বারবার ব্যবহার করতে পারবেন।

এটা তো ঠিক, আমরা সবাই যদি মাস্ক পরি তাহলে শ্বাসপ্রশ্বাস, হাঁচিকাশির মাধ্যমে মূলত করোনার ছড়ানোর প্রধান যে গেটওয়ে সেটা তো বন্ধ হবে! তাতে করোনার বিস্তার কমবে। আক্রান্তের হারও কমবে। তাই বস্তিবাসীসহ সকল জনসাধারণকে মাস্ক পরিধানটা নিশ্চিত করতে পারলে করোনার বিস্তার বন্ধ করাটা খুবই সহজ হয়ে উঠবে। এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদেরকে তাই সনির্বন্ধ অনুরোধ করব।

লেখক : শিক্ষক ও চিকিৎসক, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।