আরও ধীরে এগোতে হবে শিখনকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়নে

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:১৪ এএম, ০৬ ডিসেম্বর ২০২০

মো. রহমত উল্লাহ্

শিক্ষামন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, আমাদের শিক্ষায় বড় পরিবর্তন আসন্ন। সেই পরিবর্তনের অংশ হিসেবে ২০২২ সাল থেকে শুরু হতে যাওয়া বিশ্বস্বীকৃত একমুখী শিক্ষার আওতায় পর্যায়ক্রমে অনুসরণ করা হবে নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি। নবম ও দশম শ্রেণিতে থাকবে না বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রবর্তন করা হবে নতুন আঙ্গিকের বই, আধুনিক শিখন কৌশল ও সার্বিক মূল্যায়ন পদ্ধতি।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রস্তাবিত পরিবর্তিত জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রবর্তিত হলে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত এই চারটি শ্রেণিতে কোনো সামষ্টিক মূল্যায়ন তথা বার্ষিক বা আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা থাকবে না। তাদের শিক্ষাকালীন তথা শ্রেণিকক্ষে ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে মূল্যায়ন হবে শতভাগ। নম্বরের পরিবর্তে লেটার গ্রেড বা ওয়ার্ডে প্রদান করা হবে মূল্যমান। থাকবে না শ্রেণি রোল নম্বর, থাকবে না প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় স্থান। প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের জন্য প্রত্যেকের থাকবে পৃথক আইডি নম্বর।

চতুর্থ শ্রেণি থেকে শুরু হবে শিখনকালীন তথা শ্রেণিকক্ষে ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষা মূল্যায়ন এর পাশাপাশি সামষ্টিক মূল্যায়ন তথা বার্ষিক বা আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রতি বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নে থাকবে ৭০ শতাংশ নম্বর এবং সামষ্টিক মূল্যায়নে থাকবে ৩০ শতাংশ নম্বর। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রতি বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নে থাকবে ৬০ শতাংশ নম্বর এবং সামষ্টিক মূল্যায়নে থাকবে ৪০ শতাংশ নম্বর।

অনুরূপভাবে নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিখনকালীন মূল্যায়নে থাকবে ৫০ শতাংশ নম্বর এবং সামষ্টিক মূল্যায়নে থাকবে ৫০ শতাংশ নম্বর। একইভাবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিখনকালীন মূল্যায়নে থাকবে ৩০ শতাংশ নম্বর এবং সামষ্টিক মূল্যায়নে থাকবে ৭০ শতাংশ নম্বর।

এনসিটিবি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত স্তর ভিত্তিক মূল্যায়ন কৌশল এর সারসংক্ষেপ:

jagonews24

ছবি : সংগৃহীত

শিখনকালীন মূল্যায়ন অনানুষ্ঠানিক ও ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন করা হবে। দেখা হবে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, আগ্রহ, আচরণ, অংশগ্রহণ, দৃষ্টিভঙ্গি, দক্ষতা, নৈতিকতা, দূরদর্শিতা ইত্যাদি। বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল যথাযথভাবে প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা ভিত্তিক এই মূল্যায়নটি শিক্ষক নিজেই সম্পন্ন করবেন।

শিখনকালীন মূল্যায়ন অবশ্যই একটি উত্তম ব্যবস্থা। তবে আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখনই তা সঠিকভাবে কার্যকর করা অত্যন্ত কঠিন হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, শিখনকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়নের জন্য শিক্ষকগণের হাতে যে পরিমাণ নম্বর প্রদানের ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে তা তারা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হবেন। কেননা, বিভিন্ন কারণে শিক্ষকগণের পছন্দ-অপছন্দের প্রভাব পড়তে পারে এর উপর। কোন শিক্ষক অনৈতিক হলে এই নম্বরের বিনিময়ে শিক্ষার্থীকে বাধ্য করতে পারেন প্রাইভেট পড়ার জন্য বা টাকা প্রদান করার জন্য। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে, পারিপার্শ্বিক দুরবস্থার বিরূপ প্রভাব কম/বেশি পড়বে শিক্ষকগণের উপর।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটির সভাপতি, সদস্য ও স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপে পড়লে আদর্শ শিক্ষকগণও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হবেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা অযোগ্য বা দুর্বল শিক্ষার্থীদরও পূর্ণ নম্বর দিতে বাধ্য হবেন। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য শক্ত অবস্থান নিতে গেলে শিক্ষকের চাকরি ও জীবন নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে যে সকল শ্রেণির শিক্ষা মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে সরকারি সনদ ও বৃত্তি প্রদান করা হবে সে সকল শ্রেণির শিক্ষকগণ অধিক চাপের সম্মুখীন হবেন এবং কেউ কেউ হয়ত স্বেচ্ছায় অনৈতিক হবেন।

এমতাবস্থায় শিখনকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়নের জন্য শিক্ষকগণের হাতে যে অধিক পরিমাণ নম্বর রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে তার পুরোটাই যদি শিক্ষকগণ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অযোগ্য শিক্ষার্থীদের দিতে বাধ্য হন, তাহলে মূল্যায়ন ব্যবস্থাটি অকার্যকর হয়ে, প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে, মুখ থুবড়ে পড়বে! যেমন, বর্তমানে প্রেকটিকেল বিষয়গুলোর প্রায় পূর্ণ নম্বর পেয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ শিক্ষার্থী। ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে ব্যবহারিক শিক্ষার মূল্যায়ন।

এইরূপ অবস্থার সম্প্রসারণ কারো কাম্য নয়। তাই শিখনকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় পা রাখার প্রথম কয়েক বৎসর শিক্ষকগণের হাতে এত বেশি পরিমাণ নম্বর প্রদানের ক্ষমতা না রেখে; আরো অল্প পরিমাণ নম্বর প্রদানের ক্ষমতা রাখা উচিত। নিরপেক্ষ ভাবে মূল্যায়ন করে নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকগণ যদি সফলতা দেখাতে পারেন, তাহলে দুইএক বছর পর ধীরে ধীরে শিক্ষকগণের হাতে নম্বর প্রদানের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।

লেখক : অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।