তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও আজকের বাংলাদেশ

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন
১লা জুন, ২০২১। মরহুম সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ৫২-৩ম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৬৯ সালে এই দিনে পেশাগত কাজে রাওয়ালপিন্ডি অবস্থানকালে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নশ্বর এই ধরাধামে কেউই চিরঞ্জীব নন। 'জন্মিলেই মরিতে হইবে' - এ এক অবধারিত সত্য। কিন্তু, এর মাঝেও কিছু মানুষ তাঁদের কীর্তিগুণে স্বদেশ ও স্বজাতির কাছে অমর হয়ে থাকেন। তাঁদের কীর্তি-গাথা দেশ ও জাতির কাছে দশকের পর দশক, শতকের পর শতক অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে।
মানিক মিয়া এদেশের সাংবাদিকতার জগতে তেমনই একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। গণতন্ত্রের মানসপুত্র খ্যাত এ দেশের অন্যতম মহান জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যে একজন খাঁটি জহুরি ছিলেন, সিন্ধু সেচে মণি-মাণিক্য বের করে আনায় অগাধ পারদর্শী ছিলেন, মানিক মিয়া তার একটি জ্বলজ্বলে উদাহরণ। সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য তাঁকে পিরোজপুরের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায়, যেখানে প্রথমে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারি (১৯৪৫) এবং পরবর্তীতে আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেহাদ-এর পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারি (১৯৪৬-৪৮) হিসেবে দায়িত্ব পালন ঠিক করে দিয়েছিল তাঁর জীবনের গতিপথ। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল মনসুর আহমেদের মতো ব্যক্তিদের সাহচর্যে রাজনীতি ও সাংবাদিকতায় তাঁর যে হাতে-খড়ি তা পরবর্তী জীবনে সাংবাদিকের জায়গা থেকে রাজনীতিকে মোটিভেট করতে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, তার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু ও মানিক মিয়া ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দুই নিবেদিতপ্রাণ ঘনিষ্ঠ সহচর। বলা হয়ে থাকে, এঁরা দু' জন তাঁর হয়ে আন্দোলন-সগ্রামে অসি ও মসির ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। বছর কয়েক আগে এক আলোচনা সভায় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, "হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জেল থেকে বেরোনোর পর যখন চিকিৎসার জন্য চলে যাচ্ছিলেন, তখন মুক্তিকামী যুবসমাজ তাকে প্রশ্ন করেছিলেন-আপনি চলে যাচ্ছেন, আমাদের কী হবে? জবাবে সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন-আমি দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। একটি হল মাঠ, অপরটি হল কলম, মাঠের দায়িত্ব মুজিবের, আর কলমের দায়িত্ব মানিক মিয়ার। এই দুটো জিনিস যেন বিচ্ছিন্ন না হয়। দুটো এক থাকলে আন্দোলন সফল হবেই।" (মাঠ দেখেছেন বঙ্গবন্ধু, কলমের দায়িত্বে ছিলেন মানিক মিয়া | দৈনিক ইত্তেফাক, ২ জুন, ২০১৬)
পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং এ ভূ-ভাগের মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ে মাওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতাদের নেতৃত্বে যে দীর্ঘ গণ-সংগ্রাম পরিচালিত হয়, তার পক্ষে জনমত গঠনে আক্ষরিক অর্থেই মানিক মিয়া ও তাঁর ইত্তেফাক এক বিরামহীন কলমযুদ্ধে নিয়োজিত ছিল। 'মোসাফির' ছদ্মনামে তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে মানিক মিয়া যেভাবে সহজ-সরল ভাষায় গণমানুষের মনের কথাগুলো ফুটিয়ে তুলছিলেন এবং চলমান গণ-সংগ্রামে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে সাধারণ জনতার আত্মিক সংযোগ স্থাপনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে আসছিলেন, তা ব্যতিরেকে রাজনীতির ময়দানে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছিল, তা সুদূর পরাহত ছিল। একারণে মানিক মিয়া ও ইত্তেফাককে বার বার তৎকালীন পাকিস্তানে গণ-বিরোধী সরকারসমূহের চক্ষুশূল হতে হয়েছে। স্রেফ একজন সাংবাদিক হয়েও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতো মানিক মিয়াকে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। এমনকি, কখনও ইত্তেফাক সহ এই গ্রুপের অন্যান্য পত্রিকা সমূহ বন্ধ করেও দেয়া হয়েছে।
কিন্তু, মানিক মিয়া ছিলেন একজন অকুতোভয়, নির্মোহ, আপোসহীন সাংবাদিক। সাংবাদিকতাকে যতটা না তিনি জীবিকা বা পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি নিয়েছিলেন গণ-মানুষের খেদমত করার একটি অদ্বিতীয় সূযোগ হিসেবে। তাই, আমরা দেখি, যুক্তফ্রন্ট সরকারে মন্ত্রিত্বের অফার তাঁকে আকর্ষণ করেনি। স্বৈর শাসকদের জেল-জুলুম কিংবা প্রলোভন- কোনটাই তাঁকে গণতন্ত্র ও গণ-মানুষের অধিকারের পক্ষে তিনি যে কলমযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তা থেকে এতটুকু টলাতে পারেনি।
স্পষ্টতই এদেশের স্বাধীনতার জন্য জনমত গঠনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের চেয়ে মানিক মিয়ার মতো অকুতোভয় ও আত্মোৎসর্গীকৃত কলম সৈনিকদের ভূমিকা মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তাঁদের যৌথ প্রচেষ্টায় যে প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছিল, সেটাই ছিল মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের চালিকা শক্তি। দেশ স্বাধীন হয়েছে, যদিও মানিক মিয়ার তা দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। যে স্বপ্ন নিয়ে মানিক মিয়ার মতো মহতী ব্যক্তিত্বরা তাঁদের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, তা কতটুকু অর্জিত হয়েছে? দেশে আজ সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিপুল সমাহার, কিন্তু মানিক মিয়া জেল-জুলুম আর প্রলোভনকে নস্যি করে নির্ভীক, আপোষহীন, গণমূখী সাংবাদিকতার নজির আমাদের জন্য রেখে গেছেন, সেই মানদন্ডে আমরা কতটুকু উত্তীর্ণ?
সবাই ভাল থাকুন।
লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি।
এইচআর/জেআইএম