বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১০:১১ এএম, ০২ অক্টোবর ২০২১

বিশ্ববিদ্যালয় শি ক্ষকদের মূল্যায়ন প্রয়োজন। এ নিছক সাধারণ জনদাবি নয়, আমার ধারণা খোদ শিক্ষকদের ভেতর যারা সংবেদনশীল তারা নিজেরাই এমন ভাবনা ভাবছেন। দেশে এত এত বিশ্ববিদ্যালয়, হাজার হাজার পড়ুয়া। তাদের মূল্যায়ন করেন শিক্ষকরা। কিন্তু তাদেরও যে নিরবচ্ছিন্ন সার্বিক মূল্যায়ন প্রয়োজন সেকথা এখন অনুভূত হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি পেলে শিক্ষক হওয়া যায়। পাবলিক তথা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া একেবারে নিশ্চিন্ত জীবন। আর তাই শিক্ষক হতে প্রথম বর্ষ থেকেই ভাল রেজাল্টের পেছনে ছুটে ভবিষ্যতের শিক্ষকরা। অনেক শিক্ষার্থীই লেখাপড়া ও জ্ঞান অর্জনকেই শ্রেয় মনে করে ভাল পড়ালেখা করে শিক্ষক হতে চান। তবে একটা বড় অংশই পথ ধরেন রাজনীতির। শিক্ষকদের ভেতর যে গ্রুপ শক্তিশালি তাদের নেটওয়ার্কে ঢুকে যেতে পারলে আর কিছুটা ভাল রেজাল্ট থাকলে পথটা কোথাও আর অসমতল থাকে না তাদের জন্য।

শিক্ষক নামের ভোটার নিয়োগের এই প্রক্রিয়াটা বড় ক্ষতি করছে আমাদের উচ্চ শিক্ষার। আর এরই পথ ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নানা কর্মকাণ্ড আজ ব্যাপক আলোচিত। কেউ নাপিতের ভূমিকায়, কেউ বা মারামারি করেন। কোন উপাচার্যকে আমরা দেখি মেয়াদ শেষের আগেই রাতের আঁধারের পালিয়ে যেতে হয়, কেউ বা মেয়াদ শেষ হলে ভুয়া নিয়োগ দেয়ার কারণে পুলিশ পাহাড়ায় ক্যাম্পাস ছাড়েন, কেউ বা ‘ছা ছমুছা’ উপাধি নিয়ে প্রতিষ্ঠানকে বিব্রত করেন, কেউ একজন উপাচার্য হয়ে ক্যাম্পাসে না থেকেই বছরের পর বছর দূর থেকে রিমোট কন্ট্রোলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন।

কিন্তু একথা বলা যাবে না যে শিক্ষকরা সবাই এমন। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অসংখ্য শিক্ষক আছেন যারা পড়ুয়াদের কল্যাণে নিবেদিত, যারা নির্মোহভাবে, নিরপেক্ষভাবে একাডেমিক কাজ করছেন, যারা দেশকে কিছু দেওয়ার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছেন। এদের সংখ্যা বেশি হলেও রাজনীতিকিকরণের বড় আয়োজনে এরা আড়ালে চলে গেছেন। সামনে এসেছেন নাপিত-রা, সমুচা সিঙ্গারা ঐতিহ্য প্রবর্তকরা।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। অবসাদ, হতাশা কেন এত বাড়ল এমন প্রাণচঞ্চল পড়ুয়াদের মধ্যে সেটা খতিয়ে দেখা দরকার বলে সবাই অভিমত দিচ্ছেন। চুল কেটে দেওয়ার অপমানে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সহকারী প্রক্টর ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন এরকম করে ১৪ ছাত্রের চুল কেটে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় যে তদন্ত কমিটি হয়েছে তার সদস্যরা অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছেন।

অনেক সিনিয়র অধ্যাপক বলছেন, ফারহানা ইয়াসমিন শিক্ষক হওয়ার অযোগ্য। অনেকেই বলছেন তার মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু কে যে যোগ্য সেটাও বড় প্রশ্ন। যে উপাচার্য নিজের ছেলে মেয়ে বা জামাইকে চাকরি দিতে শত শত অবৈধ নিয়োগ দেন, যিনি ঠিকাদার নিয়োগ করেন ঘরের মানুষকে, যিনি ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে অসংবেদনশীল কথা বলেন, হল প্রশাসন চালাতে গিয়ে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের নির্দেশ পালন করেন তারাওতো শিক্ষক নামের মর্যাদার আসনে। একবার চাকরিটা হলেই হলো, আর পেছনে ফিরে চাইতে হয় না। তাদের প্রশিক্ষণ নেই, মানোন্নয়নের কোন প্রচেষ্টা নেই। এখানেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সাথে শিক্ষকদের নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়নের সম্পর্ক। সবকিছু পরিচালিত হয় শিক্ষকদের মাধ্যমে, তাই তাঁদের মূল্যায়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের সাথে সম্পর্কিত।

একটা করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। এটা ভাল দিক যে উচ্চ শিক্ষা প্রান্তিক মানুষের দ্বারে যেতে পারছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোর দিকে নজর দেওয়া হয়েছে, ভাল শিক্ষক নিয়োগ, ভাল পড়ালেখার পরিবেশে সেরকম দৃষ্টি নেই। শিক্ষকের কাজ নতুন প্রশ্নের দিকে তরতাজা মনগুলোকে এগিয়ে দেওয়া, যাতে তাদের কাছেও শিখতে পারেন শিক্ষক স্বয়ং। সমস্যা হলো, গত কয়েক দশকে ভয়াবহতার নানা আয়োজনে ভরে গেছে আমাদের ক্যাম্পাসগুলো।

সত্যিকারের শেখার মতো আদর্শবাদী, প্রতিবাদী ছাত্র অপুকে আত্মহত্যা করতে হয়, আর তার বিপরীত পথের কেউ হয়তো শিক্ষক হয়ে আসন দখল করেন। এরকম পরিস্থিতির বদলের মধ্যেই আমাদের মুক্তি। অনেক ভাল শিক্ষক আছেন। সঙ্কট সময়ে আমরা তাঁদের খুঁজি যারা মনের জানালা খুলে দিতে পারেন, চিন্তা করতে শেখান, প্রশ্ন করতে শেখান।

সত্যিকারের ভাল পরিবেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শরীর আর শিক্ষকের শরীরে কোনও ভেদ থাকে না। যারা পড়তে আসে আর পড়াতে আসেন, তাদের মিশে থাকার কথা এই রকমই। আজকাল সেটা আর আমরা দেখছি না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে গিয়ে সমাজকে যারা নেতৃত্ব দিবেন, তারা কি শিখে যাচ্ছেন শিক্ষকদের কাছ থেকে?

মানুষের দিকে তাকানো, সমাজকে চেনা, জীবনে আদর্শের জায়গাটা ঠিক করে দিতে পারেন এই শিক্ষকরাই যারা রাজনীতির কোলাহলের চাইতে জ্ঞানের গভীর নির্জন পথটাকেই বড় করে দেখেন। পরিচ্ছন্ন মন নিয়ে শিক্ষকরা যদি আজ আকাশের দিকে তাকান নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্নের উত্তর পাবেন।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।