চামড়া শিল্পে সুদিন আসুক

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ১১:৪৬ এএম, ১১ জুলাই ২০২২

ছেলেবেলায় আমরা বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য হিসেবে নাম পড়েছি পাট, চা, চামড়ার। তালিকাটা এখন বদলে গেছে, তবে তালিকায় এখনও তিন নম্বরেই আছে চামড়ার নাম। তবে তালিকার সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে প্রায়োরিটিও। এখন বাংলাদেশে রপ্তানি মানেই তৈরি পোশাক। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রপ্তানি আয় পাঁচ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। এটা অবশ্যই বড় অর্জন। কিন্তু ঝুঁকিটা হলো, এ অর্জন এসেছে মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি করেই।

রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশই তৈরি পোশাক খাত থেকে আসা। গত অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে চার হাজার ২৬১ কোটি ডলারের। তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকা হোম টেক্সটাইল রপ্তানি হয়েছে ১৬২ কোটি ডলার। আর আগের মতো তালিকার তৃতীয় স্থানে থাকা চামড়াখাত থেকে এসেছে ১২৫ কোটি ডলার। তৃতীয় স্থান ধরে রাখা গেছে, প্রবৃদ্ধিও হয়েছে এবং রপ্তানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে তাতেই চামড়াখাত সংশ্লিষ্টরা খুশি।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, সবকিছু ঠিকঠাক মতো করা গেলে চামড়াখাত হতে পারতো আমাদের রপ্তানির অন্যতম বড় খাত। চামড়াখাতের বিপুল সম্ভাবনার কারণ হলো, কাঁচা চামড়ার বিপুল সরবরাহ। ঈদুল আজহায়ই বাংলাদেশে এক কোটি পশু কোরবানি হয়। সারাবছর মাংসের চাহিদা মেটাতে আরও এক কোটি পশু জবাই হয়। সবমিলে চামড়ার এই বিশাল সরবরাহকে ঠিকমতো ব্যবহার করা গেলে চামড়াখাত রপ্তানিতে আরও বড় অবদান রাখতে পারে।

১৯৪০ সালে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা নারায়ণগঞ্জে প্রথম একটি ট্যানারি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫১ সালে ঢাকার হাজারীবাগে ট্যানারি শিল্প স্থাপিত হয়। আমাদের সমস্যা হলো আমরা খুব বেশিদূর দেখতে পাই না। একসময় ঢাকার মূল রেলস্টেশন ছিল ফুলবাড়িয়ায়। সেটি সরিয়ে নেওয়া হয় কমলাপুরে। এখন কমলাপুরও শহরের ভেতরে চলে এসেছে। একসময় ঢাকার মূল বাস টার্মিনাল ছিল গুলিস্তানে। তারপর সায়েদাবাদ, গাবতলী আর মহাখালীতে সরিয়ে নেওয়া হয় টার্মিনাল। কিন্তু তিনটি টার্মিনালই এখন শহরের ভেতরে চলে এসেছে। সময় এসেছে টার্মিনাল আরও দূরে সরিয়ে নেওয়ার।

একসময় বিমানবন্দর ছিল তেজগাঁওয়ে। সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো কুর্মিটোলায়। এখন আবার বিমানবন্দর সরানোর জায়গা খোঁজা হচ্ছে। এটাই সমস্যা- আমাদের দূরদৃষ্টি নেই। আমরা শতবছরের দূরের কথা ভাবতে পারি না। আমাদের ভাবনা দশকেই আটকে যায়। শহরতলী ভেবে যেই হাজারীবাগে ট্যানারি শিল্প স্থাপন করা হলো, তা শহরের মাঝে চলে আসতে সময় লাগেনি। বুড়িগঙ্গা যে মৃতপ্রায়, তার জন্য অন্যতম প্রধান দায় হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প। পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণও এই ট্যানারি শিল্প।

বহু লড়াই, বহু চেষ্টা, শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে সাভারে সরানো গেছে ট্যানারি শিল্প। কিন্তু তাতে যেন সরে গেছে ট্যানারি শিল্পের মোমেন্টামও। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরানো গেলেও সরানো যায়নি সমস্যা। নতুন করে ট্যানারি শিল্পকে ঢেলে সাজানোর জন্য উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে পারেননি। হাজারীবাগে মূল শিল্পের পাশাপাশি চামড়াজাত পণ্যের ছোট ছোট শিল্প ছিল, সেগুলোর ঠাঁই হয়নি সাভারে। তারচেয়ে বড় কথা পরিবেশ দূষণের যে সংকট সেটি কাটানো যায়নি মোটেই।

আগে নষ্ট হতো বুড়িগঙ্গা, এখন দূষিত হচ্ছে ধলেশ্বরী। বাংলাদেশ এত এগিয়েছে, নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু বানাচ্ছি, মেট্রোরেল বানাচ্ছি, নদীর নিচে টানেল বানাচ্ছি। কিন্তু পরিবেশসম্মত একটা ট্যানারি শিল্প বানাতে পারিনি এতদিনেও। সাভার ট্যানারি শিল্পে স্থাপিত হয়নি বর্জ্য পরিশোধনাগার। আপনি বলতে পারেন, আমার ট্যানারির বর্জ্য আমি ধলেশ্বরীতে ফেলবো, সিইটিপি বসাবো না; আপনার কী? আমার তাতে কিছুই যায় আসে না। সমস্যা ট্যানারি শিল্পকে কমপ্লায়েন্স করতে না পারলে আপনি এই জায়গাতেই আটকে থাকবেন, এগুতে পারবেন না। রপ্তানিতে জাম্প করতে হলে আপনাকে নিরাপদ, পরিবেশসম্মত ট্যানারি শিল্প গড়ে তুলতে হবে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকি খাত যে আজ শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে লড়াই করছে; তার পেছনের গল্পটা বড্ড বেদনার। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৭৫ জন মানুষ মারা যায়। তারপর অ্যাকর্ড আর অ্যালায়েন্সের কঠোর নজরদারি বদলে দেয় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। অ্যাকর্ড আর অ্যালায়েন্সের মাতব্বরিতে তখন অনেকে মনোক্ষুণ্ন হলেও আখেরে সেটা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে স্থায়ী একটা ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। আমরা জানি না, মৃত্যু না হলেও তেমন বড় কোনো ধাক্কাই হয়তো বদলে দিতে পারে, বাংলাদেশের চামড়া শিল্প খাতকে। তবে বুড়িগঙ্গা এবং ধলেশ্বরীর মতো দুটি নদীকে মেরে ফেলেও ট্যানারি শিল্প আমাদের টনক নড়াতে পারেনি। আর কী হলে ট্যানারি শিল্প নিরাপদ হবে?

ইউরোপ, আমেরিকার বাজারে পণ্য রপ্তানি এবং নামি ব্র্যান্ডের কাজ পেতে হলে যে কোনো ট্যানারিকেই আন্তর্জাতিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পেতে হয়। বছরে দুই কোটি পশুর চামড়ার বিশাল বাজার বাংলাদেশে কমবেশি ২৫০টি ট্যানারি আছে। এর মধ্যে এলডব্লিউজি সনদ আছে কয়টি প্রতিষ্ঠানের জানেন? বিশ্বে এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৪৩টি। এর মধ্যে ভারতে ১৩৯, চীনে ১০৩, ইতালিতে ৬৮, ব্রাজিলে ৬০, তাইওয়ানে ২৪, স্পেনে ১৭, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কে ১৬ ও ভিয়েতনামে রয়েছে ১৪টি। আর বাংলাদেশের মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠানের এই সনদ আছে। অথচ এই সনদ পেলে দাম পাওয়া যাবে ভালো, খুলে যাবে বিশ্বের বাজারও। তখন আর ১২৫ কোটি ডলারের রপ্তানিতে তৃপ্ত হতে হবে না। হাজার কোটি ডলার রপ্তানি করার সুযোগও এনে দিতে পারে চামড়াখাত।

নীতিনির্ধারকদের কাছে চামড়া শিল্প যেন দুয়োরানি। তৈরি পোশাক খাত সরকারের যতটা আনুকূল্য পান, ততটা পায় না চামড়া শিল্প খাত। চামড়ার নামে ঋণ নিয়ে সিনেমা বানানোর বাজে উদাহরণ যেমন আছে, তেমনি অনেক যোগ্য উদ্যোক্তার প্রয়োজনীয় ঋণ না পাওয়ার উদাহরণও আছে। সরকারকে অবশ্যই মমতা নিয়ে চামড়া শিল্পের পাশে দাঁড়াতে হবে। তবে তার আগে কঠোরভাবে পরিবেশ, নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দ্রুত এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া যায়। সরকারের নীতিসহায়তা আর উদ্যোক্তাদের আন্তরিকতাকে একসুতোয় গাঁথতে পারলে বাংলাদেশের অবহেলিত চামড়া শিল্পেও সুদিন আসবে।

এইচআর/বিএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।