সাংবাদিক খুন নিপীড়ন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১০:০৮ এএম, ২৪ জুন ২০২৩

 

জামালপুরের বকশীগঞ্জে সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিমের ওপর ১৫ জুনের ভয়াবহ হামলা ও হত্যার রেশ না কাটতেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সাংবাদিক ভয়ংকরভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। নাদিমকে আক্রমণ করে, পিটিয়ে হত্যা করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু ও তার পুত্র ছাত্রলীগ নেতা রিফাত। সাথে ছিল আরও অনেকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক দোস্ত মোহাম্মদকে আহত করেছে ছাত্রলীগ নেতারা।

বাংলাদেশে সাংবাদিকতা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হয়ে উঠছে এবং দিন দিন ঝুঁকির মাত্রা বাড়ছে। প্রান্তিক এলাকায় প্রায় প্রতিটি সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত হিসেবে শাসক দলের নাম উঠে আসছে। মানুষের প্রতিবাদের মুখে বাবু চেয়ারম্যানকে র্যাব গ্রেফতার করেছে, খুনিদের আরও কয়েকজনও গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু হত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া চেয়ারম্যান পুত্র এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েই যাচ্ছে, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি এখন পর্যন্ত। সৌজন্যের খাতিরেও যে কিছু ব্যবস্থা নিতে হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ তাও করেনি। বরং টেলিভিশন টকশোতে এসে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি বলে গেলেন তারা ‘রোগী’ দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। একজন নির্যাতিত সাংবাদিক তাদের কাছে কেবলই একজন রোগী!

ছাত্রলীগ নেতাদের নানা প্রকার গ্রুপিং আর বিবাদের ফলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বারবার লেখাপড়া ও পরীক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে। তাদের কমিটি গঠন নিয়ে ধর্মঘট আর অবরোধ ডেকে মাসের পর মাস ক্লাস, পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ ছাত্রলীগের কমিটির সাথে বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পর্কই নেই। কিন্তু রাজনীতিতে নিমজ্জিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্তারা কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারছেন না। একজন সাংবাদিক, যিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রও, চায়ের দোকানে ফাঁকা চেয়ারে কেন ছাত্রলীগের অনুমতি ছাড়া বসেছে সে কারণে তাকে আক্রমণ করা হয়েছে এবং মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে।

এই রাজনীতি করে ছাত্রলীগ? যে রাজনীতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের এতটা নিচু দৃষ্টিতে দেখে যে তাদের অনুমতি ছাড়া চেয়ারেও বসা যাবে না? এ কোন রাজনীতি যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরাই প্রতিপক্ষ? আমরা জানি কোনো না কোনোভাবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ‘ম্যানেজ’ করবেন এবং সাংবাদিক হত্যা চেষ্টাকারী ছাত্রলীগ নেতাকে কিছুই করা হবেনা।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নানা কারণে নেতিবাচকভাবে আলোচিত। সংগঠনটি এই পুরো সময়টিতে সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিকমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, সহিংস আচরণ, ধর্ষণ, খুন, ছিনতাইসহ এমন কোনো অভিযোগ নেই যা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে উঠছে না। একবার তো খোদ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতিও তার ছাত্রলীগ সদস্যপদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্রলীগ শোধরায়নি। দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়েছে।

জামালপুরে সাংবাদিক হত্যা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক নিপীড়ন এমন সময়ে ঘটল যখন আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার ও দল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যথেষ্ট চাপের মধ্যে রয়েছে। ভালো ভাবমূর্তি এখন কাঙ্খিত, অথচ এদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এরা বরাবরের মতোই আছে পেশি ও ক্ষমতা প্রদর্শনীতে।

এখন প্রতিটি ঘটনাই যে কীভাবে নজরদারির মধ্যে থাকছে সেটা যদি তরা বুঝতো। এর মধ্যেই গত বুধবার সাংবাদিক নাদিম হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে ঢাকায় নিযুক্ত ১১টি দূতাবাস ও হাইকমিশনের সংগঠন বাংলাদেশে মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন (এমএফসি)। প্রতিশোধ বা ক্ষতির ভয় ছাড়াই সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে দায়িত্বশীল সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে এমএফসি। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলো হচ্ছে—কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।

বিশ্বে বহু দেশেই সাংবাদিকের নিরাপত্তা নাই, কিন্তু বাংলাদেশে সাংবাদিক হেনস্তায় অনেকের অপেক্ষা অধিক আগ্রহী। একাধিক মূল্যায়নে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে আমাদের স্থান একদম শেষের সারিতে। বাক্স্বাধীনতার সুরক্ষা সংবিধান দিয়েছে। কতটা পাই সেটা আমরা জানি। কিন্তু সাংবাদিকের সুরক্ষা সরকার কেন দেয় না? কেন দিতে পারছে না? আর সুরক্ষা হবেই বা কী করে যখন খোদ শাসক দলের লোকজন নিজেরাই নিপীড়ক?

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের হয়রানি করার রেকর্ড হওয়ার পর আপাতত কিছুটা হ্রাস টানা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকের প্রতি যূথবদ্ধ সহিংস ঘটনা কমছে না। খুন করা, নারী সাংবাদিক হলে ধর্ষণের হুমকি, গুরুতর মিথ্যা অভিযোগ এসে মামলায় ফাঁসানো, সাংবাদিকের চাকরি খারিজ করার চেষ্টা সবই যেন কতিপয় নেতা ও তাদের অনুগামীদের ‘রাজনৈতিক কার্যক্রম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এখন যারা বিরোধী দলে থেকে সরকারের নিন্দা করছে সাংবাদিক হত্যা ও নিপীড়নের জন্য তাদের আমলেও হত্যা, নিপীড়ন কম হয়নি। যখন তাদের পক্ষে খবর প্রকাশিত হয়, বিশেষত বিরোধী দল হিসেবে, তখন রাজনৈতিক নেতারা খুব খুশি হন। আবার তারাই যখন শাসক দলে পরিণত হয়, তখন তারা সেটি সহ্য করতে পারে না। এটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভাজিত রাজনীতির চরম অবস্থানের মাঝখানে সাংবাদিকতার জন্য একটা সুস্থ পেশাদারি পরিসর খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/এমএস

এখন যারা বিরোধী দলে থেকে সরকারের নিন্দা করছে সাংবাদিক হত্যা ও নিপীড়নের জন্য তাদের আমলেও হত্যা, নিপীড়ন কম হয়নি। যখন তাদের পক্ষে খবর প্রকাশিত হয়, বিশেষত বিরোধী দল হিসেবে, তখন রাজনৈতিক নেতারা খুব খুশি হন। আবার তারাই যখন শাসক দলে পরিণত হয়, তখন তারা সেটি সহ্য করতে পারে না। এটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভাজিত রাজনীতির চরম অবস্থানের মাঝখানে সাংবাদিকতার জন্য একটা সুস্থ পেশাদারি পরিসর খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।