বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসরাইলি সংযোগ

মোস্তফা হোসেইন
মোস্তফা হোসেইন মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশিত: ১০:২১ এএম, ২৫ জুন ২০২৩

গণঅধিকার পরিষদের দুই শীর্ষ নেতা রেজা কিবরিয়া এবং নুরুল হক নূরের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব, রাজনীতির মাঠে ছোট দলটিকেও বড় আলোচনায় স্থান করে দিয়েছে। রেজা কিবরিয়া এবং নূর এর একে অন্যের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য উপস্থাপনের কারণে এই আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি হলো। তাদের বাদানুবাদের সুবাদে এমনসব অভিযোগ এসেছে, যা একটি দলই শুধু নয় বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের প্রসঙ্গও চলে আসে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নূর তারই দলের প্রধান রেজা কিবরিয়াকে মাতাল বলেও আখ্যায়িত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে রেজা কিবরিয়া নূরকে ইসিরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন। এবং চারশ’ কোটি টাকার কোনো হিসাব নূর দেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন।

রেজা কিবরিয়ার নামে প্রকাশিত এই তথ্যের অর্থ হচ্ছে, নূর ইসরাইলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তাদের কাছ থেকে অর্থ সহযোগিতা পেয়েছেন। এটা সত্য হলে নূরের বিরুদ্ধে প্রচারিত অভিযোগটি গুরুতর। আবার রেজা কিবরিয়া যদি নূরকে ইসরাইলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে থাকেন, তাহলে তিনিও যে বিতর্কিত রাষ্ট্র ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ট ব্যক্তি তাও প্রমাণ হয়ে যায়।

এর জের ধরে দুইজন দুইজনকে বহিস্কার করার সংবাদও প্রকাশ হয়েছে। এবং দুইজনের দ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছানোর কারণ অনুসন্ধানের জন্য দলের অন্য নেতারা ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। এটা একটি সংগঠনের অভ্যন্তরীন বিষয়। তারা দলের প্রয়োজনে এমনটা করতেই পারেন। নূর তার নেতাকে কী বলে গালি দিলেন সেটাও তাদের দলীয় বিষয় হিসেবে গণ্য হতে পারে। লাভক্ষতি যাই হোক সবই তাদের দলের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। কিন্তু যে মুহূর্তে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার প্রসঙ্গ আসে তখন আর এটি নির্দিষ্ট একটি দলের বিষয় থাকে না।

এর আগেও নূরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিলো, মুসাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। এবং সেই সম্পর্কের প্রমাণ হিসেবে মুসাদের জনৈক কর্মকর্তার সঙ্গে নূরের ছবিও প্রকাশিত হয়েছিলো। এই মুহূর্তে তাদের দলের আহ্বায়ক নিজেই যেখানে ইসরাইলের প্রসঙ্গ অভিযোগের আকারে প্রকাশ করেন তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোনো কারণ থাকে না।

যারা মনে করেন ক্ষুদ্র একটি রাজনেতিক দলকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া ঠিক নয়, তাদের কাছে ইসরাইলি সংশ্লিষ্টতা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কি না এটা ভাবার বিষয়। যদি তারা ফিলিস্তিনিদের ওপর আগ্রাসনকে স্বাভাবিক মনে করেন,তারা যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পর্কহীন ইসরাইলকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সঠিক সহযোগী মনে করেন তাহলে ভিন্ন কথা। যদি তাদের রাজনৈতিক আদর্শে ইসরাইলি আগ্রাসনকে যথাযথ মনে করা হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগগুলো অবশ্যই গুরুতর হিসেবে গণ্য হবে।

জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শত্রুমহল নড়েচড়ে বসার ইঙ্গিত ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। যাদের ইন্ধন যোগাচ্ছে বাংলাদেশেরই কিছু মানুষ, যারা বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য দীর্ঘদিন পর্যন্ত ওৎ পেতে আছে। ভিতরে থাকা একটি মহল সেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার জন্য অপেক্ষা করছে। সুতরাং ছোট দল হওয়ার কারণে বিষয়টিকে উপেক্ষা করার সুযোগ আছে কি না ভেবে দেখতে হবে।

ইতোমধ্যে বিদেশে অবস্থান করে বাংলাদেশের কিছু মানুষ দেশ ও সরকার বিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন অপপ্রচার চালিয়ে দেশে বিশৃংখলা তৈরির চেষ্টা করছে। তাদের সঙ্গে এমন মানবতা বিরোধী রাষ্ট্রের সহযোগী কেউ যদি যুক্ত হয় তাহলে আগামী নির্বাচনের পরিবেশ কোন পর্যায়ে পৌছাতে পারে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি হতেই পারে।

বিভিন্ন মহল থেকে এই চক্রের আর্থিক সংস্থানের বিষয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এই চক্রকে কারা আর্থিক সহযোগিতা করছে বিষয়গুলো সন্দেহজনক। এমন অবস্থায় ছোট একটি দলের সঙ্গে যখন ইসরাইলের মতো একটি দেশের সংযোগ এবং আর্থিক সহযোগিতার অভিযোগ পাওয়া যায় তখন বিদেশে থেকে অন্য চক্রগুলোর চক্রান্ত সম্পর্কেও অনুমান করা যায়। ভাবনার বিষয় বিদেশি এই চক্র কি শুধু ছোট দলের সঙ্গেই শখ্য গড়েছে নাকি বড় কোনো দলকেও পৃষ্ঠপোষকতা করছে।

নূরের ইসরাইলি সহযোগিতা নেয়া সম্পর্কিত একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে দৈনিক কালবেলা। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ীও নূর ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং তাদের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন। শুধু তাই নয় সেই টাকা তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে ব্যাবসায় বিনিয়োগ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে গাড়ির ব্যবসায়ও তিনি সেই অর্থ বিনিয়োগ করেছেন বলে সংবাদে প্রকাশ হয়েছে। এই অভিযোগগুলো সত্য হলে তা আমাদের দেশের রাজনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির জন্য ইসরাইলি অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকার অভিযোগ শুধু নূরের বিরুদ্ধেই আসেনি এর আগে ২০১৬ সালে বিএনপির তৎকালীন যুগ্ন মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধেও তেমনি অভিযোগ এসেছিলো। তখন সংবাদ হয়েছিলো আসলাম চৌধুরী মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেই ছবি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিলো। শুধু তাই নয় আসলাম চৌধুরী যাতে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে না পারে সেই জন্য নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছিলো। তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও বরাবরই ভাবিয়ে তোলে। আগামী সাধারণ নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশিদের দৌড়ঝাঁপ ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গণঅধিকার পরিষদের নেতা রেজা কিবরিয়ার নামে প্রকাশিত এই তথ্য যদি সঠিক হয় তাহলে বুঝতে হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এই বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যও স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি সম্প্রতি সাংবাদিকদের এই বিষয়ে আভাসও দিয়েছেন।

বাংলাদেশের কল্যাণে বাংলাদেশের রাজনীতি পরিচালিত হবে এটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা। এখন কেউ যদি ক্ষমতার চিন্তা করে দেশের স্বার্থকে বিলিয়ে দিতে দ্বিধা না করে তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ স্বাভাবিকবাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। প্রধানমন্ত্রী ২১জুন গণভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য দানকালে বলেছেন সেন্টমার্টিন্স দ্বীপ দেওয়ার বিনিময়ে তিনি ক্ষমতা চান না। তাঁর ওই বক্তব্যে স্পষ্ট করে তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে তিনি দেশের কোনো সম্পদ বিক্রি করে ক্ষমতায় আসতে চাই না।

তাঁর এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের প্রতি কারো কারো কুদৃষ্টি পড়েছে কিংবা কুদৃষ্টিটা আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশের সার্বভৌমত্ব বিষয়ে সজাগ থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশের রাজনীতি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো দ্বারা পরিচালিত হবে এবং অবশ্যই দেশের স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রেখেই রাজনীতি করতে হবে।

লেখক: গবেষক, সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।