ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ঈদুল আজহা

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৮:৫০ এএম, ২৯ জুন ২০২৩

আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে মুসলিম উম্মাহ বছরে দুটি ঈদ উদযাপন করে। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। আমরা বাঙালিরা ঈদুল আজহাকে কোরবানির ঈদ বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কোরবানি শব্দের অর্থ নৈকট্য, ত্যাগ ও উৎসর্গ। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই এ কোরবানি। কোরবানির ঈদ পালনের মাধ্যমে বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবি হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.) এর অতুলনীয় আনুগত্য এবং মহান ত্যাগের পুণ্যময় স্মৃতি বহন করে।

আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির জন্য মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর পশু কোরবানি করে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘অতএব আপনি আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন’ (সুরা কাউসার, আয়াত ২)। কোরবানি একটি প্রতীকী ব্যাপার।

এখানে পশু কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জানমাল থেকে শুরু করে সব কিছুই কোরবানি করতে প্রস্তুত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুরো পরিবারের নজিরবিহীন কোরবানির ইতিহাস মানুষকে যে ত্যাগের শিক্ষা দেয়, তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন মুমিন তার সব কিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকে।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এবং মা হাজেরার আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশগুলো আল্লাহতায়ালা হজের অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন। আল্লাহতায়ালা হজরত ইব্রাহিম (আ.) কে স্বপ্নে দেখালেন, তিনি তার পুত্রকে জবেহ করছেন (সুরা সাফ)। যেভাবে কোরবানি কবিতায় কবি নজরুল বলেছেন: এই দিনই মিনা ময়দানে, পুত্র-স্নেহের গর্দানে, ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে, রেখেছে আব্বা ইব্রাহিম সে আপনা রুদ্র পণ! ছিঃ ছিঃ! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন!

আজ জল্লাদ নয়, প্রহ্লাদসম মোল্লা খুন-বদন! ওরে হত্যা নয় আজ সত্যগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।’ পিতা ইব্রাহিম স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গেলে আল্লাহ বললেন, আরে ইব্রাহিম, তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছ। আমি তোমাকে নিজ পুত্রকে আমার পথে উৎসর্গ করতে বলেছি, হত্যা করতে নয়। তোমার পুত্র সারা জীবন লোকদের বোঝাবে আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। প্রশ্ন হলো- তা হলে কেন দুম্বা বা ছাগল জবাই করলেন? এর উত্তর হলো- যদি সেদিন এই ঘটনা না ঘটতো, তা হলে তৎকালীন ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী কোনো কোনো জাতিতে প্রভুকে বা দেব-দেবীদের খুশি করার জন্য নরবলি তথা মানুষ কোরবানি চলমান থাকতো। অতএব আল্লাহ মানবজাতিকে শিক্ষা দিলেন, মানুষ জবেহ করার জিনিস নয়, জবেহ যদি করতে হয় তা হলে পশু জবেহ করো।

ইতিহাস পাঠে জানা যায়, হজরত রাসুলে পাক (সা.)-এর শ্রদ্ধেয় পিতা একবার অসুস্থ হলে তার দাদা ১০০ উট জবেহ করেছিলেন (সিরাতে নববি)। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, পশু জবেহ করা রাসুল (সা.) প্রচলন করেননি বরং আগেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবেহ করা হতো। পশু কোরবানির আরও একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনে মুসা (আ.)-এর জাতিকে আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন, ‘তোমরা যে গাভিকে পূজা করো, সে পূজনীয় নয়; বরং আমি পূজনীয়, অতএব সেটাকে জবেহ করো’ (সুরা আল বাকারা, রুকু ৮)

গরু তোমাদের উপকারার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে, যেন তোমরা এর দুধ পান করতে পারো এবং গোশত খেতে পারো আর এর মাধ্যমে অন্যান্য উপকার সাধন করতে পারো। মূল উদ্দেশ্য হলো, হৃদয়েও যদি কোনো পশু থাকে, সেই পশুকে হত্যা করতে হবে, সেটাকে জবাই করতে হবে। হাদিসে আছে, পশু জবাই খোদা তালার নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম; তবে তা ওই ব্যক্তির জন্য যে নিষ্ঠার সঙ্গে কেবল খোদা তায়ালার ভালোবাসায়, খোদার ইবাদাতের উদ্দেশ্যে ইমানসহকারে পশু জবাই করে এমন কোরবানিকে আরবিতে ‘নুসক’ বলা হয়েছে, যার আরেকটি অর্থ অনুগত্য।

আসলে আল্লাহ মানুষের অন্তর দেখেন, কে কোন উদ্দেশ্যে কোরবানি করছে, তা তিনি ভালো করেই জানেন। আসলে মানুষের মধ্যে সব লোভ-লালসা দূর করে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সব পশুত্বকে বিসর্জনের শিক্ষাই হলো কোরবানির শিক্ষা। তাই কোরবানির অন্যতম ধর্মীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের মধ্যে পশুত্বকে হত্যা করে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলা। কাজী নজরুল ইসলাম তার এক কবিতায় বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন- ‘মনের পশুরে করো জবাই/পশুরাও বাঁচে বাঁচে সবাই।’

এই পশু কোরবানি সম্পূর্ণ রূপক। আল্লাহর পথে ত্যাগই ঈদুল আজহার আসল শিক্ষা। আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করে তা মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার মানে দান নয়, তা ত্যাগ। তাই তো কবি নজরুল ‘ঈদজ্জোহা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘চাহি নাকো দুম্বা-উট, কতটুকু দান? ও দান ঝুট। চাই কোরবানি, চাই না দান।’

আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা আল্লাহর নামে কোরবানি করে তাদের জন্য সীমাহীন সওয়াবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। মহানবি (সা.) বিভিন্ন সময় কোরবানির বিষয়ে তার উম্মতকে নসিহত করেছেন। কারও হৃদয়ে যদি এমন ধারণার উদ্রেক হয় যে, প্রতি বছরই তো কোরবানি দিয়ে যাচ্ছি, এবার না হয় দিলাম না- এমনটি চিন্তাভাবনা মোটেও ঠিক নয়। কেননা কোরবানি শুধু একবারের জন্য নয়, বরং তা সারা জীবনের জন্য।

হাদিস থেকে জানা যায়, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘হে লোক সকল! জেনে রাখো, প্রত্যেক পরিবারের পক্ষে প্রতি বছরই কোরবানি করা আবশ্যক’ (আবু দাউদ ও নাসাঈ)। মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য লাভ করে অথচ কোরবানির আয়োজন করেনি, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছে না আসে’ (ইবনে মাজাহ)। হজরত ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসুল করিম (সা.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেছেন এবং বরাবর কোরবানি করেছেন (তিরমিজি)।

মহানবি (সা.) বলেছেন, কোরবানির দিনে কোরবানি করাই সবচেয়ে বড় ইবাদত। কোরবানির জন্তুর শরীরের প্রতিটি পশমের বিনিময়ে কোরবানিদাতাকে একটি করে সওয়াব দান করা হবে। কোরবানির পশুর রক্ত জবাই করার সময় মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায় (মেশকাত)। কোরবানির বিনিময়ে সওয়াব পেতে হলে অবশ্যই কোরবানিটা হতে হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে।

যেভাবে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘কোরবানির জন্তুর রক্ত-মাংস কোনো কিছুই আল্লাহর দরবারে পৌঁছায় না। তার কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের অন্তরের তাকওয়া’ (সুরা আল-হাজ : ৩৭)। অতএব তাকওয়া তথা খোদাভীতি লাভের উদ্দেশ্যেই এ কোরবানি। আর প্রকৃত কোরবানি হলো নিজ আত্মার কলুষতাকে জবাহ করা, আত্মার আমিত্বকে জবাহ করা, আত্মার অহংকারকে জবাহ করা। আসুন, নিজেদের আমিত্বকে শেষ করে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি করি। আমাদের কোরবানি হোক কেবল আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে।

মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা এটাই, হে আল্লাহ! আমাদের এ কোরবানি তুমি গ্রহণ করো আর আমাদের আত্মাকে পবিত্র করো।

সবাইকে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।