উপজেলা নির্বাচন

সংঘাতে জেরবার তৃণমূল আওয়ামী লীগ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৯:৩৯ এএম, ২০ এপ্রিল ২০২৪

আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে এ পর্যন্ত যা কিছু ঘটছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর সহিংস ঘটনা ঘটেছে নাটোরে। নাটোর জেলা নির্বাচন কার্যালয় ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে অপহরণ করে মারধর করে মৃতপ্রায় করে ফেলা হয়েছে সিংড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থী দেলোয়ার হোসেনকে। এর সঙ্গে জড়িত অন্তত ১১ জনের পরিচয় জানা গেছে। ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে স্থানীয় সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা তাঁদের শনাক্ত করেছেন। শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগ যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও শ্রমিক লীগের নেতা-কর্মী।

আসলে তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই নাটোরের সিংড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে নানা শংকার কথা আলোচনায় আসছিল। তফসিলের পর চেয়ারম্যান পদের পাঁচ সম্ভাব্য প্রার্থী গণসংযোগ শুরু করেন। নির্বাচন নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও শুরু হয় আলোচনার ঝড়। কিন্তু কিছুদিন পর হঠাৎ নিরবতা, চুপ হয়ে যান চার সম্ভাব্য প্রার্থী। সেই সঙ্গে কমে যায় নির্বাচন নিয়ে বিশ্লেষণও। মাঠে ঘুরতে থাকেন শুধু এক প্রার্থী– লুৎফুল হাবীব রুবেল। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তাঁর আরেকটি পরিচয়, তিনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ও নাটোর-৩ আসনের এমপি জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক। আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন পাশা শেষ সময়ে এসে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় রুবেলের লোকজন তাঁকে তুলে নিয়ে মারধর করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি এখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁকে তুলে নেওয়ার ঘটনার ভিডিও ফুটেজেও পলক ও রুবেলের ঘনিষ্ঠজনকে দেখা গেছে। এ ঘটনায় মামলার পর রুবেলের দুই অনুসারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এর আগে গত মাসে খোকসায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতার বিরুদ্ধে দলেরই আরেক নেতাকে তুলে নিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরকম ঘটনা ঘটে চলেছে নানা জায়গায়।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলার ভোটেও আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কেউ নেই মাঠে। পাল্টাপাল্টি প্রার্থী হওয়া নিয়ে ক্ষমতাসীনদের ঘরোয়া বিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অনেক স্থানে পরিস্থিতি সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে না এলেও দলটির কিছু নেতা নির্বাচনে অংশ নেবে বলে মনে করা হচ্ছে। এজন্যই আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক দেয়নি। দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ এবার প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়ায় এক উপজেলায় দলীয় পদধারী একাধিক নেতা প্রার্থী হচ্ছেন। পরিস্থিতি সামাল দেয়া দলের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিকে হস্তক্ষেপ না করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এসব নির্দেশনা কোনো কাজে আসছে না। প্রায় সব জায়গায় মন্ত্রী এমপিদের স্বজন ও আর্শীবাদপুষ্টরা নির্বাচনের মাঠে আছেন এবং তারা প্রভাব বিস্তারের অপচেষ্টায় লিপ্ত। উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেওয়া এবং প্রার্থী মনোনয়নে দলের কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ না রাখার কৌশলে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘাত আরও বাড়তে পারে।

দল কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো হস্তক্ষেপ না করায় প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখবে বলে দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলছে। কিন্তু মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অনেকে তাঁদের নিজেদের এলাকায় পছন্দের প্রার্থীর পক্ষ নিচ্ছেন বলে এখনই পরিস্থিতি বেশ সংঘাতময়। এমন পটভূমিতে প্রশাসন কতটা নিরপেক্ষ থাকতে পারবে সেই প্রশ্ন করছে দলীয় লোকজনই।

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করে ভোটার উপস্থিতি দেখাতে দলীয় প্রার্থীর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কৌশল নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু তৃণমূলে তৈরি হয়েছে বিভক্তি এবং অনেক জায়গায় সংসদ সদস্য ও তাঁদের পাল্টা পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। সেই বিভেদের জেরে এখনো কোনো কোনো জায়গায় সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে বিভেদ তৃণমূলে রয়েছে, সেই নির্বাচনের অল্প সময়ের ব্যবধানে উপজেলা নির্বাচন হওয়ায় সংসদ সদস্য ও পাল্টা পক্ষের বিভেদ আরও বাড়ছে।

বলতে গেলে কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কারণ দলে শৃঙ্খলা নেই। নির্বাচন কমিশন প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলায় ৮ মে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। এর আগেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভেদ মাথাচাড়া দিয়েছে।

সব প্রার্থীই চাচ্ছেন স্থানীয় এমপির সুদৃষ্টি লাভ করতে। উন্মুক্ত নির্বাচনে এমপিদের সমর্থন পেলেই নির্বাচিত হওয়া সহজ হবে-এমন ধারণা তাদের। অন্যদিকে বসে নেই এমপি বিরোধী গ্রুপ। তারাও নিজেদের প্রার্থীদের মাঠে নামিয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের লড়াই আবার দৃশ্যপটে সামনে এসেছে। এমন প্রেক্ষাপটে উন্মুক্ত নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

তৃণমূল নেতারা ইতোমধ্যেই নির্বাচনে জয়লাভের জন্য মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা উপজেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চাইছেন। শুধু বর্তমান এমপি না, সাবেক এমপিরাও সক্রিয় তাদের নিয়ন্ত্রণ দরে রাখতে। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে হেরে যাওয়া আওয়ামী লীগ মনোনীত কয়েকজন সংসদ সদস্য প্রার্থী এমপি সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রার্থীদের সমর্থন দিয়ে আবারও মাঠে ফিরতে চাইছেন। এতে সংঘাত বাড়ছে।

বিদ্যমান বিভেদ কমাতে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা সম্প্রতি তৃণমূল নেতা, সংসদ সদস্য এবং স্বতন্ত্র এমপিদের সঙ্গে বিভাগভিত্তিক বৈঠক শুরু করেছেন। কয়েকটি বৈঠকে স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে নিজেদের মতপার্থক্য আরও স্পষ্ট হওয়ায় দলের নেতারা বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। ফলে এই উপজেলা নির্বাচন দলের জন্য আরেক দফা সংঘাত, কোন্দল আর বিষোদগার চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন লিমিটেড।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।