ভোটার খরার উপজেলা নির্বাচন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৯:৪১ এএম, ১১ মে ২০২৪

 

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে গত বুধবার মোট ১৩৯টি উপজেলায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফলাফলও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ফলাফল নিয়ে যে মানুষের খুব আগ্রহ সেটাও মনে হচ্ছে না। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিই প্রমাণ করে যে, নির্বাচন একটি হতে হয় বলে হয়েছে, তবে তা নিয়ে মানুষের কোনো চাঞ্চল্য ছিল না।

বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে হলেও ভোটার উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আওয়াল বলেন, বর্ষা ও ধান কাটার মৌসুম হওয়ায় অপেক্ষাকৃত কম ভোট পড়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নির্বাচনে ৩০-৪০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিকে সন্তোষজনক বলেই উল্লেখ করেন।

শাসক দল খুশি থাকলে তো আর কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু তবুও প্রশ্ন থাকে। স্থানীয় সরকার হলো প্রান্তিক জনগণের একেবারে নিজস্ব নির্বাচন। এসব নির্বাচনে তাদের নিকটজনরা অংশ নেন, নির্বাচিত হন। এসব নির্বাচনের জন্য একটা উৎসব আমেজ থাকে প্রতিটি জনপদে। সেই একটা নির্বাচনে কেন এত কম আগ্রহ মানুষের?

নির্বাচনী পোস্টমর্টেম করে এখন আর লাভ নেই। কারণ যা হওয়ার তাই হয়েছে। এবং দেশে নির্বাচন এমনই হবে আগামীতে। এই নির্বাচনে বিরোধী পক্ষ সেভাবে না থাকায় মানুষের আগ্রহ আর থাকেনি। প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় মানুষ ধরেই নেয় যাকেই ভোট দেই না কেন জিতবে তো এক পক্ষের লোকই।

ব্রিটিশ আমল থেকে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচন হয়ে আসছে নির্দলীয় ভিত্তিতে। তবে ক্ষমতা কাঠামোতে থাকা রাজনৈতিক নেতারা সব সময়ই এসব সংস্থা ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৫ সালের নভেম্বরে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন-সংক্রান্ত পাঁচটি আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। এক্ষেত্রে বিরোধী দল ও স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞদের বিরোধিতাকে আমলে নেওয়া হয়নি।

এবার আওয়ামী লীগ এই দলীয় প্রতীকের বিধান রহিত না করে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ না করার সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করতে যেমন করে দলটি গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দের পাশাপাশি দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও উৎসাহিত করেছে নির্বাচন করতে। এতে নির্বাচন কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে, সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিতর্ক নেই তৃণমূলে দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার বিষয়ে।

নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রায় সব কটি সংঘাত হয়েছে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। নির্বাচনের জেরে এখনো অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগের কর্মী–সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই নির্বাচনেও দলের সাধারণ সম্পাদক বারবার সনির্বন্ধ অনুরোধ করার পরও মন্ত্রী এমপিরা স্বজনদের নির্বাচনী মাঠ থেকে সরিয়ে না নিয়ে আরেক দফা প্রমাণ দিলেন যে, শাসক দলে দলীয় শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই।

আমাদের সংবিধানে স্থানীয় স্বশাসনের কথা বলা হলেও কোনো সরকারই স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়নি। এই যখন বাস্তবতা তখন একতরফা এবং একচ্ছত্র ভোটার খরার নির্বাচন করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকেই কার্যত অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলা হচ্ছে। কারণ স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে স্থানীয় জনগণের আকাঙ্ক্ষার চেয়ে দলীয় রাজনীতিই প্রাধান্য পেয়েছে।

দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন চালু হওয়ার পর কেবল সংঘাত-প্রাণহানিই বাড়েনি; সামাজিক সম্পর্কগুলো ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আগে স্থানীয় নির্বাচনের পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা ঝগড়া-বিবাদ ভুলে জনগণের সমস্যা সমাধানে একযোগে কাজ করতেন। এখন জয়ী কিংবা পরাজিত উভয় প্রার্থীর কাছে জাতীয় রাজনীতিই অগ্রাধিকার পায়, উপেক্ষিত থাকে স্থানীয় সমস্যা। এবার প্রতীক ছিল না, কিন্তু প্রায় সবাই যে একই দলের তাতে এলাকায় এলাকায়, জনপদে জনপদে বিবাদ, বিদ্বেষ আর শত্রুতাও সেভাবে দৃশ্যমান হয়েছে বা হচ্ছেও।

ব্যবসা আর ক্ষমতার রাজনীতি যখন একে অন্যের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে তখন এটাই স্বাভাবিক যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক রাজনীতিটাও ব্যবসায়ীদের হাতেই চলে যাবে। এবার প্রথম পর্বের প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে টিআইবি দেখিয়েছে ৭০ শতাংশই ব্যবসায়ী। ফলে এসব ব্যক্তি কি নির্বাচন করছেন জনগণের কল্যাণ সাধনের জন্য? মোটেও তা নয়। করছেন আধিপত্য আর ক্ষমতা চর্চার জন্য।

কেন্দ্রীয় রাজনীতিবিদরা এবং ধনিক শ্রেণির লুটেরা লোকরা স্থানীয় নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে বা অংশগ্রহণ করে স্থানীয় সরকারের কাঠামো বিনষ্ট করেছেন। স্থানীয় নেতাদের দক্ষতা ও ভাবনা ভূলুণ্ঠিত করেছেন। আইনে বলা আছে, এসব প্রতিষ্ঠান হচ্ছে স্বশাসিত। কিন্তু আসলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় হচ্ছে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদসমূহের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ। এই মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক কারণে যে কোনো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করতে পারে।

জাতীয় রাজনীতি স্থানীয় সরকারসমূহকে প্রভাবিত করায় মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না। এলাকাভিত্তিক প্রতিভাও বিকশিত হবে না। স্থানীয় সরকারের সব সংস্থার নির্বাচন পুরোপুরি নির্দলীয় পদ্ধতিতে হওয়া উচিত। অন্যথায় আগামীতে আরও ভোটার খরা দেখতে হবে এসব নির্বাচনে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও সমাজ বিশ্লেষক।

এইচআর/ফারুক/এমএস

দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন চালু হওয়ার পর কেবল সংঘাত-প্রাণহানিই বাড়েনি; সামাজিক সম্পর্কগুলো ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আগে স্থানীয় নির্বাচনের পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা ঝগড়া-বিবাদ ভুলে জনগণের সমস্যা সমাধানে একযোগে কাজ করতেন। এখন জয়ী কিংবা পরাজিত উভয় প্রার্থীর কাছে জাতীয় রাজনীতিই অগ্রাধিকার পায়, উপেক্ষিত থাকে স্থানীয় সমস্যা। এবার প্রতীক ছিল না, কিন্তু প্রায় সবাই যে একই দলের তাতে এলাকায় এলাকায়, জনপদে জনপদে বিবাদ, বিদ্বেষ আর শত্রুতাও সেভাবে দৃশ্যমান হয়েছে বা হচ্ছেও।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।