কাঁচা হাতের নাটক


প্রকাশিত: ০৪:৩৩ এএম, ০১ জুন ২০১৬

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র মেন্দি এন সাফাদি। এই লোক ইসরাইলের ক্ষসতাসীন লিকুদ পার্টির নেতা। ভারতে তার সাথে ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক করার অভিযোগে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী এখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ মাথায় নিয়ে কারাভোগ করছেন। আসলাম চৌধুরী মেন্দি এন সাফাদির সাথে বৈঠক করেছেন, এটা প্রমাণিত সত্য এবং সেটা হুট করে দেখা হয়ে যাওয়ার বিষয় নয়। সাফাদির সাথে আসলাম চৌধুরীর বৈঠক, ডিনার, ঘোরাঘুরির প্রচুর ছবি ভার্চুয়াল জগতে সবাই দেখেছেন। গণমাধ্যমেও ছাপা বা প্রচারিত হয়েছে সে ছবি। আসলাম চৌধুরীও বৈঠকের কথা অস্বীকার করেননি। তবে সে বৈঠকে ষড়যন্ত্র হয়েছিল কিনা তা আদালতে প্রমাণসাপেক্ষ।

ষড়যন্ত্র হোক আর না হোক শত্রু রাষ্ট্র ইসরাইলের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদধারীর বৈঠকটাই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে আদালতের দৃষ্টিতে যাই হোক, ইসরাইলের সাথে দলের একজন পদস্থ নেতার বৈঠকটাই বিএনপির মত একটি জনপ্রিয় দলের ভাবমূর্তির জন্য মারাত্মক হুমকির। বিএনপির উচিত ছিল, তাৎক্ষণিকভাবে তাকে বহিষ্কার করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা। কিন্তু তাতো হয়ইনি। উল্টো বিএনপি নেতারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আসলাম চৌধুরীকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করছে। সাফাদির সাথে বৈঠকের খবর ফাঁস হওয়ার পর, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আসলাম চৌধুরী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করেছেন। আসলাম চৌধুরী নিজেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে রহস্য চরিত্র। সাফাদির সাথে বৈঠকের আগে চট্টগ্রামের এই আঞ্চলিক নেতা বাংলাদেশে খুব পরিচিত ছিলেন না। আঞ্চলিক রাজনীতি থেকে তার হঠাৎ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

আসলাম চৌধুরীকে বহিষ্কারের জরুরি কাজটি না করে বিএনপি পাল্টা ষড়যন্ত্র শুরু করে। দুদিন আগে হঠাৎ করে ইউটিউবে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। একই দিনে বিবিসি বাংলাও একটি নিউজ করে। সেই ভিডিও এবং বিবিসির নিউজের অভিন্ন ভাষ্য, প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়ের সাথে ওয়াশিংটনে মেন্দি এন সাফাদির বৈঠক হয়েছে। প্রথমে মনে হয়, বিএনপির দারুণ পাল্টা আঘাত। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে বিএনপির ঘাড় থেকে পুরো দায়টা চলে যাবে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে। বিবিসির মত গণমাধ্যম নিউজ করেছে, তাই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ছিলেন সবাই। কিন্তু সজিব ওয়াজেদ জয় তার ফেসবুক পেজে দাবি করেছেন, মেন্দি এন সাফাদি মিথ্যা বলছেন। তার সাথে কোনো বৈঠক হয়নি।

জয় তার স্ট্যাটাসে বলেছেন, বিএনপি এমনই বোকার দল, এমনকি তারা যখন মিথ্যা বলে তখনও বোকামিপূর্ণ। জয় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেই তা বিশ্বাস করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। জয়ের অনেক স্ট্যাটাসের সাথে আমার ভিন্নমত আছে। কিন্তু সাফাদির সাক্ষাতকারটি দেখার পর আমার সংশয় কেটে যায়। সজিব ওয়াজেদ জয়ের আত্মবিশ্বাসেই ভরসা করি। জ্যাকব মিল্টনের নেয়া সাফাদির যে সাক্ষাৎকারটি ইউটিউবে পোস্ট করা হয়েছে, যেখানে তিনি প্রথম সজিব ওয়াজেদ জয়ের সাথে সাক্ষাতের দাবি করেছেন, তা ছিল সাজানো এবং খুবই কাঁচা হাতের কাজ। এই পুরো নাটকটি সাজিয়েছেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা জাহিদ এফ সরদার সাদি। এই উপদেষ্টা বিএনপির বন্ধু না শত্রু সেটা বিবেচনা করে দেখার সময় চলে এসেছে। এর আগে এই বন্ধুবেশী শত্রু মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের স্বাক্ষর জাল করে বিবৃতি দিয়ে বিএনাপিকে বিপাকে ফেলেছিল।

মেন্দি এন সাফাদি যে আসলাম চৌধুরীর সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমেই বাংলাদেশ বিষয়ে সম্পৃক্ত হয়েছেন, তা নয়। তিনি অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। বাংলাদেশের সরকার উৎখাতের চেষ্টা করছেন। একবছর আগে দেয়া এক সাক্ষাৎকারেই তিনি তার লক্ষ্য পরিষ্কার করে দিয়েছেন। একজন মি. রহমানের সাথে বৈঠকের কথাও বলেছেন। তো বাংলাদেশের রাজনীতি যিনি এত ঘনিষ্ঠভাবে এতদিন ধরে ফলো করছেন, তিনি সজিব ওয়াজেদ জয়কে চেনেন না, এটা অবিশ্বাস্য। আর না চিনেই তিনি বাংলাদেশের একজন উচ্চপর্যায়ের কারো সাথে বৈঠক করে ফেলেছেন, এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। অথচ সেই সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেছেন, দুই মাসের কিছু বেশি সময় আগে ওয়াশিংটনে সজিব ওয়াজেদ জয় নামের একজনের সাথে তার বৈঠক হয়েছে।

সজিব ওয়াজেদ জয়ের নাম শুনে উপস্থাপক জ্যাকব মিল্টন এমনভাবে আঁতকে উঠেন, দেখে হাসি চেপে রাখা দায়। সাথে সাথে পেছনের পর্দায় জয়ের ছবি দেখিয়ে, এই ব্যক্তিই সেই ব্যক্তি কিনা, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা দেখে বোঝা যায়, পুরো বিষয়টি সাজানো। তবে কাজটি খুব কাঁচা হাতের। সেই সাক্ষাৎকারের অফ দ্য রেকর্ড ছবিতে দেখা যায় পাশেই বসে আছেন জাহিদ এফ সরদার সাদি। নিউইয়র্কের একটি টিভি স্টেশনে এই নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। প্রবাসী দুয়েকজন সাংবাদিকও নাকি এই নাটকের পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন। সজিব ওয়াজেদ জয়ের সাথে যদি সাফাদির বৈঠক হবেই, তাহলে এতদিন তিনি তা বলেননি কেন? এখন আসলাম চৌধুরীকে বাঁচাতেই সাফাদি বিএনপির হয়ে এই নাটকে অভিনয় করতে সম্মত হয়েছেন, তা বুঝতে পণ্ডিত হতে হয় না।

তবে সবচেয়ে বাজে কাজটি করেছে বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যম বিবিসি। তারাও সাফাদির সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তার সাথে জয়ের বৈঠকের সংবাদ প্রচার করে। এই নিউজের জন্য যে সজিব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্য নেয়াটা সাংবাদিকতার ন্যূনতম মান, এটা বোধহয় ভুলেই গিয়েছিল বিবিসি। ইউটিউবে সেই নাটকের ভিডিও যতটা বিভ্রান্তি ছড়াতে পেরেছিল, বিবিসির নিউজ সেই বিভ্রান্তির পালে হাওয়া দিয়েছে। বিবিসির বিশ্বাসযোগ্যতা অনেকদিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ। এই নিউজের পর তা আরো প্রকট হলো। জয় তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, এ ঘটনা সংবাদের উৎস হিসেবে বিবিসির বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ভিডিও সাক্ষাৎকারে সাফাদি দাবি করেছেন, জয়ের সাথে তার বৈঠক হয়েছে দুই মাস আগে। আর বিবিসিকে বলেছেন, গতবছরের শেষ দিকে। একই দিনে একই ব্যক্তির এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য তার মিথ্যাকেই আরো নিশ্চিত করে।

সজিব ওয়াজেদ জয় সাফাদির সাথে বৈঠক করতেই পারেন না বা কোনো ভুল করতে পারেন না, এমনটা আমি দাবি করছি না। বরং বিভিন্ন সময়ে তার অনেক বক্তব্য আর আচরণের সমালোচনা করেছি আমি। বিশেষ করে সব বিষয়েই আগ বাড়িয়ে প্রতিক্রিয়া জানানোটা বাড়াবাড়ি মনে হয়। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি প্রায়ই, অমুক পত্রিকা বর্জন করুন, অমুককে আনফ্রেন্ড করুন; এ ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল আহ্বান জানান। যা শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয় না। আওয়ামী লীগের মত বড় দলের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নেতার প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষেত্রে, আহ্বান জানানোর ক্ষেত্রে আরো সংযমী হওয়া উচিত।

বিএনপিও জানে যে জয়ই ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন। তাই তারা জয়ের বিরুদ্ধে নানা প্রচারণা চালায়। রাজনীতিতে প্রচারণাটা দোষের নয়, দোষের হলো অপপ্রচার। জয় সম্পর্কে তথ্য জোগার করতে এফবিআই এজেন্টকে ঘুষ দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কারাভোগ করছেন বিএনপির এক নেতার ছেলে রিজভি আহমেদ সিজার। একই মামলায় বাংলাদেশে কারাভোগ করছেন প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমান। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নিজে জয়ের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগ এনেছেন। জয় এই অভিযোগ চ্যালেঞ্জ করেছেন। রাজনীতিতে কাদা ছোড়াছুড়ি বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। তবে অভিযোগের মধ্যে সামান্য হলেও সত্যতা থাকতে হবে। নিছক রাজনৈতিক কারণে কাউকে টেনে নামাতে চাইলে তা সফল হবে না। যেমন মানুষ খায়নি সাফাদি-জয় বৈঠকের নাটক।

৩১ মে ২০১৬

Provash-Amin

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।