হাদির জানাজায় নিযুত প্রাণের একাত্মতা

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশিত: ১১:২৩ এএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫

কিছু মৃত্যু মানুষের জীবনাবসান ঘটালেও তা হয়ে ওঠে একটি সময়, একটি চেতনা ও একটি জাতির সম্মিলিত অনুভবের প্রতীক। গত ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫ ঢাকায় মরহুম শরীফ ওসমান বিন হাদির জানাজায় নিযুত মানুষের উপস্থিতি তেমনই এক গভীর বার্তা বহন করে যেখানে শোক ব্যক্তিগত ছিল না। পরিবার সতীর্থদের কান্না হয়ে উঠেছিল জাতীয় প্রত্যয় এবং যেখানে বিভক্ত সমাজও এক মুহূর্তের জন্য হলেও এক কাতারে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেছিল তার আত্মার মাগফেরতের জন্য।

ওসমান হাদি ছিলেন মাঠে-ঘাটে, মঞ্চে-আন্দোলনে, মানুষের সুখ-দুঃখে মিশে থাকা এক সংগ্রামী তরুণ মুখ। তাঁর জীবন ছিল স্পষ্ট উচ্চারণে ভরা। ন্যায়, প্রতিবাদ ও মানবিকতার পক্ষে। তাই তাঁর জানাজায় মানুষের ঢল কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। এটি ছিল ভালোবাসা ও সম্মানের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ।

দেশের বর্তমান বাস্তবতায় আমরা প্রায়ই দেখি মতাদর্শিক বিভাজন, রাজনৈতিক মেরুকরণ ও সামাজিক দূরত্ব। কিন্তু ওসমান হাদির জানাজায় সেই চেনা বিভাজনের রেখাগুলো যেন মুহূর্তের জন্য হলেও মুছে গিয়েছিল। ভিন্ন মতের মানুষ, ভিন্ন পেশা ও বয়সের নাগরিক। সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে দোয়া করেছেন। এই দৃশ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সংকট ও শোকের মুহূর্তে জাতি এখনো এক হতে পারে, যদি উপলক্ষটি হয় সত্যিকারের মানুষের জন্য।

কিছুদিন পূর্বে ওসমান হাদি এক সভায় বলেছিলেন গণভোটের কথা। গত ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫ ঢাকায় ওসমান হাদির জানাজা ছিল একটি নীরব গণভোট। তার জানাজায় মানুষের যে অভূতপূর্ব উপস্থিতি দেখা গেছে, তা তেমনই এক নীরব অথচ উচ্চকণ্ঠ বার্তা বহন করে। তেমন কোনো মাইক ছিল না, কোনো ব্যানার বা পোস্টারও ছিল না। তবু সেই জানাজা ছিল একটি নীরব গণভোট, যেখানে মানুষ তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে নিঃশব্দ সম্মতিতে।

তাই সংসদের দক্ষিণ প্লাজার ওসমান হাদির শেষসভা অর্থাৎ, এ জানাজা ছিল নীরব অথচ প্রতিবাদী এক গণজমায়েত। যেখানে মানুষ মতামত দিয়েছে চরিত্রের পক্ষে, সাহসের পক্ষে, নৈতিক অবস্থানের পক্ষে। ওসমান হাদি হয়তো রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন না, কিন্তু মানুষের হৃদয়ে তিনি যে জায়গা করে নিয়েছিলেন, তা তাঁর জানাজার ভিড়েই স্পষ্ট। এটি প্রমাণ করে, জনপ্রিয়তা কেনা যায় না; তা অর্জন করতে হয় দীর্ঘদিনের সততা ও ত্যাগের মাধ্যমে।

একই সঙ্গে এই নীরব গণভোট একটি অস্বস্তিকর প্রশ্নও তোলে। জীবদ্দশায় ওসমান হাদির কণ্ঠ কতটা গুরুত্ব পেয়েছে? তাঁর মতো মানুষদের কি আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি, নাকি মৃত্যুর পরই তাদের মূল্য বুঝতে শিখি? যদি জীবিত অবস্থায়ই তাঁর কথা শোনা হতো, তবে কি আজ এই জানাজা অন্যরকম হতো?

এই গণজমায়েত আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বের জন্যও একটি শিক্ষা। জনগণ কেবল স্লোগান বা প্রতিশ্রুতি নয়, তারা খোঁজে বিশ্বাসযোগ্যতা। যারা জীবদ্দশায় মানুষের পাশে দাঁড়ান, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং ভয়কে অগ্রাহ্য করে নৈতিক অবস্থান নেন, মৃত্যুর পর মানুষ তাদের একা পরপারে যেতে দেয় না। প্রাণভরা দোয়া দিয়ে ঝুলি ভরে দেয়।

ওসমান হাদি হয়তো জানতেন, তাঁর এই পথ সহজ নয়। তবু তিনি উচ্চারণ করেছিলেন এমন একটি বাক্য, যা আজ তাঁর মৃত্যুর পর আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কারণ তিনি আমাদের সামনে একটি আয়না মেলে ধরেছেন। আমরা কি এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে ভালো মানুষদের জীবন জাহান্নাম হয়, নাকি এমন দেশ গড়তে চাই, যেখানে তাদের আত্মত্যাগ প্রয়োজন হলেও নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত থাকে?

ওসমান হাদির জানাজা তাই বিদায়ের আয়োজন পেরিয়ে একটি দোয়া দেবার আয়োজনে একজন দেশপ্রেমিক দেখার আয়নায় রূপ নিয়েছিল। যেখানে আমরা আমাদের জাতিগত সম্ভাবনাকে দেখতে পাই। কথা হলো, এই একাত্মতা কি আমরা কেবল মৃত্যুর পরেই অনুভব করব, নাকি জীবনের লড়াইয়েও তা ধরে রাখতে পারব? বিভাজনের রাজনীতি ছেড়ে কি আমরা মানুষকেই মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে শিখব?

ওসমান হাদি রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা কোনো ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন মানুষের পাশে থাকা এক নির্ভীক কণ্ঠ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান, সুবিধাবাদের রাজনীতির বাইরে থাকা এবং সত্য বলার সাহস, এই গুণগুলোই তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। তাঁর জানাজায় মানুষের ঢল প্রমাণ করে, ক্ষমতার আসন নয়, মানুষের আস্থা-ভালোবাসাই শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পুঁজি।

এই জানাজায় কোনো দলীয় পরিচয় মুখ্য ছিল না। রাজনৈতিক বিভাজন, মতাদর্শের দূরত্ব ও সামাজিক শ্রেণিভেদ যেন সেই মুহূর্তে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল। একই কাতারে দাঁড়িয়েছিলেন ভিন্ন মতের মানুষ, তরুণ ও প্রবীণ, শ্রমজীবী ও শিক্ষিত নাগরিক। এই দৃশ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জাতি যখন সত্যিকারের ভালবাসা নিয়ে মানুষের মুখোমুখি হয়, তখন বিভাজন আপনাআপনি ঝরে পড়ে।

এই জনসমাগম আমাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। আজকের বাংলাদেশে যেখানে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন, আস্থার সংকট ও অংশগ্রহণের ঘাটতির কথা উঠে আসে, সেখানে এই জানাজা দেখিয়ে দিল মানুষ এখনো নীরবে হলেও মত প্রকাশ করতে জানে। তারা সুযোগ পেলে নৈতিকতার পক্ষে দাঁড়ায়।

ওসমান হাদির জানাজা তাই শুধু শোকের আয়োজন পেরিয়ে সমাজের বিবেকের এক মুহূর্তিক জাগরণ তৈরী করেছিল। এই নীরব গণভোট আমাদের সামনে একটি স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ রেখে গেছে তা হলো, আমরা কি এই জনতাকে শ্রদ্ধা জানাব, নাকি আবারও ক্ষমতা ও সুবিধাবাদের কোলাহলে তা চাপা পড়ে যাবে? ইতিহাসের পাতায় এই জানাজা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে, মানুষ চুপ থাকলেও তাদের বিচার কখনো থেমে থাকে না।

কিছুদিন পূর্বে ওসমান হাদি আরো এক সভায় বলেছিলেন, ’প্রয়োজনে নিজের জীবনকে জাহান্নাম বানিয়ে বাংলাদেশকে জান্নাত বানাব’। ওসমান হাদির সেই উচ্চারণ কেবল কথার সৌন্দর্য না হয়ে তা হয়ে ওঠেছে একজন মানুষের জীবনের সারসংক্ষেপ হিসেবে। হাদির এই উচ্চারণ কোনো আবেগী স্লোগান ছিল না। এটা ছিল এক নির্ভীক প্রতিজ্ঞা, যা তিনি নিজের জীবন দিয়েই সত্যে পরিণত করার চেষ্টা করেছেন। এই বাক্যে যেমন আত্মত্যাগের সাহস আছে, তেমনি আছে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতার প্রকাশ।

ওসমান হাদির জীবন ছিল আরাম ও নিরাপত্তার বাইরে, ছিল সংঘাত, চাপ, অবহেলা ও ঝুঁকির। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা, সুবিধাবাদের রাজনীতির বাইরে থাকা এবং মানুষের অধিকার নিয়ে আপসহীন অবস্থান নেওয়া, এসবের মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছে প্রতিদিন। তবু তিনি পিছু হটেননি। কারণ তাঁর কাছে ব্যক্তিগত স্বস্তির চেয়ে দেশের কল্যাণ ছিল বড়।

আজকের বাংলাদেশে, যেখানে অনেকেই রাজনীতি বা সামাজিক নেতৃত্বকে ব্যক্তিস্বার্থের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে, সেখানে ওসমান হাদির উচ্চারণ আমাদের জন্য অস্বস্তিকর হলেও প্রয়োজনীয়। তিনি মনে করিয়ে দেন, দেশ গড়া মানে কেবল উন্নয়নের পরিসংখ্যান নয়, বরং ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা। নিজের জীবনকে ‘জাহান্নাম’ বানানোর অর্থ আত্মবিনাশও নয়। বরং তা ছিল স্বার্থত্যাগ, নির্ঘুম রাত এবং ভয়কে জয় করার প্রস্তুতি।

তাঁর এই বক্তব্য তরুণ প্রজন্মের জন্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে দেশপ্রেম প্রায়ই সীমাবদ্ধ থাকে স্ট্যাটাস আর শেয়ারে। কিন্তু ওসমান হাদি দেখিয়েছেন, দেশপ্রেমের আসল পরীক্ষা আসে তখনই, যখন তা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, সুযোগ-সুবিধা ও জনপ্রিয়তার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। তখন কতজন দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? এই প্রশ্নটাই তিনি রেখে গেছেন।

তবে এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও উঠে আসে। একটি রাষ্ট্র কি তার সৎ ও সাহসী সন্তানদের জীবনকে ‘জাহান্নাম’ বানাতে বাধ্য করবে? একজন নাগরিককে কেন দেশের জন্য কথা বলতে গিয়ে ভয়, নিপীড়ন বা বঞ্চনার মুখোমুখি হতে হবে? ওসমান হাদির বক্তব্য আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার এই ব্যর্থতাকেও সামনে আনে, যেখানে ন্যায় ও সততার পথ এখনো কণ্টকাকীর্ণ।

ওসমান হাদি হয়তো জানতেন, তাঁর এই পথ সহজ নয়। তবু তিনি উচ্চারণ করেছিলেন এমন একটি বাক্য, যা আজ তাঁর মৃত্যুর পর আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কারণ তিনি আমাদের সামনে একটি আয়না মেলে ধরেছেন। আমরা কি এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে ভালো মানুষদের জীবন জাহান্নাম হয়, নাকি এমন দেশ গড়তে চাই, যেখানে তাদের আত্মত্যাগ প্রয়োজন হলেও নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত থাকে?

হাদির বক্তব্য তাই কেবল একজন দু:সাহসী মানুষের অঙ্গীকার হতে পারে না। এটি আমাদের সবার প্রতি একটি নৈতিক চ্যালেঞ্জ। আমরা কি তাঁর এই আত্মত্যাগের দর্শন থেকে শিক্ষা নেব, নাকি এটিকে আরেকটি আবেগী বাক্য হিসেবেই ভুলে যাব? বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই এই উত্তরের ওপর নির্ভর করছে।

ওসমান হাদি ঘাতকের গুলিতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন, কিন্তু তাঁর জানাজায় নিযুত মানুষের উপস্থিতি বলে দেয় একজন সৎ ও সাহসী মানুষের প্রভাব মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয় না। বরং তা ছড়িয়ে পড়ে মানুষের বিবেকজুড়ে। এই জাতীয় একাত্মতা যদি আমরা সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমস্বরে ধারণ করতে পারি, তবেই তাঁর বিদায় সত্যিকার অর্থে আমাদের জন্য একটি জাতীয় শিক্ষায় রূপ নেবে।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।