নিয়মের ঘেরাটোপে মানবিকতা পরাজিত

মেয়েটি কি এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারবে?

মাহফুজা অনন্যা
মাহফুজা অনন্যা মাহফুজা অনন্যা , লেখক
প্রকাশিত: ১২:১৫ পিএম, ২৭ জুন ২০২৫

ভোরবেলা উঠেই পরীক্ষা প্রস্তুতির ব্যস্ততা। এইচএসসি পরীক্ষার দিন বলে কথা। লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর মতোই এক কিশোরীও প্রস্তুত ছিল নিজের ভবিষ্যতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় লিখে আসতে। কিন্তু ঠিক তখনই তার জীবনের পাথেয় হঠাৎ হুমকির মুখে—তার মা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে পড়ে যান অচেতন অবস্থায়।

আত্মীয়পরিজন কেউ নেই আশেপাশে। মেয়েটিই একা। কাঁপা হাতে মাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ভর্তি করায়, চিকিৎসা নিশ্চিত করে। তারপর ছুটে আসে পরীক্ষা কেন্দ্রে—হয়তো কিছুটা দেরি নিয়ে, কিন্তু আগ্রহ আর দায়িত্ববোধে বিন্দুমাত্র ঘাটতি না রেখে। আর ঠিক সেখানেই ঘটে ‘ব্যবস্থাগত অমানবিকতার’ একটি জীবন্ত উদাহরণ। পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা শিক্ষক তাকে জানিয়ে দেন—”তুমি দেরি করেছো, প্রশ্নপত্র বিতরণ হয়ে গেছে, নিয়ম অনুযায়ী তোমাকে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া যাবে না!”

নিয়মের কাছে মানবিকতা পরাজিত! শুধু একটি মেয়ে নয়, আমরা হারালাম একটি নৈতিক সম্ভাবনা। আমরা প্রত্যক্ষ করলাম—কীভাবে মানুষের বিপদের মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুনের কঠোর দেয়াল মানবিকতাকে থামিয়ে দিতে পারে।

একটি মেয়ের কাহিনি হয়তো খবর। কিন্তু তার পেছনে আছে আমাদের সমাজের আয়না। আমরা কেমন সমাজ চাই? যেখানে নিয়মে জড়ানো কঠিন মুখ, না কি সহানুভূতির স্পর্শে উন্মুক্ত ভবিষ্যৎ? সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার। সময় এসেছে নিয়ম আর মানবিকতার মধ্যে সেতুবন্ধনের।

এমন কঠিন কী ছিল একটু মানবতা দেখানো? পরীক্ষা শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক মিনিট, শিক্ষার্থীটির অনুপস্থিতির কারণ পরিষ্কার—এমন অবস্থায় কি একজন শিক্ষক বা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া যেত না? বলা হয়—"নিয়ম তো নিয়ম!" হ্যাঁ, কিন্তু প্রতিটি নিয়মের পেছনে থাকে একটি উদ্দেশ্য। আর সেই উদ্দেশ্য যদি মানুষের উপকার না করে, বরং তার ক্ষতিই করে—তবে সে নিয়ম নিজেই অমানবিক হয়ে ওঠে, নয় কি?

বাংলাদেশে প্রতি বছর লাখো শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে অনেকেই নানা সংকট, সামাজিক প্রতিকূলতা, আর্থিক অসুবিধা কিংবা পারিবারিক সমস্যার মধ্যে দিয়েও পরীক্ষাকেন্দ্রে আসে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়মের কাঠামো কি এমন সব পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত? এমন কোনো নীতিমালা কি আছে, যেখানে মানবিক পরিস্থিতিকে বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া যায়?

এইচএসসি পরীক্ষার মতো জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক কিশোরীর জন্য দিনটি ছিল দুঃস্বপ্নের। তার মা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকেন। জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষটিকে বাঁচাতে সে ছুটে যায় হাসপাতালে। চিকিৎসা সেবার তদারকি শেষে, দৌড়ে ফিরে আসে পরীক্ষাকেন্দ্রে — কিন্তু ততক্ষণে প্রশ্নপত্র বিতরণ হয়ে গেছে, এবং হলের শিক্ষক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দিয়ে তাকে ফিরিয়ে দেন।

এই ঘটনাটি ঘটে ঢাকার উপকণ্ঠে একটি কলেজে। মেয়েটি স্থানীয়ভাবে পরিচিত একজন মেধাবী ছাত্রী। তার সহপাঠীদের মতে, সে সবসময় দুঃসময়েও হাসিমুখে লড়ে গিয়েছে। কিন্তু মায়ের অসুস্থতা ও পরীক্ষার দিন এই অমানবিক আচরণ তার মনোবলকে চূর্ণ করে দেয়। জানা যায়, সকালেই তার মা হঠাৎ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। পরিবারের আর কেউ ছিল না, তাই মেয়েটি নিজেই মাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। সময় মতো পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছালেও কিছু মিনিট দেরি হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাকে প্রবেশ করতে দেয়নি।

একজন পরীক্ষার হল-শিক্ষক মন্তব্য করেন, "নিয়ম তো নিয়মই, প্রশ্নপত্র বিতরণের পর কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া যায় না।"

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় — মানবিকতা কি নিয়মের ঊর্ধ্বে নয়? একজন কিশোরী যখন নিজের মা ও নিজের ভবিষ্যৎকে একসাথে বাঁচাতে যুদ্ধ করে, তখন কি কিছু ব্যতিক্রম হওয়া উচিত ছিল না?

jagonews24

এই ধরনের পরিস্থিতিতে ‘নিয়ম’ প্রয়োগে নমনীয়তা প্রয়োজন। কারণ শিক্ষা শুধু নিয়ম নয়, মানবিকতারও চর্চা শেখায়।

এখন প্রশ্ন হলো মেয়েটি কি এই বছরের পরীক্ষার সুযোগ হারাবে? কী হবে তার ভবিষ্যৎ? শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কি এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া উচিত নয়?

এই একটি ঘটনার পেছনে আছে হাজারো অনুরূপ ব্যথার কাহিনি। আমরা কি কেবল নিয়মের দাস হবো, না কি নিয়মের ভেতরে মানবিকতার সুর সৃষ্টি করবো — এই প্রশ্ন এখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

এই মেয়েটির গল্প হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে খবরের ভিড়ে। কিন্তু আমরা যদি এটাকে উপলব্ধির জায়গা না বানাই, তবে ভবিষ্যতে আরও অনেক শিক্ষার্থী একই দুর্ভাগ্যের শিকার হবে।

শিক্ষা কি শুধু নিয়ম নাকি মূল্যবোধও শেখায়? শিক্ষা মানুষ গড়ার মাধ্যম। কিন্তু সেই শিক্ষা যদি মানুষের সংকটে পাশে না দাঁড়ায়, তবে তার অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। একজন শিক্ষকের ভূমিকা কেবল প্রশ্নপত্র দেখা বা সময় হিসাব করা নয়—তার কাছে শিক্ষার্থীরা আশ্রয় খোঁজে, পথ খোঁজে, সহানুভূতি খোঁজে।

যে শিক্ষক মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিলেন, হয়তো তিনি নিয়ম মেনেছেন। কিন্তু তিনি কী শিক্ষার মর্মবাণী রক্ষা করতে পেরেছেন? এখন, শোনা যাচ্ছে, মেয়েটিকে নাকি নতুন করে বিগত পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, তার জন্য এখনই শিক্ষা বোর্ড, মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত জরুরি নীতিমালা প্রণয়ন করা। প্রতিটি পরীক্ষাকেন্দ্রে ‘মানবিক বিবেচনার জন্য একটি স্বতন্ত্র কমিটি’ রাখা যেতে পারে, যারা বিশেষ পরিস্থিতিতে পরীক্ষা দিতে সুযোগ দেবে।

একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ কেবল ঘড়ির কাঁটা দিয়ে মাপা উচিত নয়। তার জীবনের পরিস্থিতি, সংকট, লড়াই সবই বিবেচনায় নিতে হবে।

একটি মেয়ের কাহিনি হয়তো খবর। কিন্তু তার পেছনে আছে আমাদের সমাজের আয়না। আমরা কেমন সমাজ চাই? যেখানে নিয়মে জড়ানো কঠিন মুখ, না কি সহানুভূতির স্পর্শে উন্মুক্ত ভবিষ্যৎ?

সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার। সময় এসেছে নিয়ম আর মানবিকতার মধ্যে সেতুবন্ধনের।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।