উৎপাদন ও মজুদ পর্যাপ্ত, তবুও চালের দাম কেন বাড়ছে?

ইয়াহিয়া নয়ন
ইয়াহিয়া নয়ন ইয়াহিয়া নয়ন , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৩২ এএম, ১১ আগস্ট ২০২৫

দেশের বাজারে প্রতিনিয়তই বাড়ছে চালের দাম। সম্প্রতি খুচরা পর্যায়ে কেজিতে চালের দাম পাঁচ টাকা থেকে আট টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। কোনোভাবেই বাগে আনা যাচ্ছে না চালের বাজার। উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়া, হাট-বাজার-সড়কে অব্যাহত চাঁদাবাজি, আমদানি করা চাল না আসা, সরকারের সংগ্রহ টার্গেট ফেল করা, কয়েক স্তরে হাতবদল, সরকারি মজুত কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অব্যাহতভাবে বাড়ছে চালের দাম। এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এখানে আমার একটা কথা আছে, সরকার প্রতিবছর উৎপাদন এবং মজুদের যে পরিমাণটা দেয় তা কি সঠিক? আমারতো মনে হয় মূল ঘাপলাটা এখানেই।

চলতি মৌসুমে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারের কাছেও চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। দেশে বছরে চালের চাহিদা ৩ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৮০ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে রেকর্ড ২ কোটি ১৪ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছে। একই সঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুদ ২১ লাখ ৪৩ হাজার ১৮৭ টন। এর মধ্যে ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ৬২৪ টন চাল ও ১ লাখ ১ হাজার ৫৩০ টন ধান মজুদ রয়েছে। সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, উৎপাদন ও মজুদের দিক থেকে চালের তেমন ঘাটতি নেই। তার পরও তিন মাস ধরে অর্থাৎ বোরোর ভরা মৌসুমেই চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। প্রশ্ন হচ্ছে, উৎপাদন ও মজুদ পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও চালের দাম কেন বাড়ছে? বাজার ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের তথ্যগত অসংগতির পাশাপাশি বাজার সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

সরকারি হিসেবেই ধানের উৎপাদন খরচ ১২ শতাংশ বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বাড়লে পণ্যের দাম বাড়বে, তা কমানো সম্ভব নয়। জোর করে চালের দাম কমাতে চাইলে কৃষক উৎপাদনের উৎসাহ হারাবে। কৃষক ধান উৎপাদনের উৎসাহ হারালে নতুন জটিলতা দেখা দেবে। তাই এ পথ পরিহার করে গরিব সাধারণ মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে চাল সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

তারা বলছেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সময়মতো পরিসংখ্যান প্রকাশ করলেও প্রতিষ্ঠানটির তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল থাকে না। তথ্যে অনেক অতিরঞ্জন থাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোও (বিবিএস) উৎপাদনসংক্রান্ত পরিসংখ্যান প্রকাশে অনেক বিলম্ব করে। সঠিক সময়ে তথ্য প্রকাশ না হওয়া ও প্রকৃত তথ্যের অভাবে নীতিনির্ধারকরা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। সরকার অনেক সময় আগাম প্রস্তুতি নিলেও বাজারে এর প্রভাব পড়ছে না। সঠিক তথ্য ও বাজার তদারকির অভাবে চালের বাজারে সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকছে কিংবা কৃত্রিম সংকট তৈরি হচ্ছে। তাই খাদ্য উৎপাদন, মজুদ ও সরবরাহ—এ তিন স্তরে নির্ভরযোগ্য ও স্বচ্ছ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিতের পাশাপাশি তথ্যভিত্তিক শক্তিশালী বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত।

সরকারের এই পরিসংখ্যানের নাটক সম্পর্কে চালের কারবারিরা সবটা জানেন। তাদের কাছেই সঠিক হিসাব আছে। তাই বছরের পর বছর চাল নিয়ে চালবাজি করা সহজ হয়ে যায়। সরকার এই সিন্ডিকেটের টিকিটাও ধরতে পারে না।
চাল আমাদের একটি অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্য। চালের দাম বাড়লে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। একটি পরিবারের খাদ্য বাবদ ব্যয়ের সিংহভাগ চাল কেনার ক্ষেত্রে চলে যায়। চালের দাম বাড়ায় দরিদ্র মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা মারাত্মক হুমকিতে পড়ে। দুর্মূল্যের বাজারে চাল কিনতে গিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের মাছ, মাংস, ডিম, দুধ অর্থাৎ আমিষজাতীয় খাবার কেনা অনেকটা কমিয়ে দিতে হয়।

ভরা মৌসুমে দাম বেড়ে বর্তমানে স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে কুষ্টিয়া ও নওগাঁর চালের বাজার। কুষ্টিয়ায় গত জানুয়ারিতে প্রথম দফায় চালের দাম বাড়ে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে মানভেদে চালের দাম কেজিতে ৬-৭ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। পরবর্তী মূল্যবৃদ্ধি ঘটে জুন-জুলাইয়ে। এ সময়ে আঠাশ, বাসমতী ও কাজললতা জাতের চালের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮ টাকায়। মিনিকেটের খুচরা দাম একপর্যায়ে ৮৫-৮৬ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। বাসমতীর দাম পৌঁছায় ৯২ টাকায়। চালের ভরা মৌসুমে এমন মূল্যবৃদ্ধি গ্রণযোগ্য নয়। বাজারে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় ইচ্ছাকৃতভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। উৎপাদন ও সরবরাহ বেশি থাকলে পণ্যের দাম কমে—অর্থনীতির এ নিয়ম চালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে না। বোরো উৎপাদন ও মজুদ বিবেচনায় নিলে যে চাল রয়েছে তা দিয়ে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে যাওয়ার কথা। তার পরও মজুদদারদের একটি অংশ চাল মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করায় তিন মাস ধরেই চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। সামনে আমন মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বন্যায় উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে। তাই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে আগাম চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে সরকার নিজেই চার লাখ টন চাল আমদানি করবে এবং বেসরকারি খাতের মাধ্যমে আরো পাঁচ লাখ টন আমদানি করার অনুমতি দিয়েছে। সরকার যখন চাল আমদানির ঘোষণা দিয়েছে তখন অনেক মজুদদার দ্রুত বাজারে চাল ছাড়তে শুরু করেছে লোকসানের আশঙ্কায়। ফলে চালের পাইকারি ও খুচরা বাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছে। এতে চালের বাজারে কৃত্রিম সংকট দৃশ্যমান। কৃত্রিম সংকট দূরীকরণে চাল আমদানির ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের চেয়ে সরকারের উচিত বেশির ভাগ চাল আমদানি করা। পাশাপাশি বাজারে চালের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কঠোর নজরদারি বাড়ানো জরুরি। এতে বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে।

দেশে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চাল মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরির ঘটনা আমাদের নতুন নয়। এবারের পরিস্থিতিও তার ব্যতিক্রম নয়। সরকারের উচিত কেবল আমদানির ওপর নির্ভর না করে বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোরভাবে বাজার নজরদারি এবং সিন্ডিকেটবিরোধী পদক্ষেপ নেয়া। বাস্তবে সেটি হচ্ছে না। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে দেশের বিভিন্ন স্থানে খাদ্য অধিদপ্তর ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালালেও তাতে বাজারে কোনো প্রভাব পড়ছে না। কারণ এসব অভিযান ছিল ছেঁড়া জালে মাছ ধরার মতো—সিন্ডিকেটের মূলোৎপাটন নয়, বরং লোক দেখানো। এদিকে কৃষকরাও বিপাকে। তারা কম দামে ধান বিক্রি করলেও ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে চড়া দামে চাল। লাভ হচ্ছে কেবল মধ্যস্বত্বভোগী একটি শ্রেণীর। চাল নিয়ে এ ধরনের কারসাজির অবসান হওয়া দরকার। দেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় প্রকৃত তথ্যভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক নীতি গড়ে তোলা দরকার। তা না হলে সামনে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক জানিয়েছেন, সরকারি হিসেবেই ধানের উৎপাদন খরচ ১২ শতাংশ বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বাড়লে পণ্যের দাম বাড়বে, তা কমানো সম্ভব নয়। জোর করে চালের দাম কমাতে চাইলে কৃষক উৎপাদনের উৎসাহ হারাবে। কৃষক ধান উৎপাদনের উৎসাহ হারালে নতুন জটিলতা দেখা দেবে। তাই এ পথ পরিহার করে গরিব সাধারণ মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে চাল সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে। সে অনুপাতে আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে না। কৃষিজমি হ্রাস, উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের অভাব, কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং সে অনুপাতে কৃষক আয় করতে না পারাসহ বিভিন্ন প্রভাবক কৃষি উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। আর তাতে গত কয়েক বছরে দেশের কৃষি খাত একপ্রকার অচলায়তনে রূপ নিয়েছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে বড় ধাক্কা লাগতে পারে দেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনায়। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, সর্বশেষ পাঁচ বছরে আবাদকৃত জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ২ শতাংশ। এভাবে প্রতি বছরই কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। এর বিপরীতে পাঁচ বছরে হেক্টরপ্রতি ফলন বেড়েছে কেবল ৪ শতাংশ। আর চাল উৎপাদন মাত্র ২ শতাংশ বেড়েছে।

চাল আমদানির সিদ্ধান্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় যৌক্তিক হলেও সেটি যেন নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি স্বস্তির জায়গা না হয়ে ওঠে। বরং বাজার নিয়ন্ত্রণ, সঠিক তথ্য নিশ্চিত করা, কৃষি ব্যবস্থার সংকট নিরসন এবং সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলা, এসব স্থায়ী সমস্যা মোকাবেলায় জরুরি পদক্ষেপ কাম্য।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।