অস্থিরতার বাংলাদেশ: স্বপ্ন, সংগ্রাম ও প্রত্যাশা

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে অর্থাৎ ১৯৭২-২০২৫ সাল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, আন্দোলন, সশস্ত্র সংঘর্ষ, সামরিক ক্যু ও পাল্টা ক্যু—এসব ঘটনায় জর্জরিত, নিপীড়িত এবং প্রভূত সমস্যায় নুয়ে পড়ে আছে। স্বাধীনতার প্রথম বছরগুলোতেই খাদ্যাভাব, শরণার্থীর চাপ, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অদক্ষতা জনজীবনে হতাশা সৃষ্টি করে। পরবর্তীসময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিভাজন, ১৯৭৫ সালের করুণ হত্যাকাণ্ড, বারবার সামরিক শাসন, ১৯৯০ এর গণআন্দোলন, ২০০৭–২০০৮ সালের জরুরি অবস্থা কিংবা সাম্প্রতিক ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন—সবই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিমণ্ডল প্রায় প্রতিটি দশকেই অস্থিরতার মুখোমুখি হয়েছে।

বাংলাদেশ- শিশু থেকে মধ্যবয়সী বা প্রবীণ হওয়া একটা দেশ। সশস্ত্র  সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ। লক্ষ জনতার প্রাণের বিনিময়ের দেশ। ১৯৭১ থেকে ২০২৫, ৫৪ বছর। আমাদের মাতৃভূমি আমরা সযতনে রাখতে পারিনি। আমাদের নিজস্ব মারামারি, প্রতারণা, গাদ্দারি, স্বার্থ, লোভাতুর লোলুপ চাহিদা আর বিশ্বাসঘাতকতা এই জন্মভূমিকে পীড়িত করেছে। নিজের মাকে কি কেউ বিক্রি করে? অথচ আমাদের মাতৃভূমিকে এদেশেরই কিছু হিংস্র শ্বাপদ অন্যদের কাছে বিক্রি করছে প্রতিদিন। কি বলব এদের? কি বলা যেতে পারে?

যখন এ দেশটাকে আমাদের মায়ের মতো যত্ন করার প্রয়োজন ছিল ঠিক তখনই বাংলাদেশকে আলিঙ্গন করে রেখেছে ভাঙনের মহামারি। এই ৫৪ বছরের দীর্ঘ পরিক্রমায় আমাদের মাতৃভূমির দিকে একটা গভীর দৃষ্টিপাত করা যাক। অর্থাৎ ৫৪ বছরের বাংলাদেশকে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত আমরা তাকে কেমন রেখেছিলাম এবং কেমন রাখছি। 

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অস্থিরতা (১৯৭২–২০২৪)

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ (১৯৭২–২০২৪) মূলত এক দীর্ঘ ও জটিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার ইতিহাস বহন করে চলছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রটি একদিকে যেমন পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে, অন্যদিকে নানামুখী সংকট ও দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অস্থিরতা, সামরিক অভ্যুত্থান, দলীয় দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক দুর্বলতা, দুর্নীতি, বৈষম্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৈশ্বিক চাপ এবং সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থী-নেতৃত্বাধীন আন্দোলন—সব মিলিয়ে এ দেশের অর্ধশতাব্দীর ইতিহাস অস্থিরতার নানান অধ্যায় তুলে ধরে। নিচে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন দশকে অস্থিরতার একটা চিত্র তুলে ধরা হলো-

১৯৭২–১৯৭৫

  • ১৯৭২–৭৪: স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনে সংকট, দুর্ভিক্ষ (১৯৭৪), রাজনৈতিক অস্থিরতা।
  • ১৫ আগস্ট ১৯৭৫: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার নিহত—সামরিক অভ্যুত্থান।
  • ৩ নভেম্বর ১৯৭৫: জাতীয় চার নেতা কারাগারে নিহত।
  • ৭ নভেম্বর ১৯৭৫: “সিপাহি-জনতার বিপ্লব” নামে পাল্টা অভ্যুত্থান—মেজর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন।

১৯৭৫–১৯৮১

  • ১৯৭৭: বিমান বাহিনীতে বিদ্রোহ দমন।
  • ১৯৮১, ৩০ মে: রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে নিহত (একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টায়)।

১৯৮২–১৯৯০

  • ২৪ মার্চ ১৯৮২: জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেনাশক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল।
  • ১৯৮৩–১৯৯০: ধারাবাহিক ছাত্র-জনতা আন্দোলন এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী।
  • ১৯৯০, ৪ ডিসেম্বর: গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদের পদত্যাগ; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর।

১৯৯১–২০০৬

  • ১৯৯১: গণতান্ত্রিক নির্বাচন—বিএনপি ক্ষমতায়। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু।
  • ১৯৯৪–১৯৯৬: বিরোধী দলের লাগাতার অবরোধ–হরতাল; নির্বাচন বর্জন।
  • ১৯৯৬: আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলনের পর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু।
  • ২০০১–২০০৬: বিএনপি ক্ষমতায়, বিরোধী দলের লাগাতার হরতাল, সংঘর্ষ, জঙ্গিবাদ উত্থান।

বাংলাদেশ প্রত্যাশা করতে পারে একটি গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে নাগরিকের অধিকার নিরাপদ থাকবে, ভোট হবে স্বাধীন এবং আইনের শাসন সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর হবে। অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করে দেশকে মধ্যম আয়ের ফাঁদ থেকে মুক্ত করে উন্নত দেশের পথে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব, যদি সুশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়। সবচেয়ে বড় স্বপ্ন—আমাদের মাতৃভূমিকে সত্যিকারের ‘মানুষের বাংলাদেশ’ হিসেবে গড়ে তোলা, যেখানে বৈষম্য, অনাচার ও দুর্নীতির জায়গা থাকবে না।

২০০৬–২০০৮ (মহামারি সংকটকাল)

  • অক্টোবর ২০০৬: তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতা; ৪০+ জন নিহত।
  • ১১ জানুয়ারি ২০০৭ (ওয়ান/ইলেভেন): সেনা-সমর্থিত জরুরি অবস্থা; দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া গ্রেফতার।
  • ডিসেম্বর ২০০৮: নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক বিজয়।

২০০৯–২০১৪

  • ২০০৯ ফেব্রুয়ারি: বিডিআর বিদ্রোহে ৭৪ জন সেনা অফিসার নিহত।
  • ২০১৩: শাহবাগ আন্দোলন (যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দাবিতে); হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন।
  • ৫ জানুয়ারি ২০১৪: বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা।

২০১৫–২০১৮

  • ২০১৫: অবরোধ–হরতাল, পেট্রোল বোমা সন্ত্রাস; শতাধিক মানুষ নিহত।
  • ২০১৮: ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন।

২০১৯–২০২৩

  • ২০১৯: কোটা সংস্কার আন্দোলন চলমান।
  • ২০২০–২১: করোনা মহামারির কারণে রাজনৈতিক কার্যক্রম সীমিত, তবে দুর্নীতি ও স্বাস্থ্যখাতে অনিয়ম নিয়ে আন্দোলন।
  • ২০২৩: জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা, বিরোধীদলীয় আন্দোলন দমন, মানবাধিকার ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপ।

২০২৪–২০২৫ (সাম্প্রতিক)

  • জুলাই–আগস্ট ২০২৪: ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলন (সরকারবিরোধী), যা সহিংসতা ও শত শত প্রাণহানির মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবিকে সামনে আনে।
  • ২০২৫ (চলমান): গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা, পুনর্গঠনের চেষ্টায় উত্তাল রাজনীতি।

সংক্ষেপে ১৯৭২ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে:

  • একাধিক সামরিক ক্যু ও পাল্টা ক্যু (১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৮২)।
  • দীর্ঘ সামরিক শাসনকাল (১৯৭৫–১৯৯০)।
  • গণ-আন্দোলন ও স্বৈরাচার পতন (১৯৯০)।
  • তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন (১৯৯৬), আবার বাতিল (২০১১)।
  • জরুরি অবস্থা ও সেনা-সমর্থিত সরকার (২০০৭–০৮)।
  • নির্বাচন ও আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত (২০১৪, ২০১৫, ২০২৩)।

এবং সর্বশেষ, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলন বাংলাদেশের নতুন অধ্যায় সূচনা ঘটেছে।

জুলাই ২০২৫ আন্দোলন উত্তর বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি/অস্থিরতা (আগস্ট ২০২৪- আগস্ট ২৫)

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সহিংস ঘটনার পর বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজে বড় পরিবর্তন এসেছে। এক বছরের ব্যবধানে দেশের পরিস্থিতি কিছু ক্ষেত্রে উন্নতির পথে গেলেও, অনেক খাতে এখনো সংকট ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। নিচে অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলা, বাজার, নিরাপত্তা, শিক্ষা, চাকুরি, দুর্নীতি ও সরকারি প্রশাসন নিয়ে একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা হলো।

অর্থনীতি: অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অর্থনৈতিক নীতি সংস্কারে জোর দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে ২০২৪/২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমেছে  ৩.৩–৪.১%-এ।  ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে গড় মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৯–১০%, তবে আগস্টে এটি কিছুটা কমে ৮.২৯%-এ নেমে আসে। বাজারভিত্তিক মুদ্রানীতিতে ডলারের বিপরীতে বিনিময় হার ১২২ টাকার আশেপাশে স্থিতিশীল আছে।  দেশের রেমিট্যান্স-এ শক্তিশালী পুনরুদ্ধার ঘটেছে-মাসিক প্রবাহ প্রায় ২.৪-২.৫ বিলিয়ন ডলার, যা বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ে সহায়ক হয়। বহুপাক্ষিক সহায়তায় আই এম আফ এর ১.৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড় ও বিশ্বব্যাংকের ৮৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন অর্থনীতিকে সহায়তা করে।

আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা: ২০২৪ সালের আগস্টের সহিংস আন্দোলনের পর থেকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নানা মতামত রয়েছে। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী হত্যার মামলা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বেড়েছে। পারিবারিক কলহ ও জমি সংক্রান্ত বিরোধে হত্যার ঘটনা বৃদ্ধি এপেয়েছে। একই সাথে কিশোর গ্যাং এর অপরাধ, চাঁদাবাজি, ঘুষ লেনদেন এ তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নেই। আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী এক বছরে বড় রাজনৈতিক সংঘাত বা দলীয় সহিংসতা তুলনামূলকভাবে কমে এসেছে। তবে স্থানীয় পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তার ও ব্যবসায়িক স্বার্থে সংঘাতের খবর নিয়মিত এসেছে। মব ভায়োলেন্স অনেক উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে।  নিখোঁজ তদন্ত কমিশন গঠিত হলেও অনেক পরিবার এখনও প্রিয়জন ফিরে পায়নি।

বাজার পরিস্থিতি : বাংলাদেশের বাজারে গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে চাল ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যা নিম্ন-মধ্যবিত্তের জন্য বড় বোঝা। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য একেবারেই কমেনি। আগস্ট ২০২৫-এ খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৭.৬–৭.৭%। ডাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর বই, খাতা, টিউশন ফি ও পরিবহন ভাড়ার খরচ বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাস ভাড়া আগের তুলনায় প্রায় ২০% বেড়েছে। সরকার স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া চালু করলেও আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত ডিজেল/অকটেনের দাম স্থিতিশীল রাখা হয়, যাতে বাজারে আরও চাপ না পড়ে।

ব্যবসা-বাণিজ্য : বিনিয়োগ কমেছে অনেক খাতে বিশেষ করে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা এবং ব্যাংকগুলির অনিয়মের কারণেও দেশীয় ব্যবসায়িক বিনিয়োগ কমে গিয়েছে।  পোশাক শিল্পে ২০২৪ সালের শেষ দিকে নতুন ন্যূনতম মজুরি কার্যকর হওয়ার পর অনেক ছোট-মাঝারি কারখানায় শ্রম অশান্তি দেখা দেয়। মালিকরা বলেন, ক্রেতারা দাম বাড়াতে চাইছে না, অথচ শ্রমিকরা বাড়তি মজুরি দাবি করছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রে ত্রুটি দেখা দিলে ঢাকাসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে লোডশেডিং বেড়ে যায়। এতে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস কারখানাগুলো উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার অভিযোগ আছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষার নীতি নিয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন টার্মিনাল প্রকল্প ব্যবসা-বাণিজ্যে দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।

শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : ৫ আগস্ট ২০২৪-এ কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের শিক্ষা খাতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আন্দোলনের আগে ও পরে দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পড়াশোনা, ভর্তি কার্যক্রম, এমনকি শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় বড় পরিবর্তন দেখা যায়। আন্দোলনের সহিংসতা ও প্রাণহানির পর সরকার দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুল প্রায় ২–৩ সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত হয়। সেশন জট আরও তীব্র হয়, বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়।  ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বুয়েটের কয়েকজন শিক্ষার্থী সংবাদমাধ্যমে জানান, আন্দোলনের কারণে তারা গবেষণা থিসিস জমা দিতে পারেনি।

আন্দোলনের সময় ও পরবর্তী কয়েক মাস শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে।“মব ভায়োলেন্স” শিক্ষার্থীদের মানসিকতায় গভীর প্রভাব ফেলে—অনেকে পরীক্ষার প্রস্তুতি ছেড়ে সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে যায়। সেশনজট বাড়ে; মেডিকেল ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বিলম্বিত হয়। অনেক শিক্ষার্থী পরিবার হারিয়েছে বা সহপাঠীদের সহিংসতায় নিহত হতে দেখেছে। এটি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আগস্ট ২০২৪-এর শেষ দিকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়। গুচ্ছভর্তি ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের পরীক্ষা নেয়। ২০২৫-এ ভর্তি প্রক্রিয়া পুনরায় স্বাভাবিক হলেও সমন্বয় ঘাটতি থেকে যায়।

চাকুরি-বাজার : চাকুরির বাজারে চাকুরি প্রার্থীদের উৎকণ্ঠা বেড়েছে। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী যুব বেকারত্বের হার ৭–১১%, স্নাতক পর্যায়ে বেকারত্ব প্রায় ২৮%। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা অনেক তরুণ-তরুণী এখনো চাকরি পাচ্ছেন না, বিশেষ করে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। নতুন ন্যূনতম মজুরি ১১৩ ডলার চালু হলেও বৈশ্বিক বাজারে চাপ ও শ্রম অশান্তি কর্মসংস্থানে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।

সরকারি চাকুরির কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর সরকারি চাকুরি পরীক্ষার প্রক্রিয়া পরিবর্তিত হয়েছে। তবে পরীক্ষায় স্বচ্ছতা নিয়ে এখনও প্রশ্ন আছে। ব্যাংকিং সেক্টরে নতুন নিয়োগ প্রায় স্থবির। বিপরীতে, আইটি ও ফ্রিল্যান্সিং খাতে কিছু সুযোগ বাড়ছে, বিশেষ করে বিদেশি আউটসোর্সিং কাজের কারণে। নতুন মজুরি কাঠামোর কারণে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া বা শ্রমিক ছাঁটাইয়ের খবর পাওয়া গেছে যা শ্রমজীবীদের একটা চিন্তার কারণ।

ঘুষ-লেনদেন ও দুর্নীতি : টিআইবি’র জাতীয় গৃহস্থালি জরিপ (ডিসেম্বর ২০২৪) অনুযায়ী ৭০.৯% পরিবার সরকারি সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। নতুন পাসপোর্ট করতে গেলে এবং বিআরটিএ-তে লাইসেন্সের জন্য সরকারি ফি’র বাইরে অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে এজেন্ট বা অফিস সহায়তাকে। বিআরটিএ এখনও সময়মতো স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করছে না। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির তালিকায় পাসপোর্ট অফিস, ভূমি অফিস, BRTA ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে। ভূমি অফিসে নামজারি করতে অতিরিক্ত ৫–১০ হাজার ঘুষ ছাড়া কাজ এগোয় না বলে অভিযোগ সর্বত্র। আগের তুলনায় যার কোন উন্নতি হয়নি। অনলাইনে আবেদন ও পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু হলেও বাস্তবে সশরীরে ঘুরতে হচ্ছে। যেমন, BRTA অনলাইনে লাইসেন্স নবায়নের ব্যবস্থা করলেও ব্যবহারকারীরা সময়মতো সেবা পান না, ঘুষ দিলে দ্রুত কাজ হয়। ২০২৫ সালের মার্চে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে, শিক্ষক তাঁর পেনশন অনুমোদনের জন্য তিন মাস দৌড়ঝাঁপ করেছেন, কিন্তু ফাইল নড়াতে কর্মকর্তারা অনানুষ্ঠানিক অর্থ দাবি করেছেন।

প্রশাসনিক ব্যবস্থা, সরকারি অফিস ও সেবা : বিভিন্ন কাজে প্রশাসনের উদাসীনতা এবং অবহেলায় মব ভায়োলেন্স, মারামারি এমনকি হত্যার ঘটনা ঘটছে। প্রশাসনিক সেবায় ডিজিটালাইজেশন বাড়লেও নাগরিকদের অভিজ্ঞতায় ঘুষ ও অনিয়মের চিত্র প্রায় অপরিবর্তিত। পাসপোর্ট, ভূমি রেজিস্ট্রি, পুলিশ রিপোর্ট—এমন অনেক সেবায় ঘুষ ছাড়া কাজ এগোয় না বলে জরিপে উঠে এসেছে। আগস্ট ২০২৪ থেকে আগস্ট ২০২৫—এই এক বছরে বাংলাদেশ একদিকে রাজনৈতিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক সংস্কার ও বহুপাক্ষিক সহায়তা পেয়েছে; অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জীবনে চাল-ভাতের চাপ, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, ঘুষ ও প্রশাসনিক দুর্নীতি এখনো গভীর প্রভাব ফেলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক হলেও চাকুরি-বাজার সংকটে এবং বাজারে অস্থিরতা রয়ে গেছে। এ বাস্তবতায় স্বচ্ছ প্রশাসন, দুর্নীতি দমন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিই এখন সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার।

আগামীর স্বপ্ন ও প্রত্যাশা

৫৪ বছরে একটা দেশে প্রায় ২২টির মত আন্দোলন, ক্যু, পালটা ক্যু, দুর্ভিক্ষ আর অস্থিরতা। স্বাধীনতার পর হতেই আনুমানিক প্রতি ২.৪ বছরেই দেশে কোন না কোন অস্থিরতা ঘটেছে। আর তার সাথে নিয়মিত ভাবে রয়েছে চৌর্যবৃত্তি, দুর্নীতি, বৈষম্য, অনাচার, প্রতিবেশীর নিপীড়ন আর কুশাসন। আমার জানা মতে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ তাদের স্বাধীনতার পরে বেশ অস্থিরতায় ভুগেছে কিন্তু আমাদের দেশের মত এত বেশী অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা আর আন্দোলনের পুনঃ পুনঃ ঘটনা আর কোন দেশে ঘটেনি। এত কিছুর পরেও আমাদের মাতৃভূমি যে বেচে আছে সেটাই একটা আশ্চর্য বিষয়।

এখন প্রয়োজন অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখা। সেই স্বপ্ন হতে হবে স্বচ্ছ প্রশাসন, দুর্নীতিমুক্ত শাসন, সবার জন্য সমান সুযোগ ও মর্যাদা নিশ্চিত করা। শিক্ষা ব্যবস্থা হতে হবে আধুনিক, দক্ষতাভিত্তিক ও মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে শিল্প, কৃষি, প্রযুক্তি ও সেবা খাতে সমন্বিতভাবে।

বাংলাদেশ প্রত্যাশা করতে পারে একটি গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে নাগরিকের অধিকার নিরাপদ থাকবে, ভোট হবে স্বাধীন, এবং আইনের শাসন সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর হবে। অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করে দেশকে মধ্যম আয়ের ফাঁদ থেকে মুক্ত করে উন্নত দেশের পথে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব, যদি সুশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়। সবচেয়ে বড় স্বপ্ন—আমাদের মাতৃভূমিকে সত্যিকারের “মানুষের বাংলাদেশ” হিসেবে গড়ে তোলা, যেখানে বৈষম্য, অনাচার ও দুর্নীতির জায়গা থাকবে না; বরং সৃজনশীলতা, সততা ও মানবিকতার চর্চা হবে জাতির শক্তি। এ স্বপ্নই পারে বাংলাদেশকে অস্থিরতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে আলোর পথে এগিয়ে নিতে।

রেফারেন্স সমূহ :

  • হাসান, মুবাশশারুল ইসলাম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ১৯৭১–২০০১. ঢাকা: সমকালের প্রকাশন।
  • Al Jazeera, Reuters, Human Rights Watch রিপোর্ট – বিশেষত ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০২৪ সালের আন্দোলন সম্পর্কিত।
  • Talukder Maniruzzaman, The Bangladesh Revolution and Its Aftermath।
  • Ali Riaz, Bangladesh: A Political History since Independence।
  • ২০০৭ ওয়ান-ইলেভেন জরুরি অবস্থা: Prothom Alo Archive, Daily Star, HRW reports।
  • ২০০৯ বিডিআর বিদ্রোহ: BBC News, The Daily Star archives।
  • ২০১৩ শাহবাগ আন্দোলন, হেফাজত আন্দোলন: Al Jazeera & BBC Bangla special reports।
  • ২০১৮ নিরাপদ সড়ক আন্দোলন: The Daily Star & Prothom Alo।
  • ২০২৪ ছাত্র-জনতার আন্দোলন: Reuters, Al Jazeera, BBC Bangla (July–August 2024 coverage) ।
  • বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS), মাসওয়ারি ইনফ্লেশন ডাটা, অাগস্ট ২০২৫।
  • বাংলাদেশ ব্যাংক, রেমিট্যান্স প্রবাহ (জুলাই–অাগস্ট ২০২৫) রিপোর্ট।
  • World Bank, Bangladesh Development Update 2025।
  • IMF Country Report, বাংলাদেশ ECF/EFF প্রোগ্রেস রিভিউ, জুলাই ২০২৫।
  • Transparency International Bangladesh (TIB), জাতীয় গৃহস্থালি জরিপ ২০২৩, প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০২৪।
  • Prothom Alo, Financial Express, The Daily Star (বাজারদর, আইন-শৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ সংকট সংক্রান্ত প্রতিবেদনসমূহ)।
  • জাতীয় শ্রমশক্তি জরিপ (Labour Force Survey, BBS) ও গার্মেন্টস শ্রমবাজার সংক্রান্ত সংবাদ, ২০২৪–২৫।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।