মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ : টার্গেটের বাইরে কে?

তুষার আবদুল্লাহ তুষার আবদুল্লাহ
প্রকাশিত: ১০:২৮ এএম, ২৪ মে ২০১৮

দামামা বেজেছে যুদ্ধের। শুরু হয়েছে লড়াই। কামান না হলেও বন্দুক গর্জে উঠেছে। গ্রীষ্মে বরষার প্রকৃতিতে বৃষ্টি ঘুমে থাকায়, বন্দুকের গর্জন আমাদের কানে পৌঁছাচ্ছেনা। রজনী পোহালেই জানতে পারছি লাশের অঙ্ক। মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্তরা নিহত হচ্ছেন।

মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। মাঠে তৎপর র‌্যাব এবং অন্যান্য আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের শূন্য প্রশ্রয়ের অবস্থানে সাধারণ মানুষের সমর্থন না দেয়ার কোন অজুহাত নেই।

পুরো দেশ যখন মাদকের আসক্তিতে ঝিমুচ্ছে, তখন সরকারের এই ভূমিকায় যাওয়াটি প্রত্যাশিত। মাদকের আসক্তিতে দেশের তরুণ সমাজ বরাবরই ছিল। গাঁজা, আফিম, হিরোইন, চরস, প্যাথেড্রিন, ফেন্সিডিল, শিসা এবং ইয়াবা-নানা সময়ে আসক্তদের অবলম্বন ছিল।

পরিচিত গন্ডির মধ্যে বখে যাওয়া তরুণ বা অপরাধের সঙ্গে যুক্তদেরই দেখা যেত নেশায় আসক্ত হতে। মেয়েদের আসক্ত হবার ঘটনা ছিল বড় ধরনের ব্যতিক্রম। কিন্তু গত শতকের নব্বই দশকের দিক থেকে মাদক সকল নৈতিকতা, শৃঙ্খলা ও প্রতিরোধের বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হতে থাকে। শুধু বখে যাওয়া তরুণ-তরুণীরাই নয়, পেশাজীবীদের মধ্যেও মাদকের বিস্তার ঘটতে থাকে।

শিল্পী, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, পরিবহন চালক থেকে শুরু করে সমাজ ও পরিবারে মাদক আসক্তরা অতি সুলভ হতে থাকে। মাদকের নীলে নিমজ্জিত হতে থাকে একেকটি পরিবার। পরিবার গুলো নিঃস্ব ও ভাঙনের কবলে পড়ে।

আসক্তরা অনেকটা প্রকাশ্য হয়ে ওঠে বেপরোয়া ভাবেই। মাদকের বেচাকেনাও লোকচক্ষুর আড়াল থেকে প্রকাশ্যে চলে আসে কোন বিধি নিষেধের পরোয়া না করেই। কারণ মাদক ব্যবসার সঙ্গে সমাজ ও রাজনীতির বিশেষ প্রভাবশালীদের যোগাযোগ। রয়েছে তাদের সরাসরি প্রশ্রয়।

অভিযোগ আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যও এই বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। এই অভিযোগ গুলো কেবল সন্দেহের মধ্যে নেই। কোন কোনটি প্রমাণিত। এই বাস্তবতায় সরকার যখন মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে মাদক নির্মূলের তখন সাধারণ মানুষ এই অবস্থানকে স্বাগত জানিয়ে সরকারের কাছে কিছু প্রত্যাশাও রাখছে।

বন্দুক যুদ্ধে যারা নিহত হচ্ছে তারা সবাই কি সত্যি মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত? কানাঘুঁষা উঠেছে মাদক ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি পুলিশ অন্য আসামীদেরও বন্দুক যুদ্ধে টার্গেট করেছে। টাকার বিনিময়ে কাউকে কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে। অন্য অভিযোগে অভিযুক্তরা টাকা না দিলে তাদের মাদক চোরাচালানে জড়িয়ে বন্দুক যুদ্ধে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

সঙ্গে এই কথাও সাধারণের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যুদ্ধে ঘায়েল হচ্ছে শুধু চুনোপুঁটিরা। বোয়াল-কাতলরা রয়ে যাচ্ছে আড়ালে। তাদের বিরুদ্ধে কোন অবস্থান নিতে দেখা যাচ্ছে না। শুরুতে যদি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতো বা এখনও নেয়া হয় নির্মোহ ভাবে, তাহলে মাদক অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসতো। পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে মাদকের বড় হাটও চলে আসতো আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মুঠোতে।

মাদক কোন পথে আসে, কোথায় কোথায় প্রতিরোধের দেয়াল তুলতে হবে সবই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জানা। সুতরাং রণ নকশা যেহেতু জানা সেহেতু এই যুদ্ধকে কঠিন মনে করার কোন কারণ নেই। তবে যুদ্ধ শুরুর আগে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের অভ্যন্তরে শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছে কিনা, সেই উত্তরও জানতে চায় সাধারণ মানুষ।

যে জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ আছে, তাদের বিষয়ে সরকারের অবস্থানও স্পষ্ট হতে হবে। বন্দুক যুদ্ধ আতঙ্ক ও ভয় ধরিয়েছে হয়তো ঠিক। আইনের ফাঁক দিয়ে মাদক চোরাকারবারীরা বেরিয়ে আসে সহজেই, এই অনুযোগও হয়তো ঠিক, কিন্তু সেই ফাঁক গুলোতে জোড়ালো প্রলেপ দেবার সক্ষমতা সরকারের অবশ্যই আছে। সুতরাং বন্দুক যুদ্ধের রণক্ষেত্রে নয়, মাদককে নির্মূল করতে হলে সরকারের প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জনপ্রতিনিধিদের এক নিয়তে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নিয়তে খাদ থাকলে, রণ দামামাই বাজবে শুধু, সাময়িক স্বস্তিও পাওয়া যাবে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে দেশকে ঝিমুনী থেকে জাগানো সম্ভব হবেনা।

লেখক : হেড অব নিউজ, সময় টিভি।

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।