বেকার-বেসরকারি চাকরিজীবীদের দিকেও নজর দিন

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:০৫ এএম, ২২ এপ্রিল ২০২১

ঢাকা শহরের প্রায় ১ কোটি ১০ লাখের লোকের মধ্যে ৭০ লাখ লোক বেসরকারি চাকরির ওপর নির্ভরশীল। সারাদেশের মতো এখানেও সরকারের চেয়ে বেসরকারি খাতে বেশি লোক কাজ করছে। আবার করোনায় আক্রান্ত ৯০ শতাংশ লোক ঢাকা শহরের। ঢাকার ওপর দিয়েই যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি আপদ-বিপদ। এই দুরবস্থায় সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় আছে বেকার এবং বেসরকারি চাকরিজীবীরা। বেসরকারি চাকরিজীবীদের সিংহভাগের বেতন আবার ৩০ হাজারের নিচে। বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়া কমায়নি। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। চিকিৎসাব্যয় বাড়ছে। বেড়েছে যাতায়াত খরচ। লকডাউন বা তালাবন্দিকালে এই ভাড়া আরও লাগাম ছাড়া। প্রায় সবাইকে চাকরিস্থলে যেতে হচ্ছে উচ্চপরিবহন ভাড়া দিয়ে।

ডাক্তার, পুলিশ, সাংবাদিকের পরই করোনার মধ্যে ব্যাংকাররা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছেন। ডাক্তার-পুলিশের চাকরি ও বেতনের সমস্যা নেই। প্রতিদিন চাকরি হারাচ্ছে সাংবাদিকরা- তাই তাদের কথা নতুন করে বলার নেই। ব্যাংকাররা সে মাত্রার চাকরি না হারালেও তাদের অবদানটা সবচেয়ে অনালোচিত রয়ে গেছে। অথচ এই সময়ে অর্থনীতিকে সচল রাখার ক্ষেত্রে তারা দৃষ্টান্তমূলক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মাস্ক পরে লোকজন ব্যাংকে যাচ্ছে কিন্তু টাকা তোলার জন্য মাস্ক খুলতে হচ্ছে। ব্যাংকাররা সরাসরি তাদের সামনে এক্সপোজ হচ্ছেন।

এর আগে লকডাউন থাকলে সরকারি নির্দেশে ব্যাংক তাদের যাতায়াত ভাতার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু এবার বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকারদের জন্য সে সুযোগ রাখেনি। রাস্তায় বাহনের সমস্যার সঙ্গে বেড়েছে তাদের যাতায়াত খরচ। অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে পরিবহন পাচ্ছেন না। লকডাউনের শুরুতে ব্যাংকের ছুটি নিয়ে হয়েছে আরেক মহাকাণ্ড। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তাদের সিদ্ধান্তের মধ্যে ব্যাংকও বন্ধ থাকবে উল্লেখ করেছিল। আমলাদের মাথায় এটুকু বুদ্ধি আসেনি যে আটদিন ব্যাংক বন্ধ থাকলে দেশ চলবে কী করে! আর কলকারখানা, গার্মেন্টস খোলা থাকলে ব্যাংক কী করে বন্ধ থাকে! বাংলাদেশ ব্যাংকও তাৎক্ষণিকভাবে তা নজরে আনেনি। কেউ কেউ যখন ছুটি কাটানোর জন্য গ্রামের পথে, লকডাউন শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে আমলাদের সবার হুঁশ হয়েছে- ব্যাংক খোলা রাখতে হবে। নতুন করে সার্কুলার দেয়া হয়েছে। সারাদিন গ্রাহক ও ব্যাংকাররা এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ব্যাংকে ছিল প্রচুর ভিড়। সুভাগ্য যে ‘মানি পেনিক’ তৈরি হয়নি, নইলে এটিএম বুথ অর্থশূন্য হয়ে অকেজো থাকত।

এদিকে সোমবার (১৯ এপ্রিল) সরকার এক সার্কুলার জারি করে বলেছে, করোনা মহামারির এই পরিস্থিতিতে কোনো ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে পদভেদে ২৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাবে তাদের পরিবার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশে কার্যরত সব তফসিলি এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বরাবর এ সার্কুলারটি পাঠিয়েছে।

সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যাংকে কর্মরত অবস্থায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্ত্রী/স্বামী/সন্তান এবং অবিবাহিতদের ক্ষেত্রে বাবা/মা ক্ষতিপূরণের অর্থ পাবেন। এ সার্কুলার লেটারের নির্দেশনা গত বছরের ২৯ থেকে কার্যকর হবে এবং পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। অর্থাৎ ২৯ মার্চ থেকে যেসব ব্যাংকার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তাদের পরিবার এ সার্কুলারের আওতায় ক্ষতিপূরণ পাবেন।

ব্যাংকাররা এটাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন কিন্তু আইনের ফাঁক নিয়েও অনেকের সন্দেহ রয়েছে। একজন ব্যাংকার সন্দেহপ্রকাশ করে বলেছেন, ধরেন কোনো ব্যাংকার কোভিড পজিটিভ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হল কিন্তু মৃত্যুর আগে তার রিপোর্ট নেগেটিভ আসলো তখন কী হবে? কেউ আবার প্রশ্ন তুলেছেন মরার পরে টাকা আদৌ পরিবার পাবে কিনা সন্দেহতো আছেন, মরার আগে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে গিয়ে যে মরে যাচ্ছি সেটা দেখবে কে! যাতায়াত ভাতা বন্ধ করা ঠিক হয়নি।

বেসরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে আরেক শ্রেণি খুব কষ্টে আছে, তারা হচ্ছেন শিক্ষক। বিশেষ করে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকরা। আমাদের সমাজের অনেক নারী আছেন সংসারের পাশাপাশি চাকরি করার জন্য দূর-দূরান্তের কর্মস্থলে যাওয়ার পরিবর্তে বাসস্থানের কাছাকাছি কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক হয়েছেন। এসব স্কুল এমপিওভুক্ত নয় বলে তারা সরকার থেকে কোনোরকম বেতন-ভাতা পান না। আবার স্কুলের বেতন খুবই সামান্য। স্কুল থেকে প্রাপ্ত অর্থের সঙ্গে তারা টিউশনির টাকা দিয়ে সংসার চালান। তাদের জীবনও আজ করোনার কারণে ওলটপালট হয়ে গেছে।

করোনায় অনেক কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকের চাকরি চলে গেছে। টিউশনি বন্ধ। যাদের চাকরি আছে তারা বাসায় বসে অনলাইনে ক্লাস নেন। সরকার এদের আর্থিক সাহায্য করার কথা ভাবতে পারে। সামান্য সহযোগিতাও তাদের জীবনের হতাশা দূর করতে সহায়ক হবে। এমনকি করোনাকালে তাদের জন্য ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ দেয়াও একটা সাহায্য।

করোনার মধ্যে অসহায় জীবনযাপন করছে পরিবহন শ্রমিকরাও। বিশেষ করে বাসশ্রমিকরা। লকডাউনে তারা কর্মহীন থাকে এবং তাদের ৯৯ শতাংশই ডেইলি লেবার হিসেবে কাজ করে। কাজ বন্ধতো বেতন বন্ধ। এরা এখন পরিবহন পাহারা দিচ্ছে আর নিজেদের আহার নিজেরাই তৈরি করছে।

সরকার করোনায় নানা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে মধ্যআয়ের লোকদের জন্য। সে টাকার সিংহভাগ ব্যাংকে পড়ে আছে। ব্যাংকাররা ঝুঁকি নিতে আগ্রহী না। ২০০ কোটি টাকা ৫০০ লোককে দেয়ার চাইতে ২০ জনকে দেয়াটা তাদের জন্য সুবিধার। মনিটরিং ঝামেলা কম, লোনের বিনিময়ে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ও সহজ। নতুনদের ঋণ দিয়ে আদায়ের ক্ষেত্রে কু-ঋণ হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে এই বিবেচনায় আগে যারা ঋণ পেয়েছে তাদেরকেই ঋণ দিতে চায় এরা। কারণ সেখানেও ব্যাংকারের জবাবদিহিতা কম, আগে ঋণ পেয়ে থাকলে পুরোনো উদাহরণ দেয়া যায়। প্রণোদনার টাকা ব্যাংকে জমে থাকার প্রধান কারণ হচ্ছে- বড় ব্যাবসায়ীরা হয়ে আছে ঋণখেলাপি আর ছোট ব্যবসায়ীরা পারছে না প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে।

করোনার কারণে চলমান লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত, দরিদ্র, দুস্থ, ভাসমান এবং অসচ্ছল মানুষকে সহায়তা করতে অনুদান দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জেলা প্রশাসকদের অনুকূলে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে এ অর্থ দেয়া হবে। আর একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে এ সাহায্য দেয়া পৌঁছে যাবে। কিন্তু আমাদের বলতে হচ্ছে, সাহায্য মানে শুধু গরিবদের মধ্যে বিতরণ নয়। শুধু তৃণমূল নয়। এই শ্রেণি বাড়ি বাড়ি গিয়েও সাহায্য তুলছে। সামাজিক সহায়তা পাচ্ছে। কিন্তু যারা হাত পাততে পারে না, তাদের কথাও সরকার বিবেচনায় রাখতে হবে। সরকারকে উচ্চবিত্ত আর দরিদ্রদের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, বেসরকারি চাকরিজীবী, কর্মহীনদের কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। [email protected]

এইচআর/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।