বিশ্বাসের আলোয় জ্বলে ওঠে মঙ্গল প্রার্থনার প্রদীপ
কার্তিক মাসের নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় যখন বাতাসে শীতের হালকা ছোঁয়া মিশে যায়, তখন বাংলাদেশের নানা প্রান্তে লোকনাথ ভক্তদের ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে এক অনন্য আলো ‘রাখের উপবাসের প্রদীপ’। এটি শুধু একটি ধর্মীয় ব্রত নয়, বরং প্রার্থনা, ত্যাগ আর আশার মিশেলে গড়া এক হৃদয়ের উৎসব। ছবি: মাহবুব আলম
-
‘বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী’ নামটি উচ্চারণ করলেই ভক্ত হৃদয়ে জেগে ওঠে গভীর শ্রদ্ধা ও শান্তির অনুভব। বিশ্বাস করা হয়, যিনি অন্তর দিয়ে তার আশ্রয় নেন, তিনি কখনও অভুক্ত, অভাবগ্রস্ত কিংবা অসহায় থাকেন না। সেই বিশ্বাসেরই প্রতিফলন ঘটে রাখের উপবাসে।
-
কার্তিক মাসের শেষ পনেরো দিনে প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার ভক্তরা সারাদিন নির্জলা উপবাসে থাকেন।
-
সূর্যাস্তের পর ঘরে বা মন্দিরে সাজানো হয় ছোট্ট একটি পূজামঞ্চ। সেখানে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে, ধূপে সুবাস ছড়িয়ে ভক্তরা মাথা নত করেন লোকনাথ ঠাকুরের প্রতি। এ সময় মৃদু কণ্ঠে উচ্চারিত হয় প্রার্থনা, ‘ওম বাবা লোকনাথ, মঙ্গল করো আমাদের জীবনে।’
-
রাখের উপবাসের অর্থ শুধু না খাওয়া নয়, এ এক আত্মসংযমের সাধনা। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, শরীরের ক্ষুধা দমন করে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করলে ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়া যায় সহজে। তাই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ আহার করেন না, কেউ জল পর্যন্ত স্পর্শ করেন না। সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানোর পরেই তারা মুখে তুলে নেন এক চুমুক পানি, আর ঠোঁটে ফুটে ওঠে কৃতজ্ঞতার হাসি।
-
এই ব্রত শুধু নিজের জন্য নয়, বরং প্রিয়জনদের সুখ-সমৃদ্ধি কামনায় করা হয়। কেউ অসুস্থ স্বজনের আরোগ্য চান, কেউ প্রার্থনা করেন সংসারে শান্তির জন্য, কেউ বা হারানো প্রিয়জনের আত্মার মুক্তির জন্য। সেই একেকটি প্রদীপ যেন হয়ে ওঠে একেকটি ভালোবাসার প্রতীক, যা অন্ধকার ভেদ করে আলো ছড়ায় অন্তরে।
-
ঢাকার স্বামীবাগ লোকনাথ মন্দিরে এই সময়ে ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে।
-
শীতের হাওয়ায় যখন মন্দির চত্বরে ভেসে আসে ধূপের গন্ধ আর ভক্তি-সংগীতের মৃদু সুর, তখন মনে হয় সমস্ত ক্লান্তি, ব্যথা, দুঃখ যেন গলে যাচ্ছে প্রার্থনার আলোয়। চোখে দেখা যায়, কেউ মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছেন, কেউ প্রদীপের দিকে তাকিয়ে নীরবে কিছু বলছেন সম্ভবত ভালোবাসার একান্ত আবেদন।
-
লোকনাথ ভক্তরা বলেন, রাখের উপবাস শুধু ধর্মীয় রীতি নয়, এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলা এক ঐতিহ্য। দাদী-নানীরা যেমন এই ব্রত পালন করতেন, আজও তেমনি তাদের সন্তান-নাতিরাও একই নিষ্ঠায় সেই পথ ধরে চলেন। এই ব্রত মানুষকে শেখায় ধৈর্য, আত্মনিয়ন্ত্রণ আর অপরের জন্য প্রার্থনা করতে জানা যা আজকের ব্যস্ত জীবনে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।
-
যখন প্রদীপের শিখা নিভে আসে, ধূপের ধোঁয়া মিশে যায় রাত্রির নরম অন্ধকারে, তখন ভক্তদের মনে একটিই অনুভব শান্তি। হয়তো সমস্ত কামনা পূর্ণ হয় না, কিন্তু অন্তর ভরে ওঠে এক গভীর প্রশান্তিতে। সেই প্রশান্তিই রাখের উপবাসের আসল সার্থকতা, বিশ্বাসের মধ্যে খুঁজে পাওয়া আত্মার মুক্তি।
-
স্বামীবাগ লোকনাথ মন্দিরের সেই প্রার্থনার আলোয় দাঁড়িয়ে হয়তো কারও চোখে জল, কারও মুখে হাসি; কিন্তু সবারই হৃদয়ে একই অনুভব, বাবা লোকনাথ, তুমি আছো বলেই এখনও এই পৃথিবীতে মঙ্গল বেঁচে আছে।