৫ ঘণ্টার দুঃস্বপ্নে নিঃস্ব হাজারো মানুষ
রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে শুরু হওয়া আগুন যেন মুহূর্তেই গ্রাস করে নেয় মানুষের ঘর, আশা আর সারা জীবনের সঞ্চয়। টিনের ঘর আর সরু গলির বস্তি অগ্নিকাণ্ডের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর একটি। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে কালো ধোঁয়া আকাশ ঢেকে ফেলে, চার পাশে শুধু ‘আগুন, আগুন’ চিৎকার আর দৌড়াদৌড়ি। ছবি: বিপ্লব দীক্ষিত
-
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পৌঁছামাত্রই শুরু হয় আগুন নিয়ন্ত্রণের আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু বস্তির ভেতরে পানি সরবরাহ ছিল প্রায় নেই বললেই চলে। পানির অভাব আর চারদিকে ছড়িয়ে থাকা দাহ্যপদার্থ আগুনকে আরও ভয়ানক করে তোলে। তবুও থেমে থাকেনি ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। একের পর এক ইউনিট যোগ হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মোট ১৯টি ইউনিট টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে লড়াই চালিয়ে রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
-
ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া তথ্য মতে, এই অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৫০০ ঘর-বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে এখন পর্যন্ত হতাহত হওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
-
বাঁচতে পারলেও প্রায় সব পরিবারই হারিয়েছে বহু বছরের সংসার, সামান্য সঞ্চয়, শিশুদের বই-খাতা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় নিত্যসামগ্রী সবই।
-
আগুন লাগার পর বনানী ১১ নম্বর রোডে আশ্রয় নিয়েছে শতাধিক পরিবার।
-
রাস্তাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর চোখে আতঙ্ক, মুখে অবিশ্বাস; মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও যাদের মাথার ওপর ছাদ ছিল, রাত নামতেই তারা রাস্তায়।
-
পরিবারের সঙ্গে আশ্রয় নেওয়া শিশুদের কান্না আরও ভারী করে তোলে পরিবেশ।
-
তাদের অনেকেই পেটের ক্ষুধায় কাঁদছিল; কিন্তু প্রাণে বাঁচতে ঘর ছেড়ে আসা অভিভাবকদের পকেটে নেই খাবার কিনে দেওয়ার মত সামান্যটুকুও।
-
একজন মা বসে এক হাতে তার ঘুম না আসা শিশুকে জড়িয়ে রেখেছেন, আরেক হাতে চোখ মুছছেন।
-
বনানীর পাশাপাশি গুলশান লেকের দুই পাশের রাস্তা, ফুটপাত সবখানেই আশ্রয় নিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। কারো হাতে নেই পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছু। আবার অনেকে জীবন বাঁচিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে রেখে ছুটে চলেছেন বস্তির দিকে। যে ঘর এখনো আগুনে পুড়েনি, সেখান থেকে কিছু একটা উদ্ধার করার আকুতি তাদের চোখে মুখে।
-
প্রাণে বাঁচলেও আগুনের পরের বাস্তবতা আরও কঠিন। নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষেরা জানেন না আগামী রাত কোথায় কাটবে। কোনো শিশুর স্কুলব্যাগ নেই, কোনো বৃদ্ধার ওষুধ নেই, কোনো পরিবারে একমুঠো খাবার পর্যন্ত নেই।
-
অনেকে শুধু দূর থেকে পুড়ে যাওয়া বস্তি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। জীবনের পরিশ্রম, স্বপ্ন আর সংগ্রামের জায়গা যেখানে এক রাতে ধোঁয়ায় মিলিয়ে গেল।
-
ফায়ার সার্ভিস, স্বেচ্ছাসেবক দল ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় উদ্ধারকাজ চললেও এই হাজারো মানুষের পুনর্বাসন, খাবার, চিকিৎসা, পোশাক ও নিরাপদ থাকার জায়গার চাহিদা এখন সবচেয়ে জরুরি। কড়াইল বস্তির আগুন শুধু ঘর পুড়িয়ে দেয়নি; পুড়িয়ে দিয়েছে বহু পরিবারের নিরাপত্তা, স্থিতি আর স্বপ্ন। আগুন নেভার পরও তাই মানুষের চোখের জল থামছে না।