আগুনের ছাই পেরিয়ে বস্তিবাসীর জীবনের নতুন অধ্যায়
আগুন শুধু কাঠ-টিন নয়, মানুষের বছরের পর বছরের জমানো জীবনটাকেও মুহূর্তে ছাই করে দেয়। কড়াইল বস্তির সেই আগুনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। পোড়া গন্ধ, ছাইয়ের ধোঁয়া আর ভাঙা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ; সব মিলিয়ে দৃশ্যটা যেন এক অনন্ত শোকগাথা। তবু আশ্চর্য লাগে, সেই ধ্বংসস্তূপের মাঝেই যখন দেখা যায় কেউ হাতে নতুন চেয়ার নিয়ে ফিরছে, কেউ ধারে সংগ্রহ করা টাকায় আবার ছোট্ট চায়ের দোকান সাজাচ্ছে, কেউবা মাটির চুলা গড়ে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে-তখন বোঝা যায়, পুড়ে যাওয়া ঘরের পাশে সত্যিই নতুন করে সাজানো হচ্ছে স্বপ্নগুলো। বেঁচে থাকার অদম্য জেদ, কিছুটা হাসি, কিছুটা কান্না আর বিরামহীন শ্রম সব মিলিয়ে কড়াইলের সেই দুপুর আসলে মানুষের পুনর্জন্মের গল্প। আগুন তাদের ঘর কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারেনি। ছবি: মাহবুব আলম
-
দুপুর ১২টা। রোদটা একটু কড়া, কিন্তু ততটা নয় যে চোখ নরম করা যাবে। কড়াইল বস্তির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই কানে বাজল এক অসহায়, অথচ দৃঢ় উচ্চারণ, ‘মাইনষের খিচুড়ি খাইয়া কয়দিন চলবো? নিজেই দুইটা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করতেছি।’
-
কথাটা বললেন আগুনে পুড়ে যাওয়া এক ঘরের কর্তা। হয়তো নাম তার এখন আর প্রয়োজন নেই, কারণ এই বাক্যে তিনি শুধু নিজের গল্পই বলেননি; বলেছেন একটা পুরো সম্প্রদায়ের নীরব সংগ্রাম।
-
কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগা নতুন কিছু নয়। কিন্তু প্রতিবারই হারায় ঘর, জিনিসপত্র, স্মৃতি, স্বপ্ন, শিশুদের বই-খাতা, মায়েদের সঞ্চয়…। তবুও বিস্ময় লাগে, পুড়ে যাওয়া কাঠ, টিন আর ছাইয়ের মাঝেই মানুষ আবারও নতুন করে পথ খুঁজে নেয়।
-
ছোট একটা চায়ের দোকান ছিল লোকটার। আগুনে এক মুহূর্তে সব উড়ে গেল; কাঁচের জারগুলো, ভাঙাচোরা টুল, মফিজের হাসিমাখা বিকেলের আড্ডা, সবই ছাই। কিন্তু আজ দুপুরে তাকে দেখা গেল নতুন চা দোকানের শেড তুলছেন। ধার নেওয়া টাকা দিয়ে, আবারও সাজাচ্ছেন নতুন করে। মিষ্টি চায়ের গন্ধ এখনও নেই, কিন্তু চায়ের উনুনের পাশে বসা তার ভরসার আদলে মনে হচ্ছিল এখানে খুব শিগগিরই আবার ভিড় হবে।
-
কারও সেলুনের চেয়ার পুড়ে গেছে। আরেকজন কিনে এনেছে নতুন দুটি। কড়াইলের ভাঙা গলিতে হাঁটলে দেখা যায় সেই দৃশ্য- যে ছেলে সেলুন চালাতো, আগুনে পুড়ে তার দুইটা চেয়ার, কাঁচি, ট্রিমার সব উধাও। কিন্তু আজ সে দু’হাতে করে কিনে এনেছে নতুন চেয়ার। চেয়ারের রঙে ঝকঝকে আশার প্রতিফলন।
-
সে বলল, ‘চুল তো বড়বেই, মানুষ আবার আসবেই। তাই আবার শুরু করছি।’ এই কথাগুলো শুধু যে দোকানের কথাই বলে তা নয়, বলে উঠে দাঁড়ানোর দর্শন; যে দর্শন আগুনেও পুড়ে না।
-
রান্নার জন্য মাটির চুলা বানানো এ যেন বেঁচে থাকার প্রথম শিল্পকলা। নারীরা আগুনে পোড়া জায়গার পাশে বসে আবার নতুন করে মাটির চুলা বানাচ্ছেন। চুলা বানানোর সময় তাদের চোখে ভয় নেই। আছে কেমন যেন শান্ত দৃঢ়তা; যেমন থাকে একজন মায়ের চোখে, যখন সে জানে কিছুতেই তার পরিবারকে না খাইয়ে রাখা যাবে না।চুলার পাশে শুকোতে দেওয়া কাঠ, পাশে কুড়িয়ে আনা টিন-এই সবই নতুন শুরুর অক্সিজেন। ছবিটা তোলা হল দুপুর ১২টায়, কিন্তু মানুষের ভেতরে তখনও রাত কাটেনি।
-
ছাইয়ের স্তূপের পাশে শিশুরা খেলছে, বয়স্করা হাতুড়ি ঠুকছে, নারীরা মাটি গুঁড়ো করছে আর কোথাও কেউ চায়ের পাত্র ধুচ্ছে নতুন দোকানের জন্য। আগুন শেষ হয়েছে, কিন্তু জীবন তো চলছে। রাত তো কেবল ঘরের দেয়াল পোড়ায়, মানুষের মন নয়।
-
ছাইয়ের স্তূপের পাশে শিশুরা খেলছে, বয়স্করা হাতুড়ি ঠুকছে, নারীরা মাটি গুঁড়ো করছে আর কোথাও কেউ চায়ের পাত্র ধুচ্ছে নতুন দোকানের জন্য। আগুন শেষ হয়েছে, কিন্তু জীবন তো চলছে। রাত তো কেবল ঘরের দেয়াল পোড়ায়, মানুষের মন নয়।
-
আগুন তাদের ঘর পুড়িয়েছে, কিন্তু তাদের মাটি থেকে উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটা পুড়াতে পারেনি। চা দোকানের নতুন জার, সেলুনের নতুন চেয়ার, মাটির নতুন চুলা এই সবই সাক্ষ্য দেয় যে জীবনকে ভালোবাসলে, জীবনও কখনো হার মানতে দেয় না। কড়াইল বস্তির সেই দুপুরের আলো তাই শুধু আগুন-পরবর্তী ধ্বংস দেখায়নি, দেখিয়েছে নতুন করে বেঁচে উঠার অদম্য সাহস। যারা এই মানুষগুলোকে দেখেছে, তারা জানে মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় তার বেঁচে থাকার ইচ্ছে আর সেই ইচ্ছে আগুনেও পোড়ে না।