ভালোবাসার সাত রং
বুকে গাঢ় লাল রং এর যাতনা বইয়ে দিয়ে চলে গেছিল যে সব ভাঙা ভাঙা ছোট ছোট নষ্ট সময় তারেই আজ বড়ো ভালোবেসে কাছে টানি। বড় আদরে সোহাগে যতনে রাখি বুকের নিভৃতে। সেদিনকার সেই প্রেম আজ ভালোবাসা হয়ে ধরা দেয়। নিজেরই অজান্তে লুকিয়ে রাখি সে রাগ বিরাগ বিরহ প্রতারণা। এত এত বছর পর সেই সব ভালোবাসা প্রেম হবে। বুঝি জেনেছিল মন। আর যেটা আরো আরো দূরে। বলা বা দেখার বাইরে। যে কথা যায় না বলা, যে কথা কইতে পারিনা কারে। কেন যে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম গাঙে নিজের হাতে বানানো সাধের নৌকো। যে নৌকার পালে বাতাস খেলেনি। কেউ বলেনি না বলা কথা তার কানে।
যে আজ বড়ো বেশি ঘৃণা নিয়ে অপলক চেয়ে থাকে কোনো এক খঞ্জনপুরের সেই বিষন্ন বিকেলের দিকে? যে পরাতে চেয়েছিল জয়ললিতা টিপ।পায়ে সোনার মল। ঘুম ভেঙেই একটা নতুন চিঠি পেতে যে কোনোদিন করেনি বঞ্চনা। আমার শ্যামল রং শরীরে আমার কাজল রঙ চোখের নদীতেই যে খুঁজে পেতে চেয়েছিল শুধু নিজেরে কামনায় প্রেমে সুখে অসুখে। তারে হয়নিকো রাখা আঁচলের তলে।তারে হয়নি কি বাঁধা ভালোবাসায়? উড়ে গেছে তার ভালোবাসা প্রেম হয়ে আমার অনন্ত আকাশে। গহীনে তারও যে ছিল এক ভালোবাসার মায়া। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার ধন। সে রত্নকে তার কোলে তার বুকে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে আমি যে কবে হারিয়েছি প্রিয় নাকফুল, কণ্ঠের সোনার হার, সে কি জানে? জানলে কি তা আজ তার বুকে প্রেম হবে? হবে ভালোবাসা? জানলেই কি সে পারে হৃদয়ের আপন ধুলায় ছড়িয়ে জুড়ে দিতে হলুদ পাতায় সবুজের রং? পারেনা। পারেনা। পারেনা হায়। তাই তে সেই সব কথকথা রঙে রাঙা হয়ে ভালোবাসা বুনে দেয় আমারি বেদনার ক্ষেতে। আর আমি পূর্ণ করে তুলি আমার শূন্য গৃহাঙ্গন।
সুইট সিক্সটিনে-রেললাইনের ধারে বাসন্তি রং শাড়ি পড়ে হেঁটেছিলাম একদিন তারসাথে। মনে হয়েছিল এটা ভালোবাসা। খুব গোপনে চুরি করে লিখেছিলাম কবিতা। মনে হয়েছিল সেটা ভালোবাসা। লুকিয়ে পালিয়ে এসে এক বিকেলের নরম রোদে ব্রহ্মপুত্রের জলে ছায়া লিখেছিলাম দু’জনে। মনে হয়েছিল জল এত সুন্দর! সেটাই ভালোবাসা। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তিনতলার ছাদে ঠোঁটে ঠোঁট। সেটা ভালোবাসা। তারপর, চোখে এক সাগর জল নিয়ে চলে এসেছিলাম। সেটাকেই কি করে বলি আমি ঘৃণা? যে জল নদীতে সাগরে অত সুন্দর হয়ে ধরা দিল একদিন।আমারই চোখে কেন তবে তা হবে অসুন্দর। এই তো প্রেম। প্রথম বুঝতে শিখি। আর অক্লেশে জড়িয়ে ধরি তারে। কবে তার শুরু। কবে তার শেষ? আমিই কি জানি তার অশেষ?
তারপর কেটে যায় শত সহস্র দিন আর রাত। শরতের মেঘে মেঘে উড়ে যায় সে অধরা মাধবী। নিজেরে আর বাধতে পারিনা পার্থিব কিছুতেই। কোনো কোনো দিন মনে হয় এই বেশ। যে আমার নেই, আছে সে তো পৃথিবীর কোনো এক কোণে। তারেই আমি ভালোবাসি সযতনে। এই বেশ আনন্দ নিয়েই থাকি। কিন্তু তাতে কি খুশি থাকে কিউপিড? সে যে ভালোবাসার দেবতা। আমারে বিরহের কিনারে ফেলে রাখলে তারই যে সিদ্ধি অসম্ভব। তারও যে চাই অমরতা। আর সরস্বতী? তার যে দয়া আর দাক্ষিণ্য এক জীবনে দিয়ে গেলেন আমারে সে না বললে নয়। তিনি এনে ফেলে দিলেন আমারে রাগ রাগিণীর মায়াজালে। প্রাণের ঠাকুর জড়িয়েছিলেন জন্মের প্রথম প্রতুষ্যে যারে, অসীম প্রেমে বেঁধে দিলেন তিনি আমারে সুরে আর রাগে।
দিনরাত তখন লিখি। লিখি গান লিখি কবিতা লিখি হৃদয়ের সব কথা। তিনি ভালোবাসেন আমার লেখা। আমি ভালোবাসি বিধাতার দান। সুরের মায়া। তিনি সুরে বাঁধেন। খুব দ্রুতই ফেলে দেন ট্র্যাকে। নিজের কণ্ঠেই অমর করে রাখেন যে প্রেম। খোলা আকাশের নিচে শুধু সুরে আর গানে পার হয়ে যায় কত কত যে মাধবী রাত। তার কথাই কি প্রেম নয়। জাগতিক নিয়ম আর দূরূহ দুঃশাসন দেয়নি নিতে তার পায়ের ধুলি। বরং আমিই পড়ে রইলাম ধুলিতে। সেই ধুলিতে লেগে ছিল তার পায়ের ছাপ। তাই নিয়ে অনন্ত সুখে কাটিয়েছি কতকাল! প্রেমে। ভালোবাসায়। রাখিনি তার কোনো স্মৃতি। কোনো স্বরূপ নিজের কাছে। কোনো সুর লেখা নেই আমার কাছে, তার। কিন্তু হৃদয়ের গোপনে যে গান নিয়ত বাজে কে ছিনিয়ে নিতে পারে তার সুর আর কথা? তাই বহুদিনের গোপন ব্যথা হারানো কথা প্রেম হয়ে জেগে থাকে যেন আকাশের শেষ সীমানায় ছুঁতে পারি কি পারি না এমন নিরালায়, শুকতারাটির মতো। প্রায় দেড়যুগ পরে,সেই চিরচেনা সুর ফিরিয়ে দিতে তাই বুঝি তিনি ফিরে আসেন আবার আমা্রই নিমগ্ন প্রেমে আমারই ভালোবাসায় পার্থিব কায়া হয়ে। কিন্তু তখন আর যায় না পারা তারে টেনে নিতে বুকের কাছে। তখন তিনি থাকেন আমার একান্তে নিভৃতে। সমর্পণযোগ্য এক মহাপ্রভুর প্রায় নিকটে। তাই আমি শুধু তার অপার্থিবটুকুই নিই, অগোচরে।
দিনরাত খেটে গড়ে তুললাম প্রেমের স্বর্গরাজ্য। রাজা আমায় জানলেন না। যতই করি প্রাণাতিপাত। যতই দেই বলি দেবতার পায়ে নিজের সব-দেবতার মন ভরেনা। আমি হয়ে রইলাম দুর্বোধ্য। না কি সেই দুর্বোধ্য আজো? খুঁজি সেই প্রশ্নেরও উত্তর। পলে পলে ক্ষণে ক্ষণে। যে অসীমারে জপমাল্য করেছিল যগতের বড়ো জ্ঞানবান গুণবান সে বড় সসীম হয়ে পড়ে রইলো দেবতার পায়ের কাছে, বড়ো অযোগ্য আজ সে পূজোর আয়োজনে। দিন মাস বছর যুগ অতিবাহিত হলো সে প্রেমের সাধনায়। তারপর এই জলজ অবস্থান। জল তো জল, সে এক গভীর শীতল জল। তবু জানিনা ওই শীতলতাকেই প্রেম ভাবি। ভাবি অমর ভালোবাসা। আর ঘোলাজলে পড়ে থাকি। এই বুঝি তার অধরা প্রেমের বিশেষ!
আজ ভালোবাসা দিবসে ভাবি, ভালোবাসার কি আসলে কোনো দিন হয়? রাত হয়? বিকেল সন্ধ্যে কি ভোর? সময় দিন ক্ষণ দিয়ে কি বাঁধা যায় এই অদম্য অনুভব। কবে কোন ভ্যালেন্টাইন তার প্রিয়ার জন্য কিংবা প্রিয়তমের জন্য দিয়েছিলেন প্রাণ, তারে আমি প্রণতি জানাই। শত শ্রদ্ধা তারে। কিন্তু এই যে যুগ যুগ ধরে জীবন ধরে রেখে নিয়ত নিজেরে উৎসর্গ করে করে প্রাণাতিপাত এই কি কম? ভ্যালেন্টাইন! কে জানে, ঈশ্বর কি জানেন? প্রভু কি জানেন এইসব ভালোবাসার মহারূপ? নিশ্চয়ই জানেন।
‘‘আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল আমার দেউল আমারই এই আপন দেহ।’’ সত্যিই তাই। এই বিশাল ব্রহ্মান্ডে কত কত কত যে প্রভু ছড়িয়ে আছেন প্রতিটি দেহে প্রতিটি আত্মায় সেই তো মহাপ্রভু রূপের বিচরণ অরূপের খেলায়। ভালোবাসতে জানেন তিনি শুধু স্নেহ আনন্দ সেবা আর সুখই নয় প্রতিটি বেদনার যিনি দেন অপরূপ এক রং। তাই বুঝি যত বিরহ প্রতারণা যত ক্ষয় যত অপচয় সবই ভালোবাসা হয়ে সাত রং ছড়িয়ে দেয় এইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রভূর দেহে আর আজন্ম দাঁড়িয়ে থাকে সবার অলক্ষ্যে। দু’হাতে সরিয়ে সব, এক অটল অনড় প্রেম প্রতিভূ জীবন হয়ে। আর তাই আমি ধরে রাখি জীবন। এই দেহেই এই জীবনেই আরাধনা করি প্রেমের প্রভূর আর ভালোবাসার। মৃত্যুর মধ্যে প্রেমের অমরত্ব সে যে মহাপ্রভূরই প্রস্থান। আামি এও কি করে দিতে পারি নস্যাৎ! সম্ভব! তবে প্রভূ বিরাজ করবেন কোথায়? কোন প্রেমে কোন ভালোবাসায়?!!
লেখক : সংস্কৃতিকর্মী, কবি
এইচআর/আরআইপি