মাশরাফির চোখে পানি দেখেছ, বুকের আগুন দেখোনি!
বিশ্বকাপে আজ বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। নিরাপত্তার অজুহাত তুলে নির্ধারিত বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছিল অস্ট্রেলিয়া। গত বছরের ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকেই ক্রিকেটের প্রায় সব প্রতিষ্ঠিত দলকেই হারিয়েছে মাশরাফি মর্তুজার দল। মাঝখানে নিরাপত্তার(!) দেয়াল তুলে দেয়ায় অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলার সুযোগ হয়নি। এই ম্যাচটির জন্য অপেক্ষায় ছিল ১৬ কোটি মানুষ সর্বোপরি গোটা ক্রিকেট দুনিয়া। সেই ম্যাচ আজ। কিন্তু ম্যাচের চেয়েও বেশি আলোচিত হয়ে উঠেছে তাসকিন বিতর্ক। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে মাঠের খেলা নিয়ে যত কথা বলেছেন তার দশগুণ কথা মাশরাফি বলেছেন তাসকিনের বিপক্ষে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে। সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফি নিজে কেঁদেছেন, কাঁদিয়েছেন দেশি-বিদেশী সাংবাদিকদের। পান থেকে চুন খসলেই যারা নাঙা তলোয়ার হাতে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে কাটতে আসে, তারা মাশরাফিদের চোখের পানি দেখেছে, বুকের আগুন দেখেনি।
নিষিদ্ধের সংবাদ শুনে মাশরাফিকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছেন বাংলাদেশ স্পিড স্টার তাসকিন আহমেদ। শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে শুরু থেকেই বারবার অবিচার শব্দটি বলেছেন মাশরাফি। বাংলাদেশ অধিনায়কের চোখের পানি আর অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই এদুটোকে আলাদা করে দেখার চোখ যে বিশ্বক্রিকেট নিয়ন্তাদের নাই তা বলাই বাহুল্য। মাশরাফির চোখের পানি তাসকিন-সানির জন্য। আর লড়াইটা চোখের পানিতে প্রতিজ্ঞা। আজকাল ক্রিকেটে কত হরেক রকমের ‘কোড অব কন্ডাক্ট’। কোনো কিছুরই তোয়াক্কা না করে মাশরাফি বলেছেন- ‘আমার ক্যারিয়ার তো প্রায় শেষ। আমার কষ্টটা তাসকিনদের জন্য। যে ছেলেটা ক্যারিয়ার কেবল শুরু করেছে। দেশকে ১০/১৫ বছর সার্ভিস দেবে, তার ওপর এত বড় অবিচার মেনে নেয়া যায় না।’
আরাফাত সানির নিষিদ্ধ হওয়া নিয়ে ততটা সরব হয়নি বিসিবি তথা বাংলাদেশ ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা। আইসিসির বেঁধে দেয়া যে পথ সেটাই অনুসরণ করতে চেয়েছে সবাই। কিন্তু তাসকিনের ব্যাপারে শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন কোচ অধিনায়ক থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা। তাসিকনকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে বোলিং অ্যাকশনের ত্রুটি বিবেচনার চেয়ে, সিদ্ধান্ত আরোপ করাটাই বড্ড বেশি চোখে লেগেছে সবার। লড়াইটা কেন করা দরকার সেটাও সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন মাশরাফি-‘যে ম্যাচের জন্য তাসকিনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে, সেই নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে একটিও বাউন্সার দেয়নি তাসকিন। অথচ বোলিং পরীক্ষায় তাকে ৩ মিনিটের মধ্যে ৯টি বাউন্সার দিতে হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি বলে ১৫ ডিগ্রির সীমা অতিক্রম করেছে।’ এ কথা গুলো বলার সময় বেশ একচোট হেসেও নেন মাশরাফি। অথচ মাশরাফির চোখ ছিল ভেজা। ভেজা চোখে মাশরাফির এই যে হাসি এটাই, আইসিসির অন্যায়/অবিচারের প্রতি ছুঁড়ে দেয়া ভিন্ন চ্যালেঞ্জ। যেন বুঝিয়ে দেয়া আইসিসি একটা হাস্যকর প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক হিসাবে ব্যর্থ, সর্বোপরি ক্রিকেট ড্যামেজিং প্রতিষ্ঠান।
আইসিসির পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ নিয়ে লিখতে গেলে হার মানাবে আরব্য উপন্যাসের এক হাজার এক রাত্রির গল্পকেও। বাংলাদেশ নিয়ে আইসিসির সর্বশেষ অবস্থানের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিষয়টা। গত কয়েক মাস ধরে শুধু ক্রিকেট নয় আন্তর্জাতিক খেলাধুলার এক মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। সারা দুনিয়ার ক্রীড়া স্রোত অভিমুখি হয়েছে বাংলাদেশের। সর্বশেষ সংযোজন অনূর্ধ্ব- ১৯ বিশ্বকাপ আর টানা তৃতীয়বারের মত এশিযা কাপ অায়োজন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সেই এক গো। বাংলাদেশে তারা খেলতে আসবে না। বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না! নির্ধারিত বাংলাদেশ সফর বাতিল করেই ক্ষান্ত হয়নি অস্ট্রেলিয়া। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও দল পাঠায়নি তারা। সেই একই অজুহাত, নিরাপত্তা। অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তানুভূতি(!) নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে খোদ অস্ট্রেলিয়াতেই। কিংবদন্তীর অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেল বলেছেন, একই পরিস্থিতিতে ভারত সফর বাতিল করতে পারত না অস্ট্রেলিয়া।’ ঠোঁটকাটা হিসাবে বেশ খ্যাতি আছে অস্ট্রেলিযার কিংবদন্তীর ব্যাটসম্যান ডিন জোনসের। বলেছেন-‘বাংলাদেশ এখন অনেক ভাল খেলছে। কোনো ঝুঁকির মধ্যে যেতে চায়নি।’ বাংলাদেশের অনেক অদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। কিন্তু মাঠের খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার জায়গাটিতে বাংলাদেশেকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো বাস্তবতা কি আদৌ আছে? গোটা দুনিয়ার প্লেয়াররা খেলছে বাংলাদেশে আর অস্ট্রেলিয়া তোতাপাখির বুলির মত বলে যাচ্ছে ‘নিরাপত্তা, নিরাপত্তা।’ এ ব্যাপারে আইসিসির ভূমিকা ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ বললেও বোধকরি বেশি সুবিচার করা হবে।
হালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভাবমূর্তি নিয়ে সবচেয়ে বেশি খেলছে অস্ট্রেলিয়া। এমন দেশের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে শুরু হয়ে গেছে আইসিসির খেলা। পুরোপুরি ফিটনেস না পাওয়ায় এখনও বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচে মাঠে নামেননি স্লোয়ার-কাটার বিস্ময় মুস্তাফিজুর রহমান। এরই মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত সব ঘটনা। বিশ্বকাপে নিয়মিত খেলে যাওয়া দুই ক্রিকেটার নিষিদ্ধ। উঠতি একটা দলকে গলা টিপে মেরে ফেলার জন্য আর কি চাই? ঠিক এই জায়গাটিতেই হিসাবটা গরমিল করে ফেলেছে আইসিসি। মাশরফির চোখের পানি অসহায়ত্বের আর্তনাদ নয়, প্রতিজ্ঞা পূরণের প্রত্যয়। ২০১১ সালের বিশ্বকাপের আগের সেই সংবাদ সম্মেলন বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষের স্মৃতিতেই এখনও টাটকা। ফিটনেস ঘাটতির কারণে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা পাননি মাশরাফি। এই সংবাদ শুনে অঝোরে কেঁদেছিলেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’। ওই মাশরাফি পর্যন্ত হিসাব কষা যায়! বাকিটা! বাংলাদেশ ক্রিকেটের পুনর্জন্ম ঘটিয়ে বিশ্ব শক্তিতে পরিণত করার কারিগর এখন মাশরাফি। ডাক্তারের ছুরি-কাঁচি সব মিথ্যে হয়ে যায় যখন ব্যক্তিটি হন মাশরাফি। বড় লড়াইয়ে মাশরাফির মানসিক শক্তির উৎস যে ১৬ কোটি মানুষ। গতকাল সংবাদ সম্মেলনেও চেয়েছেন দেশের মানুষের সমর্থন। এদিকে তৎপর হয়ে উঠেছে বিসিবিও। তাসকিনকে বিশ্বকাপে ফিরিয়ে আনতে মরিয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটের অভিভাবক।
মাঠের বাইরের লড়াইকে মাঠে ফিরিয়ে আনতে হবে, এটাও ভোলেননি মাশরাফি। ‘২০ শতাংশ ফিট থাকলেও আজ মুস্তাফিজ খেলবে’- বলেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। নিজ নিজ অবস্থান থেকে মাঠ ও মাঠের বাইরে সবটুকু নিঙড়ে দেয়ার পথটাই দেখিয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
এইচআর/এমএস