মালয়েশিয়ার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের দাপট

আহমাদুল কবির
আহমাদুল কবির আহমাদুল কবির , মালয়েশিয়া প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৬:৩১ পিএম, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
মালয়েশিয়ার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো/ ছবি: সংগৃহীত

মালয়েশিয়ার শীর্ষ পাঁচটি সরকারি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের দাপট চলছে। তাদের সংখ্যা এখন স্থানীয় চীনা জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে গেছে।

এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কেদাহ রাজ্য নির্বাহী কাউন্সিলের সদস্য (এডুকেশন এক্সকো) অধ্যাপক হাইম হিলম্যান আবদুল্লাহ। সম্প্রতি সিনচেউ গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের (এমওএইচই) ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, ইউনিভার্সিটি মালায়া (ইউএম), ইউনিভার্সিটি সাইন্স মালয়েশিয়া (ইউএসএম), ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়া (ইউকেএম), ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়া (ইউটিএম) ও ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়ার (ইউপিএম) বর্তমান মোট শিক্ষার্থীর ২১ দশমিক ৩ শতাংশই আন্তর্জাতিক। এর বিপরীতে চীনা জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী আছেন ১৩ থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ।

এ পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৩৮৮ জনে। এর মধ্যে শুধু চীন থেকেই এসেছেন ৩০ হাজার ৭১৪ জন। এরপর রয়েছে ইন্দোনেশিয়া (৪ হাজার ১৪৫), ইরাক (২ হাজার ৯৮), বাংলাদেশ (প্রায় ১ হাজার ২০০) ও যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ৯১ জন।

যদিও জাতীয় পর্যায়ের ২০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর গড় হার ৮ দশমিক ৭২ শতাংশ।

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অবস্থান

শীর্ষ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বর্তমানে অধ্যয়ন করছেন, যা দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের তরুণেরা চিকিৎসা, প্রকৌশল, ব্যবসা ও তথ্যপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত কোর্সে বেশি ভর্তি হচ্ছেন।

ইউএমে পড়া ব্যবসায় প্রশাসনের এক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বলেন, ‘মালয়েশিয়ার ডিগ্রির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে, খরচও ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় অনেক কম। সে জন্যই আমি এখানে এসেছি।’

ইউপিএমে কৃষি বিজ্ঞানের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এখানে গবেষণার ভালো সুযোগ আছে, তবে বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের জন্য আবাসন আর খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ সীমিত। এগুলো একটা বড় চ্যালেঞ্জ।’

ইউটিএমের আইটি বিভাগের শিক্ষার্থী রাশেদুল ইসলাম জানান, মালয়েশিয়ার পরিবেশ ও সংস্কৃতি বাংলাদেশের কাছাকাছি, তাই মানিয়ে নেওয়া সহজ। তবে টিউশন ফি এবং জীবনযাত্রার খরচ অনেকের জন্যই চাপের।

শিক্ষার্থীদের মতে, মালয়েশিয়ায় পড়াশোনার আকর্ষণ থাকলেও সীমিত বৃত্তি ও চাকরির বাজারে অনিশ্চয়তা ভবিষ্যতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।

আরও পড়ুন
মালয়েশিয়ায় হালাল প্রদর্শনীতে বাংলাদেশি পণ্যের জয়যাত্রা
কুয়ালালামপুরে প্রথমবারের মতো ‌‘বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিং ফেস্টিভ্যাল’
ভুয়া বিয়ে করলে বিদেশিদের গ্রেফতার করে ফেরত পাঠাবে মালয়েশিয়া

পুরো মালয়েশিয়ায় কত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন তা নিয়ে ভিন্নমত আছে। গত আগস্টে বেশকিছু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় যে দেশটিতে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। দাবি করা হয়, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর বৈঠকে এ সংখ্যাটি উল্লেখ করা হয়েছিল।

তবে মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ দাবি অস্বীকার করেছে। মন্ত্রী জাম্ব্রি আবদ কাদির স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, এমন কোনো সংখ্যা বা চুক্তি আলোচনায় ছিল না। ১০ হাজার জনের খবরকে তিনি ‘ভুল ব্যাখ্যা’ বলে উল্লেখ করেন।

অন্যদিকে, এডুকেশন মালয়েশিয়া গ্লোবাল সার্ভিসেস (ইএমজিএস) জানিয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ১৩ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়ে। গ্লোবাল স্টুডেন্ট লিভিংয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ২০২৪ সালেই বাংলাদেশ থেকে নতুন আবেদন আসে ৬ হাজার ৯১৭টি।

করদাতাদের টাকায় বিদেশিদের আসন নয়

হাইম হিলম্যান প্রশ্ন তুলেছেন, সরকারের বিপুল অর্থায়নে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীরা কেন বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। তার ভাষায়, এ সুযোগ বিদেশিদের জন্য নয়, মালয়েশিয়ানদের জন্য। করদাতাদের অর্থে পরিচালিত আসনে অবশ্যই মালয়েশিয়ান, অর্থাৎ স্থানীয় মালয়, চীনা, ভারতীয় কিংবা আদিবাসী জনগোষ্ঠী অগ্রাধিকার পাবে।

হাইম হিলম্যান উল্লেখ করেন, মালয়েশিয়ার জনসংখ্যায় চীনা সম্প্রদায়ের হার ২০ শতাংশ হলেও শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের ভর্তি মাত্র ১৩ শতাংশ।

প্রতিযোগিতার ঝুঁকি

হাইম হিলম্যান সতর্ক করেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা স্নাতক শেষে মালয়েশিয়ায় কাজের অনুমতি চাইতে পারে, যা শিক্ষা ও কর্মসংস্থান উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা বাড়াবে। বিশেষ করে চীনের ৩০ হাজারেরও বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী স্থানীয় চাকরির বাজারে চাপ তৈরি করতে পারে বলে তার আশঙ্কা।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি স্নাতকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন, যা বাস্তবায়িত হলে সংকট আরও বাড়তে পারে।

নীতিমালা সংস্কারের আহ্বান

এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় হাইম হিলম্যান সরকারের প্রতি তিনটি আহ্বান জানিয়েছেন। সেগুলো হলো- প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক ভর্তির হার সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখা, ভর্তি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছ তথ্য প্রকাশ্যে আনা ও ভর্তি তদন্তে একটি রাজকীয় কমিশন গঠন। তার মতে, স্থানীয় প্রতিভা লালন এবং উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমেই মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা সম্ভব।

এমআরএম/একিউএফ/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]