বিয়ের পর প্রবাস, যৌক্তিকতা কতটুকু?

আরিফুল ইসলাম আরিফ, কুয়েত থেকে
প্রবাস জীবনের প্রায় চার বছর হতে চললো। সবার শুধু একটাই প্রশ্ন ভাই দেশে যাবেন না? বিয়ে করবেন না? হ্যাঁ, প্রশ্নগুলোর শতভাগ যুক্তিও আছে। বয়সও প্রায় ২৭ এর ঘরে কড়া নাড়ছে। যত সহজ প্রশ্ন, তার চেয়ে শতগুণ কঠিন তার উত্তর।
যে কোম্পানিতে চাকরি করি তাতে ২ বছরে মাত্র ২ মাস ছুটি পাওয়া যায়। অন্যদিকে শুধু কোম্পানির চাকরি নামমাত্র, পার্টটাইম না করলে পেটে-ভাতে চলতে হবে। সবদিক চিন্তা করে ২ বছর পরপর ২ মাসের ছুটি পেলেও পার্টটাইম হারানোর ভয়ে ছুটি নেওয়ার কথা চিন্তাও করি না। আর পার্ট টাইম পাওয়াটাও কঠিন আবার যাকে দিয়ে যাবেন তার যদি লোভ পেয়ে বসে তবে সেটাও সে মালিককে বলে হাতিয়ে নিতে পারে। তখন ছুটি থেকে এসে দেখবেন শুধু কোম্পানির চাকরি, পার্টটাইম আর নেই। সেটা খুঁজতেও আরও ৬ মাস। আর মাথায় ভর করবে একরাশ টেনশন।
এদিকে ২ মাসের ছুটি নিয়ে তড়িঘড়ি বিয়ে করে একটা মেয়েকে তার অচেনা বাড়িতে রেখে আসলেন। এই ২ মাসে যাকে সবচেয়ে আপন মনে হয়েছিলো, তাকে ভর করে অন্যান্যদের আপন করার আগেই সে ২ মাস ছুটি কাটিয়ে আবার প্রবাসে.... স্বামী ছাড়া একজন মেয়ের জন্য প্রায় সম্পূর্ণ অচেনা বাড়িতে নিজেকে সবার সন্তুষ্টি ধরে রেখে চলাটাও কঠিন। আবার যদি এই ২ মাসে বাচ্চা-কাচ্চা না হয় তবে তো এই অচেনা বাড়িটা তার কাছে মরভূমির মতো।
এক্ষেত্রে অনেকে পরামর্শ দেন প্রত্যেক ২ বছর পর পর ছুটিতে যাবি আর একটা করে বাচ্চা রেখে আসবি। তর বউ ওদিকে ব্যস্ত থাকবে আর তুই নিশ্চিন্তে প্রবাসে কাজ করবি। তবে আমি কেনো জানি এই পরামর্শ একদম মেনে নিতে পারি না, মনে প্রশ্ন জাগে প্রবাসীদের বউ কি বাচ্চা উৎপাদনের ও লালন-পালনের মেশিন?
তার চাওয়া-পাওয়া, শারীরিক চাহিদার কোনো মূল্য নেই? বলবেন পুরুষদেরও তো একই! হ্যাঁ, আছে তবে পুরুষ প্রবাসে নিঃসঙ্গ একা থাকে না। সবসময় কাজে ব্যস্ত থাকে আর পুরুষ মানুষের মনের সঙ্গে নারীর তুলনা করবেন না। পুরুষ প্রকৃতিগতভাবে মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়। স্বামীহীন একটা নারীর জন্য আজকের সমাজে চলা কত কঠিন তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।
আমরা চার ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার ছোট। আমার বড় তিন ভাই একটা সময় মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন, এর মধ্যে মেঝো ভাই এখন একটা মুদি দোকান দিয়ে স্থায়ীভাবে দেশে রয়েছেন। ২০১৭ সালে কুয়েত আসার আগে আমি কিছুদিন বাড়িতে ছিলাম। এছাড়া অধিকাংশ সময় পড়াশোনার সুবাদে বাড়ির বাইরে থাকতে হয়েছে। তখন বুঝতে পেরেছিলাম একজন প্রবাসীর বউয়ের জন্য জীবন কত কঠিন।
তেল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব চাহিদার ক্ষেত্রে আমাদের এসে বলতে হতো। ‘ছোট ভাই আজকে একটু বাজারে যাবে?’ অনেক সময় খুশি মনে যেতাম অনেক সময় বিরক্তি নিয়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যাপারে শ্বশুড়-দেবরকে বলা ঠিক আছে কিন্তু মেয়েদের এমন অনেক জিনিসের প্রয়োজন হয় যা তারা শ্বশুড় বা দেবরকে বলতে পারে না।
তাদের স্বামী শুরুর দিকে বাজারে যাওয়া নিষেধ থাকলেও ধীরে ধীরে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর কেনার জন্য শাশুড়িকে নিয়ে বাজারে যাওয়া শুরু হয়, কিছুদিন পর শাশুড়িও আর যেতে চায় না তখন রবীন্দ্রনাথের ‘একলা চলো’ গানটায় যেনো তার টিকে থাকার একমাত্র পথপ্রদর্শক। এখন আবার অধিকাংশ পরিবার ভিন্ন ভিন্ন, আগের মতো যৌথ পরিবারের ব্যবস্থা আর নেই। সেক্ষেত্রে একা একটা মেয়েকে পুরো পরিবার সামাল দেওয়া অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে অধিকাংশ প্রবাসী ১৬ থেকে ১৮ বছরের মেয়েদের বিয়ে করে। সেক্ষেত্রে মাত্র ২ মাস স্বামীর সহচার্য পাওয়া বয়সন্ধিকালীন একটা মেয়ের জন্য নিজেকে কন্ট্রোল করা হাতে আগুনের জলন্ত কয়লা রাখার মতোই কঠিন। অনেকে রাখতে পারে অনেকে পথভ্রষ্ট হয়ে পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে যায়। যা একটা সুস্থ পারিবারিক সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার প্রধান অন্তরায় হতে পারে।
আমি একজন প্রবাসী হিসেবে এই জুলুম মন থেকে মেনে নিতে পারি না। আমি প্রবাসে যাওয়া বা থাকার বিরোধী নয়। তবে আমার মতে বিয়ের পর ‘প্রবাস’ নয়। গেলেও প্রতি ৬ মাস অন্তর অন্তর দেশে পরিবারের কাছে ফিরতে হবে।
তাই বয়স যতোই হোক যখন মনে হবে দেশে গিয়ে কিছু করতে পারবো, ঠিক তখনি প্রবাসকে সালাম বলে বিদায় জানাবো ইনশাআল্লাহ। আর বিয়েটা ঠিক তখনি!
এমআরএম/এএসএম