এমন বোকা মেয়ে আমার পেটে ছিল!

এতক্ষণ পর্যন্ত একটা টু শব্দও করেনি লাবণ্য-রাশেদ। দুজনেই ইতিহাসের গল্প মনযোগ দিয়ে শুনেছে। এই প্রথমে রাশেদ বললো, বাক্যটা শেষ করেন। অনেকেই কি বলছে? তমিজ প্রামাণিক কোনো কথা বললো না, খুক খুক করে কাশলেন।
জমিদার খুন করাইছেন কিংবা বেগম আম্মা খুন করাইছেন, তাই না?
এমন কোনো প্রমাণও নাইকা, কিন্তু মাইনসে কানাঘুসা করে তিনটা খুন এক রাইতে হলো কোনো সাক্ষী ছাড়া। মানুষ কি বলে সেইটা আপনার চিন্তার বিষয় না, আমাদেরও না, আপনি কি ভেবেছেন সেটা বলেন।
জ্বী, তাদের হাতে বিচারের দায়িত্ব ছিল, সঠিক মনে হলে তারা যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। তবে উপরওয়ালার হিসাব আলাদা।
এতক্ষণ পর লাবণ্য বললো, এখানে বড় নানার দোষ কোনটা? রায় দেওয়া নাকি তিন খুনের নির্দেশ দেওয়া? আমি তার কোনো দোষ দেখি না, একটা ছোট্ট ভুল ছাড়া। বরং গর্ববোধ হচ্ছে আমার বড় নানা এবং নানু দুজনেই অত্যন্ত বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন।
বড় নানা হয়তো রায়টা আরো পেছাতে পারতেন। কিন্তু তার হাতে তো আসলেই সাক্ষী ছিল না কোহিনুরকে ওই চক্রান্ত থেকে বাঁচানোর, কোহিনুর বাড়ি ছেড়ে পালাতে পারতো, কিন্তু কোথায় যাবে, হয়তো সেই জায়গা ছিল না।
রাশেদ বললো তু্ই নিশ্চিত হলি কিভাবে যে দাদাজান তিন খুন করাইছেন? দাদিজান বা অন্য কেউ না?
সংসার টিকইতে হবে না? সুন্দরী বেগম গোস্বা করেছে, এই বেগমের মন ঠিক করতে তো সাত খুনের অর্ডারও দেওয়া যায়। আর বড় নানা তো তিনটা কিট সাফ করছেন মাত্র, গ্রাম শান্তি, ঘর শান্তি, মন শান্তি। বলেই হি হি হি করে হাসতে লাগলো লাবণ্য।
মজা করলাম মামা, সিরিয়াস হয় না, অনেকক্ষণ ধরে ইতিহাস শুনতে শুনতে বিবস হয়ে গেসিলাম, আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী, সবকিছু যুক্তি দিয়ে চিন্তা করি।
বড় নানু খুনের নির্দেশ দিলে রায়ের আগেই দিতো, কোহিনুরকে তাহলে মরতে হতো না। জমিদারের ওপর ভরসা ছিল, কিন্তু বুঝতে পারেননি পুরুষজাতির ওপর সবসময় পুরোপুরি ভরসা করতে নেই।
আর অন্য কেউ! কোথাও কেউ নেই যে। কোহিনুরের বাবা হাফ ছেড়ে বাঁচছে মেয়ে মরে যাওয়ায়, তার যৌতুকের টাকা বাঁচছে।
সে যাবে খুন করাতে? প্রশ্নই ওঠে না।
আর কলিম! সে যদি সত্যি কোহিনুরকে ভালোবাসতো তাহলে সালিসের আগেই কোহিনুরকে বিয়ে করতো নয়তো পিটিয়ে সাইদুলকে মেরে ফেলতো, ওই বেটাও মেনি মাছ।
যাইহোক কবিরাজ সাহেব, এখন আপনার বক্তব্য বলেন, আমাদের উঠতে হবে, অনেক কাজ।
আপনারা জমিদারের জন্য দোয়া করেন, কুরআন খতম দেন, আর দোয়া জিকির আপনারা নিজেরা পড়বেন। পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে, নাতি-পুতিদের দোয়া কবুল হয়, তারা আপনজন। টাকা দিয়ে মানুষ ডেকে দোয়া বা কুরআন খতম মুর্দার কাছে পৌঁছায় না আম্মাজান।
জ্বী, এটা আপনি একদম ঠিক বলেছেন, নিজের মানুষের দোয়া নিজেদেরই করতে হয়। টাকা দিয়ে দোয়া কেনা যায় না। আমি যে হুজুরের কাছে কুরআন পড়া শিখেছি, তিনিও একই কথা বলেছেন।
সমস্যা নাই, আমি আর রাশেদ মামা নামাজ পড়ে বড় নানার জন্য দোয়া করবো, নানুর জন্যও করবো, আমি কুরআন খতমও দেব তাদের নামে।
আচ্ছা আপনার কাছে কি কোহিনুরের বোনের ঠিকানা আছে? থাকলে দেন, আর তার নাম কি পান্না না রুবি?
ঠিকানা তো জানি না আম্মা। তবে তার নাম রুবি, আপনে জানলেন কেমনে?
তার নাম রুবি আমি আগে জানতাম না, আন্দাজে ঢিল দিসি, লেগে গেছে, গ্রামদেশে কোহিনুরের বোন থাকলে নাম হীরা, রুবি, পান্নাই হওয়ার কথা। তবে আমার আসলেই তাকে দরকার।
তাকে কেন লাগবে?
তার চোখে যদি ছানি না পড়ে থাকে তাহলে সামনে গিয়ে দেখতাম আমাকে দেখে আপনার মতো বেগম আম্মা বলে চমকায় কিনা। বলে আবারো হাসি।
আচ্ছা আজ আমরা আসি, আপনি চাইলে আমি নানাকে বলে আপনার চোখের ছানি কাটার ব্যবস্থা করতে পারি।
জ্বী আম্মা, আপনি সাক্ষাত বেগম আম্মা
জ্বি না, আমি লাবণ্য, শেহনীন ইসলাম লাবণ্য। আমার ওপর কারোর ভর নাই, তবে কারো চেহারার সঙ্গে অর্ধেক মিল আছে হয়তো।
আপনি আমাকে একটা বিশাল চিন্তা থেকে বাঁচিয়েছেন। এজন্য ধন্যবাদ।
এবার সময় কম, তা না হলে আপনার বশীভূত জিনদের সঙ্গে কথা বলে যেতাম। এর পরেরবার আসলে মামাকে সঙ্গে নিয়ে আসবো জিনদের সঙ্গে গল্প করতে।
আপনার অনেক সাহস আম্মা। ধারণার বাইরে।
অবশ্যই আমার অনেক সাহস, সাহস আমি আমার আব্বুর থেকে পেয়েছি। আমার আব্বুর অনেক সাহস, আসলেই ধারণার বাইরে।
লাবণ্য ও রাশেদ ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
আম্মা একটা কথা বলি?
লাবণ্য ঘুরে দাঁড়ালো, জ্বি বলেন!
এই দুনিয়ায় আমরা সবাই পরীক্ষা দিতে এসেছি। দুনিয়া পরীক্ষার ক্ষেত্র। পরকাল হলো পরীক্ষার ফলাফল, দুনিয়ায় যার যত বেশি বুদ্ধি তার পরীক্ষা ততো কঠিন আম্মা, আপনি সাবধানে থাকবেন।
আপনি বলতে চাচ্ছেন, আমার সামনে বিপদ? ভবিষ্যতবাণী করছেন?
নাহ আম্মা, আমি ভবিষ্যৎ বাণী করি না, ধর্মে নিষেধ আছে, আব্বা মানা করে গেছেন। আমি শুধু দুনিয়ার পরীক্ষার ধরণ বললাম।
জ্বি, আমার জন্য দোয়া করবেন। আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম, অবশ্যই দোয়া করবো বলে তমিজ কবিরাজ দাঁড়িয়ে থাকলো, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের চলে যাওয়া দেখা যায়, এরপর চশমা খুলে গেঞ্জির কোনা দিয়ে মুছতে লাগলো।
মামা, এতক্ষণে উজ্জ্বল সাদা রঙ আর তিন সংখ্যার রহস্য বুঝলাম, উজ্জ্বল সাদা কোহিনুর এবং তিন হলো ওই তিন মিথ্যাবাদী।
হুম...
আজকে বাড়িতে বিয়ে মামা, তাড়াতাড়ি চলো খিদা লাগছে, বিকেলে আবার আর এক প্রজেক্ট।
তু্ই তো আমাকে তপসে বানিয়ে দিলি, তু্ই ফেলুদি! আসলে তো উল্টা হওয়ার কথা ছিলো। আমি মামা, তু্ই ভাগ্নি।
বললে ভালো কিছু বলো মামা, নামের আগে ফেলু শুনতে কেমন ফেল্টুস ফেল্টুস লাগে। আর তোমার বুদ্ধি তপসের লেভেলের হলে আমি কি করবো বলো।
ওহ, আচ্ছা তু্ই তাহলে শেহনীন হোমস?
উফফ মামা, বেটা গোয়েন্দাদের নামের লেজ আমার কেন নিতে হবে? আমার কি নিজের নাম নাই? ওই নামগুলো পুরুষশাসিত সমাজের পুরুষ লেখকদের কল্পনা, কোনো বুদ্ধিমান নারী লেখক থাকলে আমাকে নিয়ে সিরিজ লিখতো গোয়েন্দা এস আই লাবণ্য ‘‘Dietective S I Labonno’’ হা হা হা হি হি হি।
লিখবে, চিন্তা করিস না। অবশ্যই কেউ না কেউ লিখবে তোকে নিয়ে।
আমি মোটেই চিন্তা করছি না, মাথায় অন্য চিন্তা।
আচ্ছা মামা আমি একটু আগে তিন শালিক দেখলাম কাঁঠাল গাছের ডালে, এখন আবার দেখছি তিনটা হাঁস বিলের পানিতে। সমস্যা তো সমাধান, তাহলে আবার এসব দেখছি কেন?
দাদি আম্মাকে জিজ্ঞাসা কর, তোর সঙ্গেই না আছে।
দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠলো।
ওরা চলে এসেছে প্রায় জমিদার বাড়ির কাছাকাছি। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে মন্টু নারিকেল গাছে উঠছে ডাব নামাতে।
তাদের দেখে নারিকেল গাছের আগা থেকেই চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো পাখির জোড়া মিলছে খালা, আজকে কইছেন বিয়া।
হুম, অবশ্যই আজ বিয়ে।
আচ্ছা মামা, নিচতারার বয়স কেমন?
আমাদের মতোই বা দুই এক বছরের বড় হতে পারে।
এই বয়সের গ্রামের মেয়েদের তো বিয়ে হয়ে যায়, ওর বিয়ে দেয় না কেন?
কোত্থেকে দেবে? টাকা নাই, দুই মেয়ের রোজগারেই তো চলে বাপ-মা, দুনিয়া বড় কঠিন বুঝলি, কবে জানি আর এক কোহিনুর কাহিনি হয়।
কী যে বলো না মামা, নিচতারা অনেক বুদ্ধিমতি।
তোরও তো অনেক বুদ্ধি, তোর মায়ের হাত থেকে বাঁচতে পারছিস? জীবন তো কারাগার বানায় দিসে।
ওরা জমিদার বাড়িতে ঢুকলো। অন্দর মহলের উঠানে একটা রূপালী ঝকঝকে ইলিশ মাছ, আর বিশাল মাথা মোটা কাতলা মাছ শুয়ে আছে।
কি রে তোরা দুইজন সাত সকালে কই ডুব দিছিলি? নিতু জিজ্ঞাসা করলো।
রাশেদ বললো, বিলের পানিতে মাছ ধরবো। তাই পানি মাপতে গেছিলাম। অরণ্য দৌড়ে এলো, তোমরা আমাকে না নিয়ে ঘুরতে গেলে কেন?
তু্ই ঘুমাচ্ছিলি, এরপর গেলে তোকে নিয়ে যাব।
আখতারুন্নেচ্ছা বললেন, ইলিশ মাছ কিভাবে রানবো লাবণ্য?
সাদা ভুনা নানু। ইস তোমার হাতের সাদা ইলিশ কি যে মজা।
রিতা হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এসে বললো, লাবণ্য তুমি এত সকালে আমাকে না বলে কই গেছ?
তুমি ঘুমিয়ে ছিলা আম্মু, নানুকে বলে গেছি তো। মামাও আমার সঙ্গে ছিল।
আমি চিন্তা করতে করতে শেষ, তোমার মাথা ভরা গোবর। আর রাশেদের কোনো ভরসা আছে? অচেনা জায়গা। তুমি আমাকে না বলে বের হবে না।
হ্যাঁ তুই ভরসার রানি, দুলাভাই তোরে সহ্য করে কেমনে? তু্ই তো তার জীবন নরক বানায় দিছিস।
অচেনা জায়গা কই? লাবণ্যর মাথায় গোবর থাকলে তোর মাথায় গরুর লেজ ছাড়া কিছু নাই। যেটা কোনো কাজের না। আর আমি থাকতে এই পুরো গ্রামে কার এতো বুকের পাটা কিছু বলবে। আজব, খালি খালি গায়ে পরে কিচ্ছা বানাবে।
চুপ কর বেয়াদপ ছেলে, আমার মেয়েকে তু্ই আমার চেয়ে বেশি চিনিস? তাকে আমি দুইটা কোচিংয়ে দিসি, এমন গাধী কোচিংয়ের সব নোট তার দুই বান্ধবীকে দিয়ে দিসে ফ্রি, বলে চাইছে যে। তার দেওয়া নোট পড়ে তার বান্ধবীর রোল ৩ আর লাবণ্যর ৫, সে পরীক্ষার আগের দিনও বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ে। এমন বোকা আমার পেটে ছিল!
হ, এইটা ঠিক বলছিস, তোর মতো ছাগলের পেটে এই মেয়ে মানায় না, তু্ই রোল ধুয়ে পানি খা।
আখতারুন্নেচ্ছা জোরে ধমক দিলো এই তোরা চুপ করবি।
কি শুরু করছে সকালবেলা, একদম চুপ।
লাবণ্য, রাশেদ নাস্তা কর।
নিচতারা এসে বললো, বড়পা পাশের বাড়ির চাচি আসছিল সকালে, আপনার সঙ্গে কথা বলতে। আপনি ঘুমায় ছিলেন, উঠলে পরে যেতে বলছে।
ওহ তাই, আম্মা আমি যাই চাচির সঙ্গে দেখা করে আসি, নিতু যাবি?
নাহ, তুমি যাও…
রিতা গেলো
রাশেদ নিচতারাকে বললো তোর কি লাগবে বল, একটা উপহার পাওনা থাকলো এই মহৎ কাজ করার জন্য।
বাকি সবাই হাসছে...
মন্টু এসে বললো লাবণ্য খালা, কইতর দুইটার গোসল করাই, তারা বেজায় খুশী আমি কছি আজকের তোদের বিয়া। এদের দুইটা নাম দেন, বিয়ে পড়াইতে সুবিধা হবি।
হুম, ‘কোহিনুর আর কলিম’।
চলবে…
এমআরএম/জেআইএম