মাল্টিকালচারাল আমেরিকার গল্প

‘নিউইয়র্কের গ্লোরিয়া’

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:৪৩ পিএম, ২১ জানুয়ারি ২০২৩

শান্তনু সরকার, ক্যালগিরি, ক্যানাডা

সাজ্জাদ আলীর লেখা ‘নিউইয়র্কের গ্লোরিয়া’ উপন্যাসটা হাতে এসেছে সপ্তাহখানেক আগে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে পাঞ্জেরী থেকে। আমি প্রবাসী বলেই কিনা জানি না, দেশের বাইরের প্রেক্ষাপটে লেখা গল্প বা উপন্যাসের প্রতি এক ধরনের আগ্রহ কাজ করে। সেই আগ্রহ থেকেই বইটি সংগ্রহ করেছিলাম।

হুমায়ূন আহমেদের একটা উপন্যাস আছে ‘নক্ষত্রের রাত’—আমেরিকার পটভূমিতে লেখা। ইমদাদুল হক মিলন লিখেছেন ‘পরাধীনতা’। প্রেক্ষাপট জার্মানি। অসাধারণ দুটি উপন্যাস। তবে সে দুটো উপন্যাসের সঙ্গে ‘নিউইয়র্কের গ্লোরিয়া’-এর প্রধানতম পার্থক্য হচ্ছে, এই উপন্যাসে বাঙালির গল্প বা আবেগ অনুপস্থিত। তাহলে এই বইয়ের গল্পটা কী? এক কথায় বলব, মাল্টিকালচারাল আমেরিকার গল্প।

আমেরিকা—নেভার নেভার ল্যান্ড। সবাই যেতে চায় স্বপ্নের এই দেশে। বিভিন্ন দেশের মানুষ যুগে যুগে এই ‘না ফেরার দেশে’ পাড়ি জমিয়েছে, ইমিগ্রেশন নিয়েছে। নানা দেশের নানা ভাষা, সংস্কৃতি এখানে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এসব ইমিগ্রান্টরাই তিলে তিলে আমেরিকাকে সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। আমেরিকার উত্থানের গল্প আসলে এসব ইমিগ্রান্টদেরই জীবনগাঁথা। তেমনই কিছু ইমগ্রান্টের গল্প পাবেন ‘নিউইয়র্কের গ্লোরিয়া’-তে।

নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্লোরিয়া। সে ভারতীয় বাবা ও ফিলিপিনো মায়ের আমেরিকান সন্তান। আর বাংলাদেশের ছেলে ফিরোজ নিউইয়র্ক সিটি ইউনির্ভার্সিটিতে পড়ে।

এই ফিরোজ কিন্তু বাংলাদেশি না হয়ে ফিলিস্তিনি বা স্প্যানিশ হলেও কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি ছিল না। কারণটা আগেই বলেছি, এই উপন্যাসে বাঙালির গল্প বা আবেগ অনুপস্থিত। একজন বাঙালির দৃষ্টিকোণ থেকে আমেরিকাকে দেখা হয়নি। এটা আমেরিকান সমাজেরই ছবি।

গ্লোরিয়া এবং ফিরোজ ছাড়াও গল্পে বেশ কিছু চরিত্র এসেছে। যেমন হার্ভাড ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক অনিমেষ দত্ত, মেক্সিকান-আমেরিকান টমাস দিয়াগো, স্প্যানিশভাষী যৌনর্কমী জুলিয়া, ককেশিয়ান-আমেরিকান জ্যাকুলিন, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ক্রিস্টোফার, বাংলাদেশি মেয়ে আলেয়া, পেশাদার বিয়ের কনে সিনথিয়া, পার্টটাইম যৌনকর্মী চাইনিজ-আমেরিকান লি জিং। তাদের সবার আলাদা আলাদা গল্প আছে।

তবে শেষ পর্যন্ত নিউইয়র্কের গ্লোরিয়া এক নিটোল প্রেমের উপন্যাস। ফিরোজ ও গ্লোরিয়ার কাছে আসার গল্প। একই সাথে আমেরিকান সমাজের এক ঝকঝকে ছবি।

নির্মোহভাবে যদি বিশ্লেষণ করি, তবে বলতেই হয় দেশের বাইরের প্রেক্ষাপটে লেখা এ উপন্যাসটা একেবারে অন্যরকম। সেটা ক্যারেকটার বিল্ডআপের দিক দিয়ে, ঘটনার দিক দিয়ে, ভাষার দিক দিয়ে। এই উপন্যাসটা পড়ার পর একটা বিষয় সহজেই উপলব্ধি করা যায়। সেটা হলো মানব জীবন সম্পর্কে লেখকের অন্তর্দৃষ্টি। লেখক পরম মমতায় এক একটা চরিত্র নির্মাণ করেছেন। কোথাও কোনো খুঁত রাখেননি।

সাজ্জাদ আলীর গদ্যভাষা থেকে প্রাচীণ এক ধোঁয়া বের হয়। দূর অতীত থেকে ভেসে আসে আমাদের কাছে। গাড়িটা বা গাড়িটি না লিখে তিনি লেখেন গাড়িখানা। আমরা আচ্ছন্ন হই সেই প্রাচীন ধোঁয়ায়। মনে হয়, শৈশবে ফিরে গেছি। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আর আমরা কলকাতার কোনো লেখকের ৭০-এর দশকের উপন্যাস পড়ছি। এই গদ্যভাষার মজা অন্যরকম। প্রথম প্রথম হয়তো একটু খটকা লাগবে। একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে ভালোবেসে ফেলবেন। সেই প্রাচীন গদ্যে যদি ঝকঝকে আধুনিক কোনো গল্প লেখা হয়, তবে কেমন হতে পারে সেই গল্প?

কারো হয়তো ভালো লাগবে। কারো লাগবে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি উপভোগ করেছি। সাজ্জাদ আলী একজন স্টোরিটেলার। গল্পটা বলতে জানেন, খেই হারিয়ে ফেলেন না। এবং সেই গল্পে আটকে রাখতে জানেন মানুষকে। আমি আটকে ছিলাম। এবং এক রাতে বইটা পড়ে শেষ করেছি।

বইয়ের দুর্বল দিক হলো এর প্রচ্ছদ। পুরো বই পড়ে যে গ্লোরিয়াকে মনে মনে কল্পনা করেছি, প্রচ্ছদের গ্লোরিয়াকে দেখলে সেই ইমাজিনেশন ধাক্কা খায়। কল্পনাগুলো উল্টো ঘুরে দৌড়তে শুরু করে। বাংলাদেশের সাধারণ কোনো গ্রাফিক্স ডিজাইনারও এরচেয়ে ভালো মানের প্রচ্ছদ করতে সক্ষম। এ জায়গায় আরেকটু মনোয়োগ দেওয়াই যেত।

পাঞ্জেরীর বইয়ের মান নিয়ে কোনো কথা নেই। আমি বরাবরই তাদের বইয়ের মেকাপ, গেটাপের ভক্ত। লেখকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। তবে তার নাম আমি শুনেছি। টরন্টোয় বেশ বিখ্যাত লোক সাজ্জাদ আলী। বাংলা টেলিভিশন কানাডার প্রধান ব্যক্তি। লেখক হিসেবেও সুপরিচিত।

দেশে-বিদেশে পত্রপত্রিকায় তার লেখা প্রায়শই চোখে পড়ে। এটা তার প্রথম উপন্যাস কিনা নিশ্চিত নই। যদি প্রথম হয় তাহলে বলতেই হচ্ছে, অনেক বড় বড় লেখকের প্রথম উপন্যাসের চেয়ে এই প্রথম বেটার। আমি তার দ্বিতীয় উপন্যাসের জন্য অপেক্ষা করব।

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]