অস্ট্রেলিয়া দিবস আজ

মায়ায় মায়ায় জীবন মায়াময়

শায়লা জাবীন
শায়লা জাবীন শায়লা জাবীন
প্রকাশিত: ০৫:৩৯ পিএম, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩
ছবি- সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়া দিবস আজ। এ উপলক্ষে সপ্তাহের মাঝে সরকারি ছুটি পেয়েছি। ঘুম ঠেলে সকালে উঠে অফিসে দৌড়াতে হয়নি। এ যেন এক অন্যরকম শান্তি। বেশ দেরিতেই ঘুম থেকে ওঠা এবং ইংলিশ ব্রেকফাস্টের এক্সট্রা স্ট্রং টি-ব্যাগ দিয়ে লো ফ্যাট মিল্কে বানানো কড়া চা পান করতে করতে লিখতে বসে গেলাম।

এখন গ্রীষ্মকাল, মাঝে মধ্যে কিটকিটে চামড়া পোড়ানো গরম পড়ে, এ ধরনের বের হয়ে হাহা হিহি করার মতো ‘অজি’ (প্রতিবেশী) আমি এখনো হতে পারিনি। তাই ঘরের কোনোই ভালো, ভাবছি ইশ যদি প্রতি সপ্তাহের মাঝে এমন ছুটি পাওয়া যেতো, জীবনটা আর একটু সহজ হতো। আরও অনেক কথা লিখে ফেলা যেতো।

সে যাক গে, আজ অস্ট্রেলিয়া ডে, বুঝে হোক, না বুঝে হোক বা কপালের গুণ/দোষ এ হোক প্রায় ১৫/১৬ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় আসা। আমার মতো এখানে অনেক দিন ধরে থাকা সবাই এক বাক্যতেই স্বীকার করবেন ইহা একটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। এত শান্তিপূর্ণ স্থিতিশীল এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দেশ খুব কমই আছে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে কোনো পরিবর্তন শুরু করতে হয় নিজের ঘর থেকে, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলাতে পারলে সমাজের পরিবর্তন আসে না, যতই মাঠে ময়দানে গলা সাধেন, ফলাফল শূন্য। সময় নষ্ট, গলাব্যথা ছাড়া কিছু হয় না।

একটা দেশের উন্নতি নির্ভর করে সে দেশের নাগরিকরা কতটা মানসিকভাবে শিক্ষিত সেটার ওপরে, প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়। এজন্যই ব্রিটিশ আর্মির বেশ কিছু সদস্য কিছু কনভাইট আর খাঁটি অস্ট্রেলিয়ান অ্যাবরিগিনদের নিয়ে গড়ে তুলেছিল যে অস্ট্রেলিয়া সেই দেশ খুবই অল্প সময়ের মধ্যেই পৃথিবীতে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে বেশি সময় নেয়নি।

আজকে লিখছি কিছু আসল অস্ট্রেলিয়ানদের গল্প, নাগরিক হিসেবে কিছুটা দায়িত্ববোধ থেকে। যারা আমার মতো না ঘরকা না ঘাটকা পাবলিক না। জন্মসূত্রে পাথুরে লাল মাটিতে জন্মানো খাঁটি অস্ট্রেলিয়ান।

আমার সদ্য নয় বছরের ছেলে, সপ্তাহ দুই আগে আমাকে এসে বললো, মা তুমি কি জানো পৃথিবীতে কোন প্রাণী সবচেয়ে বুদ্ধিমান? তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে।

জিজ্ঞাসু নয়নে তাকালাম কোনো প্রাণী?
ফুল চার্জ হয়ে আসা ছেলে দ্বিগুণ উৎসাহে উত্তর দিলো, মানুষ আর শিম্পাঞ্জি!
উত্তেজনায় সে আর বাংলা বলতে পারলো না, ফেরত গেলো ভাইয়ের ভাষায়। (সে তার ভাইয়ের সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বলে)

একটানা সে বলে গেলো...

You know Mum, The most Smartest Animal on Earth is Humans and Chimpanzees!
Did you now that Chimpanzees DNA is 98.8 percent same as Humans?
How it's possible Mum?
The first part is ok Humans, but how the next one Chimpanzees...!
I saw them at Zoo...
I have no similarity with Chimpanzees...
Not even 2%...
I'm not even look like them, I'm Hansome & thousand times smarter Then Chimpanzees.
I'm very much upset...
I should be investigate this...,
I have to change my proffession,
Most probably I will be a Scientists or Researcher.
Not Teacher or Engineer any more...
It's not fair...They teaches us wrong...!
What you think?

হাসি আটকানো যে কত কষ্টের সেটা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। বেশ কঠিন কিন্তু হাসি হাসি চেহারা বানিয়ে বললাম, আচ্ছা তাই তো, তুমি গবেষণা করে বের করো সত্যটা, আমি আশায় আছি...

ইনশাল্লাহ একদিন পৃথিবীর বিখ্যাত সাইন্সটিস্ট হয়ে ভুলগুলো সব শুধরে দিও বাবা, খুবই দরকার এসব ভুল শোধরানো।

তবে হয়েছে কি, যেসব মানুষরা বেশি পাজি, মায়ের কথা শোনে না, তাদের ওপর বিরক্ত হয়ে উপরওয়ালা কিছু মানুষকে শিম্পাঞ্জি বানিয়ে দেন বাকি জীবনের জন্য, এজন্যই ওদের সঙ্গে মানুষের ডিএনএতে মিল বেশি পাওয়া যায়।

সঙ্গে সঙ্গে সে উত্তর দিলো...
That's really a good news, tell your older son please...
He didn't listen you.
I always listen my Mum.

বলে সে তার খেলায় মনোনিবেশ করলো।

এটা হলো রিয়েল অস্ট্রেলিয়ানদের একটা বৈশিষ্ট, এরা যা পড়ে বা শোনে তাই মেনে নেয় না, নিজের বিচার বুদ্ধি খাঁটায়, নিজের কাছে যেটা ঠিক মনে হয় সেটাই মেনে চলে। ঠিক মনে না হলে মানবে না, কি বুঝলেন?

অফিসে আমার টিম লিডার খাঁটি অস্ট্রেলিয়ান। আমাকে ‘শায়’ নামে ডাকে, নাম ছোট করতে অস্ট্রেলিয়ানদের জুড়ি মেলা ভার, শায়লা বলতেও ওদের বেশ কষ্ট... অনেক বড় নাম বলে!

গত বছর একদিন বিকেলে খুবই ভয়াবহ একটা ‘‘Distress Case Deal’’ করে আপসেট হয়ে টিম লিডারকে ইন্টারনাল মেসেজ পাঠালাম, কাজে মনোযোগ দিতে পারছি না কারণ এই।

সে আমাকে পার্সোনাল ব্রেক নিয়ে কিচেনে বসে কফি খেতে বললো, আমি আমার ডেস্ক থেকে উঠে কিচেনে কফি বানিয়ে নিয়ে বসে আছি আর দূরের পাহাড় দেখছি, ৯ নম্বর ফ্লোরে বসতাম তখন, চমৎকার ভিউ, হঠাৎ দেখি টিম লিডার এসে আমার ঠিক উল্টা পাশের চেয়ারে বসলো...

শায় কফিতে সুগার দিয়েছিলে?
(আমি চা কফিতে সুগার খাই না)
আজ তো মনে হয় সুগার লাগতো...!

হেসে বললাম, কফি একদম ওকে, কিন্তু তুমি এমন জায়গায় বসেছো যে আমার পাহাড় দেখা আটকে গেলো..., ৫৫+ বয়সের টিম লিডার হেসে বললো, কবিতা তো আর লিখেছিলে না, তাকিয়ে ছিলে, আমিও ছোট খাটো পাহাড়... আমাকেই পরবর্তী তিন মিনিট সহ্য করো প্লিজ।

শোনো, কাজে অনেক বাজে এবং ভয়ানক অভিজ্ঞতা হবে...মন খারাপ হবে...কাজ ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করবে, তখন কাজ থেকে ব্রেক নেবে, যা করতে ভালো লাগে সেটাই করো, এমনভাবে নিজেকে রিকভার করবে যেন ঘটে যাওয়া পেইনের চেয়ে মনের আনন্দ, জোর বেশি থাকে।

আর পাঁচটা বাজলেই অফিস ভুলে যাবে পরের দিন সকাল ৯টার আগে অফিসের কিছুই মাথায় ঢোকাবে না। একদমই না... তবে সকাল ৯টার পর আবার তোমাকে ভুলে যেও, তখন শুধু তোমার কাজ মাথায় রাখবে, জগৎ, সংসার, কবিতা কিছুই না, দেখো তুমি একদমই ওকে থাকবে...

দুই জীবন মিলিয়ে ফেলবে না কখনো, আমি এখন উঠি মিটিং আছে, তোমার জন্য আমিও পাঁচ মিনিট ব্রেক নিয়ে এসেছিলাম, কফি শেষ করো, দরকার হলে আর এক মগ বানাও এবার সুগার দিয়ে, আমি বানিয়ে দেব?

বললাম, না ঠিক আছে, অনেক ধন্যবাদ। তুমি তোমার মিটিংয়ে জয়েন করো প্লিজ, আমার লাগলে বানিয়ে নেবো।

আমার টিম লিডারের কোনো মাস্টার্স ডিগ্রি বা পিএইচডি নেই কিন্তু সে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি ডিপার্টমেন্টের টিম লিডার কারণ তার সে যোগ্যতা আছে। সে জানে প্রফেশনাল লাইফে কলিগদের সঙ্গে কাজের চেয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গায় একজন বাংলাদেশি সরকারি ম্যানেজারের চরিত্র চিন্তা করলে আমরা পার্থক্যটা এমনিতেই বুঝে যাবো। আমার লেখার প্রয়োজন নেই।

অস্ট্রেলিয়া প্রতিটি কাজেই ব্যক্তিগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা ও মানসিক স্থিরতাকে গুরুত্ব দেয়, একাডেমিক সার্টিফিকেটের চেয়ে, এরা আগাবে না তো কারা আগাবে?

বছর দশেক আগের কথা, খুবই ভোরে দরজা নক করছে কেউ, কনকনে শীতকাল লেপের ভেতর থেকে উঠাই অনেক কষ্ট,
বাংলাদেশ হলে ভাবতাম দেশের বাড়ি থেকে কেউ এসেছে এস আর পরিবহনের নাইট কোচে, সাথে গাছের আম কাঁঠালসহ অনেক কিছু আর দৈ।

যাই হোক, কষ্ট করে উঠে হিটার অন করে ঘড়ি দেখতে দেখতে দরজা খুললাম, ৬টার মতো বাজে, হাই উঠছে তখনো, খুবই বিব্রত হয়ে হাত দিয়ে ঢাকার চেষ্টা...

দেখি বাসার উল্টো দিকের ডান পাশের প্রতিবেশী দাঁড়িয়ে। খুবই বিনয় আর অপরাধীর মুখ করে ঘুম ভাঙানোর জন্য এক্সট্রিমলি সরি বলে জানালো, সে প্রাতঃভ্রমণে যাচ্ছিলো, হঠাৎ দেখে আমার মেইন দরজায় চাবি ঝুলছে!

বললো দেখলাম সেখানে তোমার গাড়ির চাবিও আছে, তুমি মনে হয় গতকাল ভুলে গেছো, এমনটা হয়। কিন্তু যে কেউ চাইলে তোমার বাসায় ঢুকে পড়তে পারে বা তোমার গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারে, এখনো বেশ সকাল বেশি লোকজন বের হয়নি, তাই ভাবলাম তোমাকে জানাই, আমি আবারো খুবই দুঃখিত ভোরবেলায় তোমার ঘুম ভাঙানোর জন্য! তুমি কিছু মনে করোনি তো?

কি বলবো জানি না, অনেক ধন্যবাদ দিয়ে কফি অফার করলাম, সে পাল্টা ধন্যবাদ দিয়ে সকাল ৫টায় কফি খেয়েছে, এখন আর খাবে না বলে বিদায় নিলো। আমি তার হেঁটে চলে যাওয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম যতক্ষণ দেখা যায়। এরপর চাবি নিয়ে ঘরে ঢুকলাম।

এমন গল্প শত শত আছে, লিখতে বসলে লেখা ফুরোবে না, উপন্যাস হয়ে যাবে। যেমন ঠিক ১৫ বছর আগে প্রথম ক্রিসমাস হলিডেতে মেলবোর্ন থেকে ব্রিসবেন এবং সিডনি যাওয়ার পরিকল্পনা। ২৩ সে ডিসেম্বর রওনা দেবো, ২২ তারিখ রাতে পাশের বাড়ির প্রতিবেশি দুজন খুবই বয়স্ক কাপল থাকেন।

তাদের বলে আসলাম, যেহেটু ফ্লাই করছি গাড়ি বাসায় থাকবে, লক আপ গ্যারেজ না...কারপোর্ট, সুতরাং ওনারা যেন বাসা ও গাড়ি দেখে রাখেন। যদিও অস্ট্রেলিয়া খুবই নিরাপদ দেশ, খারাপ কিছুই কখনো ঘটেনি কখনো, আলহামদুলিল্লাহ, কিন্তু মাত্র ছয় সাত মাস হলো বাংলাদেশ থেকে আসায় মনের খচখচানি তখনো যায়নি।

তিনি পরদিন ভোরবেলা আমাদের বের হওয়ার আগেই দরজা নক করে একটা ক্রিসমাস কেক আর তার গাছের লেবু দিয়ে গেলো, আমি একটু ইতস্তত করছি যেহেতু ৫ মিনিট পর বের হবো প্রায় ১০ দিনের ছুটি, তিনি বুঝতে পেরে বললেন, সঙ্গে করে নিয়ে যাও, ফ্রেন্ডদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খেও। বললাম ক্রিসমাস তো আরো দুই দিন পর, তুমি এতো আগেই কেন কেক বানালে?

বললো এটা তোমার অস্ট্রেলিয়া তে প্রথম ক্রিসমাস, আমি প্রতিবেশী হয়ে তোমাকে ক্রিসমাস এর কেক খাওয়াবো না! এতো খারাপ প্রতিবেশী আমি না, আমার কালচার আমাকে এই শিক্ষা দেয়নি, তাই কাল তুমি বলে যাওয়ার পর রাতেই কেক বেক করেছি।

অস্ট্রেলিয়ান প্রতিটা প্রতিবেশী এমনই। এরা আত্মীয় না হয়েও আত্মার কাছেই থাকেন সবসময়। এসব ভালোবাসার প্রতিদান হয়তো কখনো দেওয়াও হবে না। কোনো কিছু আশা না করেই যারা নিরন্তর দিয়ে যায়...

এত স্পর্ধা কোথায় যে শোধ করবো... কিছু কিছু জায়গায় ঋণী থাকতে ভালো লাগে, এই যেমন অস্ট্রেলিয়ার কাছে, এই দেশের মানুষদের কাছে। এক মায়ার দেশ মনে বেঁধে আর এক মায়ার দেশে এসে পড়েছি, মায়ায় মায়ায় জীবন মায়াময়।

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]