কোনো এক একুশে ফেব্রুয়ারি
আমিও তোমার মতো একটা বর্ণমালাময় পাঞ্জাবি কিনতে পারতাম!

ক খ হাসান
আরে এ সবই তো ভালো উদ্যোগ। তা ভালো কথা, আজ বিকেলে তুমি কি করছো?
কেন বলতো?’
আমি ভাবছি আজ বিকেলে কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে যে আলোচনা হবে সেখানে যাব। আমি চাই তুমিও আমার সঙ্গে সেখানে যাবে।
দেখো রিমা, প্রতি বছরই এ ধরনের অনুষ্ঠানে যাওয়া-আর বক্তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বড় বড় বক্তব্য শুনতে আমার আর ভালো লাগে না।’
তুমি দেখছি অল্পতেই হতাশ। এবারের অনুষ্ঠান কিন্তু ভিন্ন রকম হবে।'
তাই নাকি! তা সেটা কেমন?
এবারে মোট পাঁচজন মূল বক্তা যেমন- আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সাংবাদিক সমিতির সভাপতি, গত বছরের একুশের পদকপ্রাপ্ত একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, স্থানীয় সংসদ সদস্য, আর জেলা প্রশাসক, তারা প্রত্যেকেই সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট করে বক্তব্য দেবেন।
আর তাদের নিয়েই প্যানেল গঠন করা হবে যেখানে উপস্থিত জনসাধারণ যে কোনো প্যানেল সদস্যকে প্রশ্ন বা মতামত দিতে পারবে আর একজন সঞ্চালক থাকবে সভা সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য।
তাহলে তো আমাকেও সেখানে যেতে হবে। এক কাজ করা যাক আমি বিকেল সাড়ে তিনটায় তোমার হলের সামনে থাকব। তুমি নেমে এলেই দু’জনা একসাথে অনুষ্ঠানে যাব- ঠিক আছে?
ঠিক সময়ে তপু রিমার হলের সামনের গাছতলায় দাঁড়িয়ে। ও জানে রিমা সময়ের ব্যাপারে খুবই সচেতন আর তাই ওর দেরি দেখে এক অজানা শংকায় মনটা দুলে উঠল। তবু ভাবলো অন্তত মিনিট পাচেক তো দেখা যাক- তারপরই না হয় রিমাকে মোবাইল করা যাবে। এরই মাঝে তপু দেখলো রিমা ওর দিকে এগিয়ে আসছে এক ভিন্নতর রূপে যা কিনা সে আগে দেখেনি।
ওর পরনে সুতি আর সিল্কের মিশ্রণে তৈরি সাদা পাড় লাল জমিন শাড়ি যার সারা জমিনে কালো হরফে লেখা অ-আ-ক-খ সহ বর্ণসমূহ যা তপুকে মুহূর্তের মধ্যে শিশুকালে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো। রিমা একেবারে তপুর কাছে এসে পৌঁছে ওকে হালকা একটা ধাক্কা দিয়ে বললো।
কি ব্যাপার, তুমিতো দেখছি মাছের মতো পলকহীন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছো?
আসলে, তোমাকে দেখে আমি মুহূর্তেই প্রাথমিক স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্র হয়ে গিয়েছিলাম।
শোনো, ফাজলামি বাদ দাও। চল এবারে যাওয়া যাক।
অবশ্যই, আমাদের তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া দরকার। কিন্তু তার আগে বলো, তুমি যদি আগে আমায় বলতে আমিও তোমার মতো একটা বর্ণমালাময় পাঞ্জাবি কিনতে পারতাম!
সব কথা আমাকে কেন বলতে হবে? ভাষা দিবসের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তো তুমি এটা করতে পারতে, তাই না?
যাক বাবা, আমায় মাফ করো। তোমার সাথে কথায় পেরে ওঠা খুব কঠিন কাজ! আর আমিতো ভেবেছিলাম হেঁটেই মিলনায়তনে যাব। কিন্তু তোমার সাজ দেখে মনে হয় না তুমি হেঁটে যেতে পারবে।
তুমি ঠিকই বলেছ, চল একটা রিকশা নিয়ে নেই।
রিমা আর তপু যথাসময়ে সভাস্থলে পৌঁছে দেখলো মিলনায়তন লোক সমাগমে ভরপুর। রিমাদের অবাক করে দিয়ে মূল বক্তারা সভা শুরুর মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যেই তাদের বক্তব্য শেষ করে ফেললো। তাই শুরু হয়ে গেলো উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের প্রশ্ন আর মতামতের পালা।
আজকের সভার এই ধরণটা প্রায় প্রতিটি প্রশ্ন ও মতামত দানকারীই প্রশংসা করেই কথা প্রকাশ করছিল। আলোচনার এক পর্যায়ে একজন প্রশ্নকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করলেন-
স্যার, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান, চিকিৎসা, কৃষি, আর প্রকৌশল শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগই ইংরেজী ভাষায় রচিত পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করা হয়। এ সমস্যার কি কোনো সমাধানই নেই?
উত্তরে উপাচার্য বললেন-
বাংলা ভাষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তক ব্যবহারে বেশ কতগুলো বাধা রয়েছে। প্রথমত- উপযুক্ত শব্দকোষ গঠন- এক্ষেত্রে আমরা বাংলা প্রতিশব্দের খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়ে বৈজ্ঞানিক শব্দাবলী সরাসরি গ্রহণ করতে পারি যেমন আমরা গ্রহণ করেছি ম্যালেরিয়া বাটাইফাইডের মতো শব্দ। এটা করতে পারলে আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক জার্নালগুলো থেকে তথ্য আর উপাত্ত যাচাই বাছাই করা সহজ হবে।
এছাড়াও তারা পরবর্তীতে উচ্চতর শিক্ষা বা গবেষণায় বিদেশে গেলে মূল শব্দের ভাষান্তরের পেছনে সময় ব্যয় করতে হবে না। দ্বিতীয়ত আমাদের উচিত আমাদের অধ্যাপক বা বিজ্ঞানীদের বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনায় উদ্বুদ্ধ করা যেমন বেতন বৃদ্ধি বা পদোন্নতিতে এ ধরনের কার্যকলাপকে মূল্যায়ন করা।
প্রথম পর্ব পড়ুন: কোনো এক একুশে ফেব্রুয়ারিতে
তৃতীয়ত প্রকাশকদের উৎসাহিত করা পাঠ্যপুস্তক প্রকাশে- তবে এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষার্থীদের কপিরাইট আইন সঠিকভাবে মানতে হবে যেমন ব্যাপকভাবে বই ফটোকপি করা যাবে না- কারণ এটা করলে বই প্রকাশনার ব্যয় প্রকাশকেরা উঠাতে ব্যর্থ হবে।
আলোচনার এ পর্যায়ে একজন সাংবাদিক উপাচার্যকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন-
আমার মনে হয় আমরা বর্তমান সময়ের বই প্রকাশনার মডেল যেমন ‘ওপেন এডুকেশনাল রিসোর্সেস’কেও গ্রহণ করতে পারি। এক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বই প্রকাশের প্রাথমিক ব্যয় বহন করতে পারে আর এরপর অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করলে আর কোনো অর্থের দরকার হবে না।
সভায় অনেকেই কথা বলতে চাই সেই সঙ্গে রিমাও। তবে রিমাকে অবশ্যই ভাগ্যবতী বলতে হয়- কারণ সে ‘ওপেন এডুকেশনাল রিসোর্সেস’ সম্পর্কে একটা সম্পূরক প্রশ্ন করার সুযোগ পেলো।
সে বলল, সাংবাদিক সাহেব, আপনার মতামতটি মনে হচ্ছে আমাদের জন্যে উপকারী হতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে যদি আপনি আর একটু খোলসা করে বলতেন?
উত্তরে সাংবাদিক বললেন, এ ব্যাপারে সবচেয়ে দরকারি বিষয় হলো কপিরাইট লাইসেন্স। যে কোনো ওপেন এডুকেশনাল রিসোর্সেস-এর ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিভ কমন্স নামের এক ধরনের পাবলিক কপিরাইট লাইসেন্স ব্যবহার করা হয় যা কিনা অন্যদের কারো লেখার কপি, বিতরণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং ক্ষেত্র বিশেষে বাণিজ্যিক উৎপাদন করার অনুমতি দেয়। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে হলে আমি আপনাদের ক্রিয়েটিভ কমন্স-এর ওয়েবসাইট পড়তে অনুরোধ করব।
চলবে...
অধ্যাপক ক খ হাসান, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালগারি, কানাডা
এমআরএম/এমএস