সৃজনশীল সমাজে এসব করা কী ঠিক?

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ০৫:৫২ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

দেশের বাইরে থাকি আমি, বাংলাদেশের অনেক কিছু সম্পর্কে আমার সচেতনতা নেই। তাছাড়া সুইডেনে যেমন সবাই সরকারকে ট্যাক্স দেয়। ট্যাক্সের একটি অংশ, চিকিৎসা, শিক্ষাখাতসহ নানা কাজে সেই অর্থ ব্যয় করা হয়। স্কুল এবং কলেজ শিক্ষার্থীরা যেমন বিনা খরচে লেখাপড়া করার সুযোগ পায় ইত্যাদি। এসব কিছু সম্ভব কারণ সবাই ট্যাক্স দেয়।

সুইডেনে যেমন যানবাহনের জন্য স্কুল এবং কলেজ শিক্ষার্থীদের মাসিক টিকিট স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে দেওয়া হয় যেন তারা সময় মতো স্কুলে আসতে পারে, তবে শনি এবং রোববারে এ সুযোগটা নেই। তখন তারা তাদের নিজ নিজ দায়িত্বে চলাফেরা করে থাকে।

কিন্তু বাংলাদেশে বিষয়গুলো কিছুটা অন্যরকম হয়েছে- ‘দেশটা আজ অনেকাংশেই মগের মুল্লুক’ হয়ে গেছে, এ কথাটি সত্য। তবে সব বাঁধাবিঘ্নের মধ্যেও যে সরকার কর্তৃপক্ষ চমৎকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন তার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।

কয়েকটি বিষয় তুলে ধরতে চাই সেগুলো হলো;

১) অধিকাংশ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী জনগণের ট্যাক্সের টাকার গাড়ি ব্যবহার করে থাকেন কাজে। মূলত এসব গাড়ি শুধুমাত্র সরকারি কাজে ব্যবহৃত হওয়ার কথা। কিন্তু, সেটা কি দেশে হচ্ছে? ভাবুন প্রতিদিন এসব কর্মচারী তাদের শপিং থেকে শুরু করে স্কুল কলেজ এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত কাজে যে পরিমাণ সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন এবং যে পরিমাণ সরকারের তেল এবং গাড়ির অপচয় করেন সেটা কি কখনও ভেবে দেখা হয়েছে?

সুইডেনে সংসদ সদস্যদের বা জনগণের প্রতিনিধিদের মূলত কোনো সরকারি গাড়ি দেওয়া হয় না (ব্যতিক্রম প্রধানমন্ত্রী)। আমরা যারা সরকারি-বেসরকারি কাজে গাড়ি পাই সেটা শুধুমাত্র কাজের জন্যই ব্যবহার করে থাকি। ছুটিতে বা উইকেন্ডে কখনও সরকারি গাড়ি ব্যবহার করি না, তখন আমরা আমাদের নিজ নিজ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করি। এক্ষেত্রে দেশের জনগণের অর্থের অপচয় করার কোনো সুযোগ থাকে না।

এখন ভাবুন দেশের অর্থ কী পরিমাণ দেশে কর্মরত দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা অবৈধভাবে ব্যয় করছেন? যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারাই কিন্তু সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। কেউ কিন্তু এ বিষয়টি তুলে ধরছে না বা এটা নিয়ে কথা উঠছে না। কারণ কী?
একটি গরিব দেশে যখন তেল আনতে নুনের খবর থাকে না সেখানে এ ধরনের বিলাসিতা তাও গরিবদের ঠকিয়ে? একটি সৃজনশীল শিক্ষিত সমাজে এটা করা কি ঠিক?

তাহলে দেখা যাচ্ছে আমরা যে বিবেকের কথা বলি বা শিক্ষার কথা বলি সেগুলোর সঙ্গে সত্যিকারের সঠিক এবং সুশিক্ষার কোনো মিল নেই। যার ফলে দেশভরা অরাজকতার ঢেউ, সে ঢেউ এত ভয়ঙ্কর যে সাধারণ জনগণ কিছু বললে ঝামেলাই পড়বে বিধায় চুপচাপ।

২) অন্যদিকে সমাজে যাদের বেশি চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে বা হচ্ছে শেষে তারাই সমাজ, দেশ, এমনকি গোটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সবাইকে অবাক বা হতভম্ভ করার উদ্দেশ্যে কি এমন একটি বিবৃতি দিয়ে লেখাটি শুরু করা? না, তবে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা মূলত লক্ষ্য। বর্তমানে বিশ্বে জনসংখ্যা ৮০০ কোটিরও বেশি।

এর মধ্যে ইহুদীর সংখ্যা ইহুদীদের সংখ্যা কত হবে গোটা বিশ্বে? সব মিলে দুই কোটি, এর মধ্যে ৭০-৮০ লাখ মতো ইসরাইলে অবশিষ্ট প্রায় এক কোটি ইহুদী সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। ইহুদীদের এই সংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.২ ভাগ, অর্থাৎ পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রতি ৫০০ জনে একজন ইহুদী। এই ০.২ ভাগ মানুষ বলতে গেলে সারা বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতিসহ অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে।

এটা কী করে সম্ভব? এটা যেমন একটি প্রশ্ন ঠিক বাংলাদেশের ১৭-১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ১.৫- ২ কোটি মানুষ হিন্দু। সেই অনুপাতে খোঁজ নিয়ে দেখুন দেশের মোট কর্মসংস্থানের কত অংশ হিন্দুদের নিয়ন্ত্রণে, তারপর দেখুন পুরো দেশের বড় বড় ক্ষমতাগুলোর কত অংশ হিন্দুদের দখলে! একইভাবে ভারতে যে পরিমাণ মুসলমান বাস করে তাদের সংখ্যাই বা কত? অথচ দায়িত্ব বা কর্তব্যের বড় বড় শীর্ষে দেখা যাচ্ছে অনেক প্রভাবশালী মুসলমান।

আমার লেখা এখানেই শেষ করতে পারতাম কিন্তু না যে উদ্দেশ্যে ঘটনাটি তুলে ধরেছি আমি সেটার ওপর আলোচনা করব এখন। চাপ এবং তাপ দুটো অত্যন্ত পরিচিত বিষয়। আমরা অনেক সময় পরিবারের মধ্যেই দেখা যায়, যার লেখাপড়া কম তাকে চাপিয়ে রাখি, যদিও তার ক্ষেত্র বিশেষ অনেক গুণাগুণ রয়েছে।

পরে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে সেই অবহেলিত, নির্যাতিত ভালেবাসা থেকে বঞ্চিত মানুষটি অন্যান্য সবার তুলনায় বেশি প্রতিষ্ঠিত ‘নট নেসেসারি’ যে শুধু আর্থিক দিক দিয়ে, অন্য বিষয়ের ওপর হতে পারে। মানুষ হয়ে মানুষকে ছোট করে দেখা বা এক ধর্মে বিশ্বাসী বিধায় অন্যের ধর্মের ওপর শ্রদ্ধা না দেখানো বা ঘৃণাত্মক মন মানুষিকতা বা চাপ সৃষ্টি করার কারণে এসব সংখ্যা লঘু গোষ্ঠী আজ পৃথিবীর নেতৃত্বে এতটুকু বলতে পারি।

সমাজে যারা যত অহংকারী বা যারা দেমাগ বেশি দেখায়, পতন কিন্তু তাদেরই ঘটে। আমি বাংলাদেশে যে বিষয়টি লক্ষ্য করছি সেটা হলো দেশের ইউএনও, পুলিশের এএসপিসহ আরও না কর্মে যথেষ্ট কর্মী রয়েছে যারা সংখ্যালঘু জনসংখ্যার দিক দিয়ে যদি বিবেচনা করি, অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি, সেটা হলো তারা ছোটবেলা থেকেই সমাজের চাপে বড় হয়েছে।

তাদের মনের ভেতর মোকাবিলা করার মতো শক্তি গড়ে উঠেছে। যার ফলে তারা সমাজের পরিকাঠামোর দায়ভার নিতে শুরু করেছে যেমনটি ইহুদীরা নিয়েছে। এটা যেমন একটি দিক আরেকটি দিক সেটা হলো জনগণের বাক-স্বাধীনতা বা অধিকার হরণ করার প্রচেষ্ট। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ যুগে জনগণের ক্ষমতাকে বরবাদ করে বা জুলুম করে তাদের শাসন করা হচ্ছে।

রাষ্ট্রের ক্ষমতাশীল ব্যক্তিরা অস্ত্রধারী প্রশাসনকে ব্যবহার করে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। যার ফলে মানুষ দেশ প্রেমিক না হয়ে দেশদ্রোহী হচ্ছে, অনেকে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রিত হচ্ছে যা উদাহরণসহ বলার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।

৩) আমি অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে যে জিনিসটা বেশি লক্ষ্য করছি সেটা হলো কোটি কোটি টাকার মালিক থাকলেও কেও দারিদ্র্যতা মোচনে তেমন আগ্রহী নন, তবে আর্জেটিনার টিম আসবে বাংলাদেশে তার জন্য কোটি কোটি টাকা ঢালতে বা ঢোল ডগর পেটাতে উদগ্রীব। এদিকে দেখা যাচ্ছে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী অর্থের অভাবে পড়তে পারছে না বা একজন মুমূর্ষ রোগীর হার্টফুটোর চিকিৎসার অভাবে হয়তো দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সত্ত্বেও কেউ তেমন কিছু করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

যদি একটু সহানুভূতি বা মহানুভবতা না দেখায় তাহলে অনেক ফুল যে ঝরে পড়তে পারে সে খেয়াল নেই! বিষয়টি একজন বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতেই সে একটি যুক্তি দিয়ে আমাকে নিস্তব্ধ করে দিলো। বন্ধুর যুক্তিটা হলো, যারা দুর্নীতি করে অর্থ উপার্জন করে তারা জানে ভালো কাজে সে অর্থ ব্যয় করলে নেকি হবে না, কারণ তাদের অর্থ হালাল না।

তবে খারাপ কাজ বা যে কাজ সত্যি হাস্যকর যেমন আর্জেন্টিনার টিম বাংলাদেশে আসবে সেখানে টাকা ঢালা কোনো ব্যাপার না। আমার বলার কিছু ছিল না, তবে ভেবেছিলাম এ টাকাগুলো দিয়ে নিজের দেশে একটি ফুটবল টিম তৈরি করতে পারতাম।

শেষে এতটুকু বলতে চাই, সংখ্যায় কম হলেও কোনো সম্প্রদায় যদি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, মিডিয়া, সামরিক প্রযুক্তি ইত্যাদিতে শীর্ষে থাকে তাহলে তাদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ দোষের কিছু নয়, যদি নিয়ন্ত্রণ অনৈতিক, অবিচার, অমানবিক, ষড়যন্ত্রমূলক এবং বল প্রয়োগ না হয়।

আগেই বলেছি যে, এখনকার ইহুদীরা শিক্ষা-দীক্ষায়, গবেষণায়, প্রযুক্তি আবিষ্কার, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে আছে। যাইহোক আমি কেন যেন নিজেই দিন দিন দুর্বল হয়ে সংখ্যালঘুদের দলেই চলে যেতে শুরু করছি, তবে পার্থক্য হলো আমি ইহুদী বা সংখ্যালঘুদের মতো ক্ষমতা বা প্রভাবশালী হতে পারছি না!

আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার। বুকের ব্যথা বুকে চাপায়ে নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার। হায়দার হোসেনের এই গানটি বাংলাদেশের সবার মনের কথা হওয়া উচিত।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]