এখন শুধু অপেক্ষার পালা

ড. মইনুর রহমান
বড় বড় পাথরের চাইগুলো একে অপরের গায়ে এমনভাবে লেগে আছে যেন মনে হয় একটা ছোট্ট ধাক্কাতেই নড়ে গড়িয়ে পড়বে সমস্ত স্তুপ। কিন্তু না, দেখতে যতই ছোট মনে হোক, প্রচণ্ড ভারি এই পাথরের চাইগুলো যুগের পর যুগ আঁকড়ে ধরে আছে এই সরু খরস্রোতা খাড়ির ওপরে থাকা প্রশস্ত ব্রিজের পিলারগুলোকে অতলান্ত মহাসাগর থেকে ঠেলে ভেসে আসা অযুত অযুত লবনাক্ত জলরাশির আসুরিক ধাক্কার হাত থেকে।
সময়ের শেওলার দাগে দাগে ভোরে ওঠা পাথরগুলো প্রচণ্ড পিচ্ছিল আর ধারালো শামুক জাতীয় প্রাণীর কলোনিতে পরিপূর্ণ। অনেক অভিজ্ঞ মানুষেরও তাল হারিয়ে যায় এই পাথরের ওপর হেঁটে গিয়ে ব্রিজের নিচে থাকা সমতল জায়গায় পৌঁছাতে। তাল হারিয়ে ফেললে সোজা গিয়ে পড়তে হবে পাথরের স্তুপের গা ঘেঁষে ঘূর্ণি দিয়ে ওঠা বিপুল জলরাশির মাঝে। অনেক সুচতুর সাঁতারুর দক্ষতা যেখানে অচল। নিমিষেই চলে যেতে হবে একটানে কয়েক ফুট গভীর পানির নিচে।
এমন দুর্গম আর দুঃস্বাধ্য হওয়ার জন্যই হোক কিংবা না, দুনিয়ার অন্যতম সুস্বাদু মাছের আনাগোনা এই খাড়ির পাথরের চাই বরাবর পানিতে স্তম্ভে। ভেড়ার দাঁতের মতো মুখ হওয়ার কারণে মাছগুলোকে আদর করে এখানকার মানুষ ডাকে শীপসহেড বলে। তাদের প্রধান খাদ্যই হচ্ছে পাথরের গা বেয়ে জমে ওঠা শামুক জাতীয় প্রাণী। শক্ত দাঁতকপাটি দিয়ে খুটে খুটে শামুকগুলোকে তুলে চিবিয়ে চিবিয়ে চূর্ণ করে নেয় তাদের চুনাপাথরের শক্ত আবরণ। শামুকের মিষ্টি মাংসল শরীর খেয়ে বেড়ে ওঠার কারণেই হয়তো তারা এত সুস্বাদু হয়ে ওঠে।
খুব চঞ্চল আর চতুর প্রকৃতির, সঙ্গে করে তাদের শক্ত দাঁতে ভরা চোয়াল মৎস্য শিকারীদের জন্য কঠিন করে দেয় তাদের ধরা। তাই বলে বসে থাকে না তারা। লক্ষ্য যতই কঠিন আর দুর্গম, তা অর্জন করা ততই উত্তেজনার খোরাক।
খাড়ি থেকে কিছুটা দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরের টুকরো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে অনেক মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা খুঁজতে থাকা বৃদ্ধ লোকটি এই দলেরই লোক। ভাটায় নেমে যাওয়া পানিতে উন্মুক্ত হওয়া পাথর উল্টিয়ে পাল্টিয়ে খুঁজে নিতে থাকে শীপসহেড ধরার মোক্ষম অস্ত্র, ফিডলার ক্র্যাব। ইঞ্চি খানিক ব্যাসার্ধের ছোট কাঁকড়াগুলো তাদের নিরাপদ জায়গা খুঁজে নেয় লোনাজলের কোল ঘেঁষে কোনো পাথরের নিচে, বড়ো কোনো ঘাসের ঝুপড়িতে, না হয়ে ভেসে আসা কাঠ কুটির টুকরোর গা বেয়ে।
বৃদ্ধ লোকটা কাঁপাকাঁপা হাতে সব উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখে নেয় কাঁকড়াগুলোর অবস্থান। হাতে থাকা বালতির তলা ছেয়ে যেতে থাকে গুড়োগুড়ো কাঁকড়ায়। তাদের হুটোপুটির শব্দ হতে থাকে সময় সময়। লোকটি এক ফাঁকে দেখে নেয় কাঁকড়াগুলোকে। এবেলা হয়তো হয়ে বয়ে যাবে তার। বালতি তুলে নিয়ে যাত্রা শুরু করে, লক্ষ্য তার পাথরের চাই বেয়ে ব্রিজের নিচে সেই সমতল জায়গা।
কয়েক ফুটি নলখাগড়া আর বিলাইলেজের বাদাবন থেকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে থাকে লোকটি। এখন শীতকাল। সাপের ভয় তেমন নেই। তবুও সাবধানতায় লোকটি পড়ে আছে হাটু অবধি ঢেকে থাকা রাবারের বুট। এর কাজ আপাতত দুটো, অনাহুত সাপখোপ আর ঘাসের ধারালো ডগার হাত থেকে পা বাঁচানো, আর তীক্ষ্ম পিছল পাথরের গা বেয়ে ওঠার সময় আঁকড়ে ধরে থাকা।
ঘাস আর বাদাবন পেরোতে পেরোতে খসখস একটা শব্দে পেছনে ফিরে তাকায় লোকটি। একটা সাদাকালো মিশ্রনের বিড়াল তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসছে। এই বিড়ালটা এখানেই থাকে। যতবার লোকটি এখানে আসে, ততবারই সে সাথে করে এই বিড়ালটার জন্য কিছু নিয়ে আসে। পকেট থেকে সেই খাবারটা সামনে পেতে দেয় সে। বিড়ালটা গড়গড় শব্দ করতে থাকে খেতে খেতে।
নাহ, সময় দুপুর গড়িয়ে দিয়ে বিকেলের দিকে সরে যাচ্ছে। পা চালিয়ে নিয়ে এসে দাঁড়ালো পাথরের স্তুপের নিচে, এখন এই শেওলা পিচ্ছিল পাথর বাওয়ার পালা। অতি সন্তর্পনে, এক পা দু পা করে লোকটি আস্তে আস্তে লোকটি পাথরের রাজ্য ডিঙিয়ে, এড়িয়ে চলে আসে ব্রিজের নিচে সেই এতটুকু সমতল জায়গায়।
আজ সে বাদে আর কেউ নেই। একটু একা একা লাগে তার। ব্যাগপ্যাক থেকে দুই অংশ আলাদা করা ছিপ বার করে জোড়া দিয়ে নেয়। ছিপের সুতলির আগায় বড়শি বেঁধে বালতি হাতড়ে একটা দশাসই কাঁকড়া তুলে নিয়ে গেথে দেয় বড়শিতে। আগে থেকে সুতলিতে লাগানো সীসার ভার একটু দেখে নিয়ে বড়শি সমেত কাঁকড়া নামিয়ে দেয় পাথরের গা বেয়ে পানির স্তম্ভ বরাবর।
এখন অপেক্ষার পালা। সরু খরস্রোতা খাড়িবেয়ে অতলান্তের পানি গিয়ে মিশেছে একটা উপসাগরে। নাম তার কোডেন। কোডনের পানি আজ শান্ত। সূর্যের সোনালী আলোয় ঝিকমিক করছে মৃদুমন্দ কোডনের জলরাশি। থেকে থেকে বিশাল একটা দুটো বক ডানা মেলে ইতিউতি খুঁজে নিচ্ছে ছোট মাছের ঝাঁক। থেকে থেকে মুলেটের দল ঝেঁকে আলোড়ন তুলসে পানির উপরিভাগে।
দু একটা অতি উৎসাহী মুলেট লাফিয়ে উঠে নিয়ে নিচ্ছে পাখি হওয়ার স্বাদ। দূরে কোডনের তীর বেয়ে গজিয়ে ওঠা ঘাস বাদাবন আর পাইন সাইপ্রাসের ঝাঁক দৃষ্টির পরিসীমা এঁকে জানিয়ে দিচ্ছে দিনের প্রহর সংখ্যা। অতলান্ত বেয়ে ভেসে আসা লবণ জোড়ানো হিমশীতল বাতাস ব্রিজের নিচে পাক খেয়ে কাঁপিয়ে দিতে চাচ্ছে বৃদ্ধ লোকটিকে। কেমন যেন একটা ঝিমুনি পেয়ে ধরলো লোকটিকে।
এই ঝিমুনির মাঝেই লোকটা বুঝতে পারলো বড়শিতে হালকা হালকা টান। কোনো সন্দেহ নেই যে এইটা শীপসহেড। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে থাকে সে। মাছটাকে সম্পূর্ণ খেতে দেয় কাঁকড়াটা। দেখতে দেখতে ছিপের আগা বেঁকে যেতে থাকে। বাকতে বকতে অনেক জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে।
চোখের পলকেই লোকটি সজোরে টান দেয় ছিপ ধরে। সাথে সাথে অপর দিক থেকে অনুভব করতে থাকে মাছের অনবরত টান। মাছ ভালো মতো গেঁথেছে। সুতলি পেঁচানো রিলের হাতল ধরে জোরে জোরে ঘুরাতে থাকে লোকটি। এই মাছটা একটু বেশি গাড়োল। যতই সুতা পেঁচানো হচ্ছে, টেনে তার থেকে বেশি খুলে নিচ্ছে রিল থেকে। এই টানাপোড়েন চলতে লাগলো কিছুক্ষণ। এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে সাদা ডোরাকাটা শরীর নিয়ে ভেসে উঠলো এক দশাসই শীপসহেড।
লেখক: আমেরিকা প্রবাসী
ড. মইনুর রহমান, ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার, সিটি অব মবিল, অ্যালাবামা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
এমআরএম/জেআইএম