দোস্তজী যেন আরেক পথের পাঁচালী

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০৯:৪১ এএম, ২৩ মার্চ ২০২৩
ছবি: সংগৃহীত

দোস্তজী চলচ্চিত্রটা দেখেছি বিরতির সময় থেকে। এই অর্ধেকটুকু দেখেই মুগ্ধ হয়েছি। কারণগুলো একটু বিস্তারিত বলা যাক। হলে ঢুকেই দেখি দুই বন্ধু স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তার পাশের পুকুরে নেমে পড়েছে। বৃষ্টির মধ্যে পুকুরের পানিতে মাছ ধরার চেষ্টা করছে। খালি হাতে না পেরে গায়ের জামা খুলে মাছ ধরার চেষ্টা করছে। এমন দৃশ্য একটা সময় বাংলাদেশের গ্রামীণ শৈশবের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। আমার এখনও মনে আছে একবার স্কুল থেকে ফেরার পথে আমরা দুই ভাই রাস্তার পাশের ক্ষেতে জমে থাকা পানির মধ্যে নেমে পড়েছিলাম। তারপর জামা খুলে জাল বানিয়ে দারকিনা মাছ ধরেছিলাম।

গ্রামের মাটির রাস্তাগুলো হাজার বছরের ঐতিহ্য। সেই মাটিতে খালি পায়ে মানুষ হেঁটে যায়। এই দৃশ্যটার মধ্যে একটা অদ্ভুত মায়া আছে। আর যারা এই মাটিতে খালি পায়ে হেঁটেছেন তারা জানেন সোঁদা মাটির এই মায়া কাটানো অসম্ভব। গত বছর প্রবাস থেকে দেশে বেড়াতে গিয়ে যখন গ্রামের বাড়ি গেলাম তখন আমিও একই কাজ করেছিলাম। অটো থেকে নেমেই প্রথমে জুতো মোজা খুলে হাতে নিয়ে নিলাম। এরপর নদীর পুরো চরটা খালি পায়ে হাঁটলাম।

মরে যাওয়া পদ্মা নদী পার হয়ে আবারও সেই পায়ে হাঁটা পথ। এরপর একসময় গ্রামের পথে উঠলাম। তারপর সারা গ্রাম খালি পায়ে হাঁটলাম। ধুলোর মধ্যে পা দেবে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন মখমলের বিছানার মধ্যে হাঁটছি। আর পায়ের তলায় একটা ঠান্ডা কোমল অনুভূব। সেই অনুভূতির কোনো তুলনা নেই।

গ্রামের বাড়িগুলো যেন এখনও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির আঙিনায় পাটকাঠির বেড়া। পাটকাঠিকে আমাদের এলাকায় বলে শোলা। ঘরের চাল খড়ের অথবা একটু সামর্থ্যবানদের মাটির তৈরি টালির। আর ঘরের দেওয়াল মাটির। ঠিক এমন ঘরের আমাদের শৈশবটা কেটেছিল। এসব ঘরের বিশেষত্ব হচ্ছে এগুলো প্রাকৃতিকভাবেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। বেড়ার, চালের ফাঁকে ফাঁকে আটকে থাকা বাতাস তাপ কুপরিবাহী। তাই ভেতরের তাপ যেমন বাইরে যেতে দেয় না। ঠিক তেমনি বাইরের তাপও সহজে ভেতরে ঢুকতে পারে না। আর দেওয়ালের গায়ের বেলুন আকৃতির গর্তগুলো জানালার কাজ করে।

বাড়ি আলোকিত করার কাজে ব্যাবহার করা হয় কুপি বাতি। আমরা অবশ্য শুধু বাতিই বলতাম। আর ছিল হারিকেন। বাড়ির বারান্দায় রাখা ভাঙা খাট। আমাদের এলাকায় বলে চৌকি। যার পায়াগুলোর নিচে ইট দিয়ে উঁচু করে রাখা। ইট দিয়ে রাখা হয় কারণ যেন মাটির উইপোকা যেন খাটে আক্রমণ করতে না পারে। অতিথি আসলে বারান্দায় বিছিয়ে দেওয়া হয় শীতল পাটি। ঘরের সাথেই ছোট একটা জোড়াতালি দেওয়া ঘরে রান্না করা হয়। বৃষ্টি জলেই চালা থেকে পানি পরে উঠোনে লম্বা গর্ত তৈরি হয়। সেই গর্ত যেন না হয় তাই চালের কিনারা দিয়ে মাটিতে ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়।



হিন্দুদের উঠোনের মাঝখানে উঁচু বেদীর ওপর থাকে তুলসি গাছ। সেই বেদীর মাঝে থাকে ত্রিকোণাকৃতি গর্ত। এই সিনেমা দেখতে দেখতে আমি আমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম এটার কাজ কি। সে বলল এটা আমি চিনেছি। তোমার বন্ধুদের বাসায় দেখেছি। ওখানে আলো রাখা হয়। শুনে মনটা আদ্র হয়ে গেলো। আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে বেশিরভাগই একসময় ছিল হিন্দু।

ব্রাহ্মণ, বরগী, পাল, ধোপা, নাপিত, কর্মকার, খুলু, ডাক্তার, সাহা কত যে পেশার মানুষ ছিল। কিন্তু বাবরি মসজিদ এর ঘটনাটার সময় প্রায় সবাই চলে গিয়েছিল। এখন আছে আমাদের পাড়ায় দুই ঘর ধোপা আর সাহা পাড়াতে আছে আরও কয়েক ঘর হিন্দু। উনাদের ছেলেমেয়েরা সবাই আমাদের ছোটবেলার বন্ধু।

আমরা বেড়ে উঠেছিলাম একই পরিবারের সদস্য হিসেবে। বাইরে থেকে কেউ বলে না দিলে আমাদের আলাদা করে চেনা সম্ভব না। আমরা একে অপরের সংস্কৃতি সম্মন্ধে এতটাই জানি যে একবার আমার মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বাবা আর ইউ হিন্দু। এখনো দেশে বেড়াতে গেলে প্রতিদিনই একাধিকবার উনাদের বাসায় যাওয়া হয়। এখনো কাকিমাদের আদরের ডাকগুলো মনকে আদ্র করে। কর্তারা সবাই বিদায় নিয়েছেন। কত যে আদর করতেন উনারা। অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও উনাদের সাথে যখন আলাপ হতো। উনারা কি এক অকৃত্রিম ভালোবাসায় আটকে রাখতেন।



হিন্দুদের কেউ মারা গেলে সেই লাশ নিয়ে যাওয়া হয় শ্মশানে। যাওয়ার সময়কার ‘হরি বোল, বলো হরি’ ধ্বনি এখনো আমার কানে বাজে। যাওয়ার পথে যারযার সামর্থ্য অনুযায়ী ধান, চাল, টাকা, পয়সা ছেটাতে ছিটাতে যায়। এই দৃশ্যগুলোও খুবই চমৎকার ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দোস্তজীতে৷ আর গ্রামের রাস্তায় গান বাজিয়ে ফেরিওয়ালার চলে যাওয়া। কি চমৎকার স্থবির একটা জীবন। প্রবাসের এই যান্ত্রিকতার দৌড়ে ক্লান্ত আমি এখন বুভুক্ষের মতো এই স্থবিরতা খুঁজি।

গ্রামের স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার পর জমা দিতে হতো হাতের কাজ। যেমন দোস্তজীর শফিক বানায় অক্সিজেনের কল। আমার এখনো মনে আছে আমরা যে যার মতো করে হাতের কাজ করতাম। আমাদের এলাকায় উলু খুবই সহজলভ্য হওয়ায় আমরা প্রায় প্রত্যেকেই বারুন বানাতাম উলু দিয়ে। এটা এক ধরনের ঝাড়ু তবে শলার ঝাড়ুর চেয়ে দৈর্ঘ্যে ছোট। আর তার সাথে মাটি দিয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন জিনিস বানাতাম। আমি বানিয়েছিলাম আম। এইসব জিনিস স্কুলের আলমারিতে রেখে দেওয়া হতো। আর এগুলোর ওপর নম্বরও দেওয়া হতো যেটা ফলাফলের সাথে যোগ হতো।

স্কুলে বছর শেষে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হয়। আমার এখনও মনে আছে আমরা যখন ফল আনতে যেতাম। তখন পাড়ার দাদিরা জিজ্ঞেস করতেন, কোথায় যাচ্ছিস? যেই আমরা বলতাম ফল আনতে যাচ্ছি সাথে সাথেই উনারা উত্তর দিতেন, ফল আনতে যাচ্ছিস তাহলে ঢাকি (ঝুড়ি) নিয়ে যা। না হলে ফল আনবিনি কিসে করে। আর স্কুলে ফলাফল ঘোষণার পাশাপাশি ফলাফল ভালো খারাপেরও বিশ্লেষণ করা হতো।

একবার যেমন আমি পরীক্ষায় খারাপ করে ফেলাতে বলা হয়েছিল, আমাকে দিয়ে বাসায় বেশি কাজ করানো হয় তাই ফলাফল খারাপ হয়েছে। এরপর আমার অভিভাবককে ডেকে জবাদিহি করতে বলা হয়েছিল। গ্রামের প্রকৃতির একেবারে অবিকল চিত্রায়ন আছে দোস্তজী চলচ্চিত্রে। রাস্তার পাশের মাটিলে (ডোবা বা পুকুর) পাট জাগ দেয়া আছে। আবার তার পারে গোলাকৃতি পাটকাঠির ঝোপ। পাশে কাশফুলের সারি। রাস্তার পাশে লতাগুল্মের ঝোপ। আছে গ্রামের আম বাগানের চিত্র।

সেখানে ডেকে চলে হাজার রকমের পাখি। তারমধ্যে কোকিলও আছে। কোকিলের ডাকের একটা মজার ব্যাপার আমরা ছোটবেলায়ই জেনে গিয়েছিলাম। সেটা হলো কোকিলের মতো করে ডাকলে তার সাথে সাথে কোকিলও ডেকে উত্তর দেয়। এবং সেটা চলতে থাকে অবিরাম। এই দৃশ্যটা পর্দায় দেখানোর সাথে সাথে আমার মেয়েটা বললো, বাবা আমিতো এটা জানি।

শুয়োপোকাকে আমাদের এলাকায় বলে বিছুটি। এগুলো গায়ে কোথাও লাগলেই চুলকায় তাই হয়তোবা এমন নামকরণ। অনেক গাছেই শুয়োপোকা হতে দেখা যায়। তবে বছরের একটা সময় সবচেয়ে বেশি হয় জিগে গাছে এবং সজনে গাছে। সজনে গাছেরগুলো দেখতে হলুদ বর্ণের এবং আকারে ছোট। তবে এই বিছুটিগুলো শরীরে লাগলে শরীর চুলকায় না। কিন্তু জিগে গাছেরগুলো কালো বর্ণের এবং শরীরে লাগলে ভীষণ চুলকায়।

এছাড়াও অন্যান্য গাছেও এই শুয়োপোকা দেখা যায় এবং সেগুলো বেশ বড় আকারের। সেগুলোকে বলে আঁচা। শুয়োপোকা লাগলে ঘুটো দিয়ে ঘষে তার হলগুলো উঠিয়ে ফেললে চুলকানি কমে যায়। এমন সব দৃশ্যেরও সফল চিত্রায়ন আছে এই ছবিতে।

যাইহোক, এই সিনেমাটা অস্ট্রেলিয়া আসছে জেনে আগে থেকেই বঙ্গজ ফিল্মসের তানিম ভাইকে বলে রেখেছিলাম। পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাওয়াতে বিরতির পর থেকে দেখেছি।

বারবার একটা কথায় মনে হচ্ছিল যে, এই ছবির তো অনেকগুলো পুরস্কার পাওয়া উচিৎ। পরে বাইরে এসে শুনলাম, আসলেও অনেকগুলো পুরস্কার ইতোমধ্যে পেয়ে গেছে। কথা প্রসঙ্গে আমি তানিম ভাইকে বললামঃ আমার বারবারই সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। পথের পাঁচালীর পর এই প্রথম মনে হয় গ্রাম বাংলার এমন অসাধারণ চিত্রায়ন দেখলাম। পুরো সিনেমাটা দেখার পর আরও বিস্তারিত লেখার আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]