‘দাদর পুলের বাচ্চারা’ যেন রূঢ় বাস্তবতার রসাত্মক আখ্যান

‘দাদর পুলের বাচ্চারা’ বইয়ে গল্প আছে সাতটি। বইয়ের নাম গল্পটা অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ এক গল্প। এই গল্পে স্বয়ং ভগবান একজন চরিত্র। গল্পের কথকের সঙ্গে তার দেখা হয় তার বস্তির ঘরে। তখন গল্প কথকের পেটে দুই দিন ধরে কিছুই পড়েনি। ভগবান এসেছেন শহরের বাচ্চাদের অবস্থা দেখতে কারণ বাচ্চারাই ভবিষ্যৎ।
আর ভগবান সবাইকে বাচ্চা করেই পৃথিবীতে পাঠান। এরপর তারা পৃথিবীর আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠে। আর ভগবান বাচ্চাদের অবস্থা দেখার জন্য বস্তির একজনকে বেছে নেওয়ার কারণও বলেছেন। এর আগে তিনি গিয়েছিলেন একজন ফিল্মস্টারের কাছে কিন্তু তার হৃদয় থেকে তিনি কোনো সুগন্ধ পাননি। এরপর গিয়েছিলেন একজন দালালের কাছে কিন্তু তার চোখে তিনি লজ্জার চিহ্নমাত্র দেখেননি।
এরপর গিয়েছিলেন একজন পতিতার কাছে কিন্তু তিনি তার বুকে কোনো শিশুর কলরব শুনতে পাননি। এরপর গিয়েছিলেন একজন পীরের কাছে কিন্তু সেই পীর বেঁচে আছে দানের ওপর। এরপর গিয়েছিলেন একজন ধোপার কাছে কিন্তু সে তার বউকে মারে। এরপর সে আসে বস্তির এই গল্প কথকের কাছে।
ছোট কলেবরের এই বইটার অর্ধেক অংশজুড়েই আছে বইয়ের নাম গল্পটা। এই গল্পে হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে নিম্ন মানুষের জীবনের বাস্তব ছবি। আর ভগবানের বয়ানে তুলে ধরা হয়েছে তার স্বরূপ। শুরুতেই ভগবান কথককে নিয়ে খেতে যান একটা রেস্তোরাঁয়। সেখানকার খাবারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে, ‘তুমি এখনো বোম্বাইয়ের পাউরুটির পিস দেখনি। এত মিহি ও পাতলা করে কাটা যে এদিক ওদিক দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়।’
‘ওর ওপর একটু মাখন লাগিয়ে অনায়াসে শেভও করতে পারবে। আর ডিম? বোম্বাইয়ের মুরগির ডিম এত ছোট যে ঐ ডিমের ওমলেট খেতে গেলে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য নিতে হয়। বাকি থাকে এক কাপ চায়ের কথা। এই চায়ের কাপ এতো বড় যে চোখের জলও তাতে অতি কষ্টে ধরে।’
ভগবান এবং কথক শিশুরূপ নিয়ে নেমে পড়ে বোম্বাইয়ের রাস্তায়। কথক নেন একঝুড়ি পেয়ারা আর ভগবান নেন একঝুড়ি বই। এরপর দোকান দিতে গিয়ে তাদের স্থানীয় মাস্তান থেকে শুরু করে পুলিশ সবাইকেই চাঁদা দিতে হয়। এত কিছুর পরও যে বিষয়টা ভগবানকে অবাক করে সেটা হলো কেউ একটাও বই কিনে না। এর ব্যাখ্যা হিসাবে কথক বলেছেন মা-বাবাদের স্কুলের বই কেনার পয়সা নেই, তারা তোমার গল্পের বই কিনবে কোথা থেকে। আর লেখাপড়ার বাস্তব অবস্থা আরও ভয়াবহ।
ফুটপাতের একজন হকারের ভাষায়, ‘আমরা যদি ঠিকমতো স্কুল কলেজে যেতাম, তাহলে আমি বি.এ. পাশ হতাম, শরীফ হতো এন্ট্রান্স পাশ। এই গোরখা যদি স্কুলে যেতো তাহলে আজ ও মেয়েদের ওড়না বিক্রি না করে স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত।’ শহরের বাচ্চারা বরং পড়াশোনা বাদ দিয়ে সব রকমের খারাপ কাজের সাথে জড়িত। এমনকি বয়সের তুলনায় তারা এমনসব খারাপ কাজের সাথে জড়িত যে ভগবান সেটা বিশ্বাসই করতে চান না।
আরও আছে শ্রেণি-বৈষম্য। শহরের একপ্রান্তে যখন শিশুরা জীবনের ন্যূনতম মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত তখন অন্যপ্রান্তে শিশুরা বেড়ে উঠছে একেবারে আদর্শ পরিবেশে জীবনের সকল অধিকার সম্পূর্ণভাবে ভোগ করে। সেখানে ভগবান ভর্তি হতে গেলে প্রিন্সিপাল তার পিতার জিজ্ঞেস নাম ও পেশা জিজ্ঞেস করেন। কারণ পিতার পেশা থেকে ধারণা পাওয়া যাবে যে তারা এই স্কুলের ফিস দিতে পারবে কি না।
এছাড়াও শহরের একপ্রান্তে বাচ্চাদের দিয়ে ভিক্ষা করানো হয়। সেই প্রক্রিয়াটাও গা শিউরে ওঠার মতো। ভিক্ষুক শিশু ভিকির ভাষায়, ‘লোকে স্বাস্থ্যবান বাচ্চাদের ভিক্ষা দেয় না। সুস্থ সবল সম্পূর্ণ শিশুর প্রতি কেউ দয়া দেখায় না। তবে হ্যাঁ যদি কোনো বাচ্চার পা ভাঙা হয় বা হাত না থাকে, বা যদি অন্ধ হয়, তাহলে লোকে তাদের দেখে দু:খ পেয়ে পয়সা দেয়। এই ধরনের ভিকিরি বাচ্চারা প্রচুর রোজগার করে।’ এভাবেই বাচ্চাগুলো বোম্বাইয়ের লাভের চাকার সাথে বাঁধা পড়ে যায়।
ভগবানের নিজের স্বরূপ এবং মনস্তত্ত্ব নিয়েও বিস্তারিত আলাপ করা হয়েছে এই গল্পে। ভগবান বলছেন, ‘কখনো মনে হয় আমি একটা আগুন... তারপর আমি হলাম জল... তারপর আমি হলাম সূর্য... কখনো আমি একটা গাছ... কখনো একটা সাপ... কখনো একটা পাথরের স্তুপ... আমার এতো নাম, এতো বাসনা, আমাকে ঘিরে এতো ভয়। তারপর মানুষ ভয়কে জয় করলো।
আমিও অনেক ওপরে উঠে গেলাম। আমি গাছ, পাথর, জল থেকে মহাশূন্যে পালিয়ে গেলাম, এবার আমি রূপ, স্থান, নামহীন কেবল এক শক্তি।’ ভগবান কি আসলে মানুষ? এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘মানুষ? তার মানে খুনি ও আক্রান্ত। ভ্রমর আবার ফুলও। বার্ধক্য এবং যৌবন। জীবন এবং বলিদান। হৃদয় আবার সখ্যতা। ঘৃণা আবার শত্রুতা। সভ্যতা আবার অসভ্যতা, দেবদূত আবার শয়তান, মানুষ।’
ভগবান নিজের রসবোধের পরিচয় দিতে যেয়ে বলেছেন, ‘নিজের সৃষ্টি দেখে যদি কেউ না হাসে, তবে সে ভগবান নয়।’ ভগবানের পূজার বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘ওহে সরল মতি ঈশ্বর- ওরা তোমার পূজা করে না, নিজের মনোবাসনাকে পূজা করে।’ আর ভারতবর্ষে ভগবানের পূজা করার ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘এখানে প্রতি পদে পদে মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার। আমরা ভগবানের সবথেকে বড় উপাসক ও পূজারী। আমরা আমাদের ঈশ্বরের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারি।’
এরপরের গল্প ‘আলুচে’র বিষয়বস্তু সময়ের সাথে কাশ্মীরের একটা বদলে যাওয়া গ্রামের। ‘ভক্ত সুদামা’ গল্পটা একজন বিশ্বাসী মানুষের। যে বিশ্বাস করে সময়ের সাথে সাথে খারাপ সময় বদলে ভালো সময় আসবে। ‘একই প্রত্যাশা’ গল্পটা একজন মেয়ের হাত বদলের গল্প। ছ বছর বয়সে তার বাবা মা অভাবে পড়ে তাকে বিক্রি করে দেন।
এরপর বিভিন্ন হাত ঘুরে একটা সময় সে সিনেমা জগতের প্রতিষ্ঠিত নায়িকা হয়ে উঠেন। ‘বিলাস’ গল্পটা একজন মধ্যবিত্ত কেরানির যে জীবনের একটা পর্যায়ে এসে নিজের জন্য কিছুটা সময় বের করে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ে। ‘পবিত্র’ গল্পটা একেবারে আমাদের আধুনিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। ‘দিল দৌলত ঔর দুনিয়া’ একেবারেই মনস্তাত্ত্বিক একটা গল্প। আমরা আসলে কিসে সুখ খুঁজে পাই সেটা কি আমরা জানি। আবার আমাদের সবার সুখের ঠিকানা কি একই?
যাইহোক কৃষণ চন্দরর অপূর্ব লেখনীর গুণে প্রত্যেকটা গল্পই হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য। প্রাত্যহিক জীবনের ভেতর এবং বাইরের রূপের রয়েছে পূঙ্খানুপুঙ্খ বণর্না। সেখানে প্রকৃতি থেকে শুরু করে মানুষ, সামাজিকতা, অর্থনীতি সবকিছুই উঠে এসেছে। ভগবানের বিশ্বাসের স্বরূপ অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে।
বইয়ের নাম গল্পের কয়েকটা লাইন দিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই, ‘জীবনে শেষ বারের মতো আমি যখন ভগবানকে দেখলাম তখন তিনি ছ বছরের এক অন্ধ দুর্বল শিশু, সন্ধ্যের লাল সূর্যালোকের প্রেক্ষাপটে দু হাত ছড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি পুলের ওপর ভিক্ষা চাইছেন।’
এমআরএম/জেআইএম