অন্নদাতা

দুর্ভিক্ষের বীভৎস রূপ

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০৮:২৫ এএম, ২৫ মে ২০২৩

একেবারেই ছোট কলেবরের একটা বই। কিন্তু এই বইটি নিশ্চিতভাবেই আপনার মনে একটা দীর্ঘস্থায়ী দাগ কাটবে। বইটা পড়া শেষ হলেও আপনি অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে থাকবেন বইয়ের গল্পে। আমরা মোটা দাগে দুর্ভিক্ষের নাম শুনেছি। জানি মানুষ মরেছে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে। কিন্তু সেই সমস্ত মানুষদের মনস্তত্ব নিয়ে আমরা কখনও ভাবিনি। ভাবিনি সেই সময়ের সাক্ষী মানুষের কথা। ভাবিনি সেই সময়ের স্বচ্ছল মানুষদের কথাও। এই বইয়ে সেই সকল বিষয়ই এসেছে খুবই বিস্তারিতভাবে।

এই বইয়ে অধ্যায় আছে তিনটা। প্রথম অধ্যায়- হতভাগ্য লোকটি। দ্বিতীয় অধ্যায়- যে লোকটি মারা গেছে। তৃতীয় অধ্যায়- লোকটি এখনও মারা যায়নি। প্রথম অধ্যায়ে একজন বিদেশি কাল্পনিক রাষ্ট্রদূতের কয়েকটি চিঠির মাধ্যমে কলকাতা শহরের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো নিয়ে স্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক নেতারা কি ভাবছেন সেটাও উঠে এসেছে। সরকার দুর্ভিক্ষটাকে কতখানি স্বীকার করে নিয়েছে সেটাও তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে সুশীল সমাজে দুর্ভিক্ষের স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে। আর তৃতীয় অধ্যায়ে দুর্ভিক্ষে মারা যাওয়া একটি লাশের মনের কথা পুংখানুপুংখুভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

শুরুতেই আছে কলকাতা শহরের বর্ণনা। বইয়ের ভাষায়- ‘কলকাতা ভারতের সবচেয়ে বড় শহর। ভারতের সবচেয়ে আশ্চর্য নিদর্শন হাওড়া ব্রিজ। বাঙালি ভারতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান জাত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতের সবচেয়ে বড় পতিতালয় কলকাতার ‘সোনাগাছি’। কলকাতার অদূরে সুন্দরবন ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগারে’র সর্ববৃহৎ বিচরণভূমি। সর্ববৃহৎ পাট ব্যবসা কেন্দ্রও কলকাতা। কলকাতার সবচেয়ে প্রিয় মিষ্টির নাম ‘রসগোল্লা’।

সেই শহরেই হানা দেয় শতাব্দীর সবচেয়ে বড় মন্বন্তর। শুরুতে অভুক্ত মানুষগুলোর অস্থি-চর্মসার দেহগুলোকে রিকেট রোগে আক্রান্ত বলে প্রচার করা হচ্ছিল। পরে যখন লাশের সংখ্যা বাড়তে থাকলে সেগুলো যখন পত্রিকার পাতায় ছবি আকারে আসছিলো তখনও সরকার এগুলোর প্রতিকারের যথাযথ ব্যবস্থা না করে অপপ্রচার বলেই দাবি করছিল। এভাবেই মন্বন্তরে মৃতের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এরই মধ্যে পালন করা হচ্ছিল ‘বাংলা দিবস’। যেখানে পরিবেশন করা হচ্ছিল অনেক পদের খাবার এবং পানীয়।

মানুষের মৃত্যুর এই মিছিলকে তুলনা করা হচ্ছিল ‘হতভাগ্য ইঁদুরের দলের’ সঙ্গে। ভারতে ইঁদুর এবং মানুষের জন্মহার সবচেয়ে বেশি। যেমন তাড়াতাড়ি জন্মে তেমনি তাড়াতাড়ি মারাও যায়। ইঁদুর যদি মরে প্লেগে, ভারতবাসী মরে হাড় জিরজিরে রোগে। ইঁদুর প্লেগে মরে; কিন্তু ভারতীয় লোকজন উভয় রোগেই মরে। আর এই দুর্ভিক্ষের কারণ হিসাবে দেখানো হচ্ছিল বাঙালির পেটুক স্বভাবকে। ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ বিক্রি হচ্ছিল খুবই সস্তা দরে। যেখানে একটা চীনা পুতুলের দাম ছয় টাকা সেখানে একটা মেয়ে বিক্রি হচ্ছিল মাত্র দেড় টাকায়।

কল্পিত দূতাবাসের সামনে প্রতিদিনই মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যেত। সেখানে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ। সব বয়সের লাশই পাওয়া যেত। মা মারা গেছে আর অবুঝ শিশু মায়ের বুকে পড়ে আছে দুধের আশায়। একদিন দূতাবাসের সামনে পড়ে থাকতে দেখা যায় একজন সংগীতশিল্পীর মরদেহ। যার এক হাত আঁকড়ে ধরেছিল সেতার আর অন্যহাতে ধরা ছিল একটা কাঠের ঝুমঝুমি। একটা বাদ্যযন্ত্র এবং একটা খেলনার অপূর্ব সহাবস্থান। এই বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে এই শিল্পী আবার ফিরে আসে যদিও লাশরূপে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সমাজের উঁচুতলাতে দুর্ভিক্ষের স্বরূপ। সেখানে বিলাসব্যসনে মত্ত নারী পুরুষ তাদের মেকি আবেগ দেখাচ্ছে। তহবিল সংগ্রহ করার নামে চলছে আরও বেশি বিলাসিতা। চলছে নতুন নতুন প্রস্তাব পাশের মহড়া। কিন্তু যখন বাস্তবে তাদের সামনে অভুক্ত মানুষ হাজির হচ্ছে তখন তারা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে তাদের কাছ থেকে। এমনকি তাদের গায়ে হাত তুলতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না সুশীল মানুষগুলো।

বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়টা পড়ার জন্য মনের জোর থাকতে হবে। না হলে না পড়াই শ্রেয়। কারণ এই সত্য বয়ান পড়লে আপনি নিজের অজান্তেই অপরাধবোধে ভুগবেন। এই পর্বে মৃত ব্যক্তির মরদেহ কথা বলে উঠে। একে একে বলে যায় তার জীবনের প্রেম, সংসার, স্ত্রী, সন্তানের গল্প। আর শেষ পরিণতি হিসাবে তিনজনই হয়ে যায় লাশ। এই পর্বে মানুষের ক্ষুধার স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে খুবই রূঢ়ভাবে। বলা হয়েছে মানুষ মরে লাশ হয়ে গেলেও তার ক্ষুধা মেটে না। এককণা খাবার পেলেই যেন সে আবার জীবন্ত হয়ে উঠবে। বলা হচ্ছে কলকাতায় মরা মানুষও যেন ভিক্ষা চায়।

অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে মানুষ নিজেকে অভিসম্পাত দিতে থাকে মানুষ হয়ে জন্মানোর জন্য। তার চেয়ে বরং চালের একটি কণা হয়ে জন্ম নিলেও জীবনের একটা মানে করা যেত। নিজেদের মৃত্যুকে তারা পিঁপড়া আর ইঁদুরের চেয়েও বীভৎস উল্লেখ করছিল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে স্বামী বিক্রি করছিল স্ত্রীকে, মা বেচে দিচ্ছে মেয়েকে, ভাই বিক্রি করে দিচ্ছে বোনকে। জীবন যেন তার জৈবিক নগ্নরূপে মূর্ত, ক্ষুধার্ত, নিষ্ঠুর আর ভয়ংকর হিংস্র পশুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক সেইসময় তেহরানে চলছে ত্রিশক্তির বৈঠকে নেতারা ঘোষণা দিচ্ছে নতুন পৃথিবী গড়ার। এ এক অসম্ভব বৈপরীত্য।

সেতার বাদকের মেয়েও ক্ষুধার জ্বালায় করুণ মুখ করে কেঁদে চলছিল। দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনো ভয়ার্ত পশু। মৃত্যু আসার আগে পর্যন্ত যেন সেই কান্না চলতে থাকবে। একটা সময় তার স্ত্রী মেয়েটাকে বিক্রি করে দেওয়ার কথাও বলে এবং এরপরই সে মারা যায়। তখন বাদকের মনে খেলা করতে থাকে একটি ভাবনা। যে নারীই জীবনের উৎস এবং ভবিষ্যৎ সেই কোমল নারীই কতটা পাষাণ হয়ে যেতে পারে ক্ষুধার তাড়নায়। এরপর একটা সময় ডাঙায় তোলা মাছের মতো তড়পাতে তড়পাতে মেয়েটিও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পূর্ব মুহূর্তে মেয়েটি তার সাত রাজার ধন, একমাত্র সম্পত্তি ঝুনঝুনিটা তুলে দিয়ে যায় বাবার হাতে। বাবার কাছে সেই ঝুনঝুনিটা যেন ক্লিওপেট্রার প্রেম, মমতাজের তাজমহল, রানী ভিকটোরিয়ার সমগ্র রাজত্ব হিসাবে ধরা দেয়। এরপর একসময় বাবা কলকাতা পৌঁছায়। কিন্তু সেখানে তাদের মানুষ বলে গণ্য করা হয় না। সেখানে একই ডাস্টবিনে কুকুর আর মানুষ খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। উচ্ছিষ্টের অংশ নিয়ে মানুষে কুকুরে লড়াই চলছে। কিন্তু পাশাপাশি সড়ক ধরে ছুটে যাচ্ছে বিপুলাকার মোটরগাড়ি যার মধ্যে মানুষের ঠোঁটে ছুটছে হাসির ফোয়ারা।

ক্ষুধা ধর্মকে পর্যন্ত হত্যা করেছিল। মন্বন্তরের দুঃসময়েও ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে ব্যবধান তৈরি করে রাজনীতি করা থেমে ছিল না। বাদককে একদল হিন্দু ঠাউরে পায়ে দলে এগিয়ে যায়। আরেকদল তাকে মুসলমান ভেবে সাহায্য করা থেকে বিরত রাখে নিজেদের। তার দেহে এতটুকু শক্তিও অবশিষ্ট ছিল না যে সে চিৎকার করে বলতে পারে - 'আমি একজন ক্ষুধার্ত মানুষ।'

এরপর সেতার বাদক স্বগোতক্তি করেন সেটা দিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই। যেটা আসলে সব মানুষেরই মনের কথা।

আমরা সবাই পৃথিবী নামক একই গ্রহের বাসিন্দা। আমাদেরকে বাঁচতে হবে সবার তরে। বইয়ের ভাষায়- ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমার সেতারে একটা বেসুরো তার থাকে, ততক্ষণ সমস্ত রাগিণী বেতাল বাজতে থাকবে। যত দিন একজন মানুষও অনাহারে থাকবে, তত দিন পর্যন্ত সমস্ত পৃথিবী অনাহারে থাকবে, যত দিন একটি মানুষও দরিদ্র থাকবে, প্রত্যেকেই তত দিন পর্যন্ত দরিদ্র থাকবে। যত দিন একটি মানুষও পরাধীন থাকবে, এই পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ তত দিন পর্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকতে বাধ্য।’

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]