ভয় নয় জয় করুন

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ১১:৩৯ এএম, ২৭ মে ২০২৩

ভদ্রলোক খুব বিপদের মধ্যে জীবন যাপন করছে। বন্ধু মহলে হঠাৎ মনের কথা বলছে। সারাজীবন নাকি তার কেটে চলছে শুধু ভয়ের মধ্যে যেমন; ছোট বেলায় বাবা-মাকে ভয়, ছাত্রজীবনে শিক্ষককে ভয়, চাকরি জীবনে বসকে ভয়, মরব, সেখানে বিচারের ভয়। হঠাৎ পাশ থেকে এক বন্ধু প্রশ্ন করে বসলো, বউ-এর কথা তো বল্লি না? ভদ্রলোক উত্তরে শুধু বলল ভয়ে বলিনি।

যদি বলি এই হচ্ছে বিশ্বের বেশির ভাগ স্বামী-স্ত্রীর অবস্থা, তাহলে অনেকে আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবে। আমি মত-দ্বিমতের ভয় পাচ্ছি তা নয়, মূলত বিষয়টি তুলে ধরছি এই কারণে, যদি আমরা ভয়কে জয় করতে চাই তবে কী কী পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।

বেশ কিছুদিন আগে সুইডেনের এক প্রধানমন্ত্রীকে জিঙ্গেস করা হয়েছিল তিনি কীভাবে তার স্ত্রীর সঙ্গে সংসার করছেন। উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘jag låter henne vinna’’. সোজা কথা তিনি তার স্ত্রী যা বলেন সেটাই মেনে নেন। পরে মন্ত্রী বন্ধু মহলে তার সিক্রেট ফাঁস করেন, মূলত স্ত্রীকে তিনিই জেতান যার ফলে একটা উইন উইন সম্পর্ক তাদের মধ্যে সর্বক্ষণ।

বিষয়টি আমার মনে ধরেছিল বেশ। পরে বেশ ভেবেছি যেমন স্রষ্টা সব কিছু সৃষ্টি করেছেন, তিনি ইচ্ছে করলে যখন তখন যা কিছু করতে পারেন কিন্তু সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী সত্ত্বেও কিছু করেন না। এই না করাটাই হচ্ছে বিশাল ক্ষমতা। আমরা মানুষ জাতি প্রতিশোধ নিতে পছন্দ করি, পাল্টা উত্তর দিতে উঠেপড়ে লাগি কারণ জিততে হবে এটাই আমাদের প্রবণতা। কিন্তু নীরবতার মাঝেও যে জেতার প্রবণতা থাকতে পারে সেটা অনেক সময় ভুলে যায়!

আমি সুইডেনে প্রায় চল্লিশ বছর বসবাস করছি। স্বাভাবিকভাবে এই সমাজের সবকিছু আমার জন্য নতুন কিছু না। তারপরও আমি যেহেতু জীবনের এক তৃতীয়াংশ বাংলাদেশে কাটিয়েছি সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে যে শিক্ষাগুলো পেয়েছি তা কিন্তু মজবুত, কোনো রকম সামান্য বাতাসে নড়চড় করে না বা ঝড়ে ভেঙে পড়ে না। মানে সমস্যা হলেই যে সমস্যা তা ঠিক না, চেষ্টা করি; সমাধান খুঁজতে, বিষয়টি নিয়ে ভাবতে ইত্যাদি।

অনেক সময় দেখি এখানে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালো সম্পর্ক যাচ্ছে না? আস্তে করে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সন্তান রয়েছে সমস্যা নেই, ভাগাভাগি করে নেয়, কে, কবে, কখন কী করবে। ঘ্যাটাঘেটির মধ্যে নেই এরা। সহজ চিন্তা ভালেবাসা আছে, আছি। ভালেবাসা নেই, নেই। আমি আবার চল্লিশ বছর এখানে থাকলেও এদের মতো হুট করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।

এর কারণ হচ্ছে আমি ঘ্যাটাঘেটি করতে পছন্দ করি। যেমন কেন ভালোবাসবা না? কার প্রেমে পড়েছ? আমার অপরাধ কি? হাজারভাবে ঘাটতে হবে। উচ্ছে বা লেবুর মতো কসলাতে কসলাতে জম্মের মতো তিতে বানাইয়ে জীবনের বারো বাজায়ে তারপর মারব এবং মরব। এই মনোভাব আমার মধ্যে কাজ করে ক্ষেত্রবিশেষ, যদিও চল্লিশ বছর বাংলাদেশ ছেড়েছি, ছাড়তে পারিনি কিছু অভ্যাস! এখন বলি কেন; ছোটবেলার দিনগুলো এখন বহু দূরে কিন্তু শিক্ষাগুলো দূরে নয়, সেগুলো আজীবন থেকে যাবে।

ইলিশ মাছ কেন সাগর ছেড়ে পদ্মা নদীতে ফিরে আসে? প্রকৃতির নিয়ম। জন্মের শুরুটা শিক্ষা, তথা জীবন চলার বীজ বপনের মূল মন্ত্র। সেটাকে শত চেস্টা করলেও ধুয়ে মুছে সাফ করা যাবে না। তবে সমাজে খাপ খাইয়ে চলা সম্ভব অতএব আমি সেটা করছি। আমি ঘটনাটি শেয়ার করব ভাবিনি এর আগে, তবে গত সপ্তাহে সুইডেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে আমি পড়েছি, আমার সুইডিশ জীবনের শুরুতে। সেখানে এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের ওপর গবেষণা করা হয় তাদের দৈনন্দিন জীবনের ওপর।

শিশুর লালন-পালন থেকে শুরু করে কোনো পরিবেশে চলা-ফেরা করে, কি খায়, কার সঙ্গে মেশে, কি পড়ে, কীভাবে পড়ে, কতটুকু সময় প্রযুক্তির সঙ্গে সময় দেয়, কীভাবে প্রযুক্তিকে কাজে লাগায়, একা একা সব কিছু করে, নাকি বাবা-মার সাথে করে এবং কখন সে ভালো ফিল করে বা করে না ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ফলোআপ করা এবং পরে সেটা চাকরি বা সংসার জীবনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। গবেষণাটি বহু বছর ধরে সুইডিশ মনোবিজ্ঞানীরা করে চলছে।

আমার বিশ্বাস এ ধরনের গবেষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে চলছে। তবে আমার রিফ্লেশন এখানেই সেটা হলো শিশুর জন্মে যেন অবহেলা না থাকে। শিশুকে পরিপূর্ণ করে গড়ে তুলতে যেন দ্বিমত না থাকে। যে শিশুর জন্মে পূর্ণাঙ্গতা পেয়েছে ভালো মন্দের, সেই শিশু বড় হয়ে সবচেয়ে বেশি মানিয়ে নিতে শিখেছে জীবনে, হোক না সে জীবন কঠিন বা ফুলশয্যায় পরিপূর্ণ তাতে কিছু যায় আসে না।

আমি আমাকে গর্বিত বাংলাদেশি হিসাবে চিহ্নিত করতে চাই যদিও সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম হয়নি আমার, তবে বাবা-মার শাসন, ভালোবাসা, আদর-যত্ন এবং সঠিক শিশুশিক্ষা আমাকে বিশ্বনাগরিক হতে সাহায্য করেছে। কারণ আমি জন্মসূত্রে বাংলাদেশি, আমার বউ-এর মা সুইডিশ, বাবা স্পেনিশ। আমি বসত করি সুইডেনে এবং ঘুরি বিশ্বভূবন, চলছি সবার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]