পেশোয়ার এক্সপ্রেস ‘দাঙ্গার গল্প’

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০১:০৮ পিএম, ২৭ মে ২০২৩

লেখনীর মাধ্যমে যারা সাম্প্রদায়িতা বিরোধী আওয়াজ তুলেছিলেন, কৃষণ চন্দর ছিলেন তাদের পুরোভাগে। তিনি লিখেছেন দাঙ্গাবিরোধী ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’ এর পাশাপাশি একই বিষয়ভিত্তিক আরও কিছু অসাধারণ গল্প। এগুলোই পরবর্তীকালে হ্যাম ওয়াহসি হ্যায় (আমরা বর্বর) শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বইটি লাখনৌ থেকে ১৯৪৭ সালে প্রথম প্রকাশিত করেছিল ‘কিতাবি দুনিয়া’ প্রকাশনা সংস্থা।

তারই ভূমিকা লিখেছিলেন প্ৰখ্যাত উর্দু কবি আলি সরদার জাফরি। জাফরির এই ভূমিকার ভেতর দিয়ে কেবল কৃষণ চন্দরের এই গল্পগুলো সম্পর্কেই কথা নেই, প্রশংসাবাক্য নেই, যে পটভূমিতে এই গল্পগুলোর জন্ম, সেই পটভূমিরও আছে বিশদ বিবরণ। সে বিচারে আলি সরদার জাফরির এই ভূমিকার একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে। এই গ্রন্থের মোট সাতটি গল্প উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন জাফর আলম।

আলি সরদার জাফরি তার ভূমিকায় দাঙ্গার পেছনের কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তার ভাষায়, ‘আজকের গৃহযুদ্ধ হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষের লড়াই নয়। বরং বিপ্লব ও স্বাধীনতার সন্ধিক্ষণে বিপ্লবের শত্রুসেনারা এই হালিমা চালায়।... এসব প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লবের শত্রুকে হামলা চালানোর ব্যাপারে সুসংগঠিত করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ব্রিটিশ সামরিক অফিসার এবং ব্রিটিশ প্রশাসন। ১৯৪৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান টাইমস-এ (লাহোর) চিঠিপত্রের পাতায় জ্যাকসন নামের একজন ইংরেজ অফিসারের একটি চিঠি ছাপা হয়েছে। ইংরেজদের ষঢ়যন্ত্র ফাঁস করে দেওয়ার জন্য এই চিঠিটিই যথেষ্ট।’

দাঙ্গার মাধ্যমে ঘৃণার যে বিষ সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সেটা দেখে মনে হয়েছিল এদেশে গৌতম বুদ্ধ জন্ম নেয়নি। এশিয়ার মানুষের কানে আরব দেশের রসুলের বাণী পৌঁছায়নি। যেন অজন্তার গুহাচিত্র কখনো আঁকা হয়নি, ইলোরার মূর্তি কখনো গড়া হয়নি। তাজমহল কখনো নির্মিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ইকবাল কখনো ভালোবাসার গান রচনা করেননি। তাই এই বিষয়ে লেখক হিসেবে আমাদের নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ পর্যন্ত যা কিছু লেখা হয়েছে, সেগুলোকে বেশ ভালো বলতে হবে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। এসব বিষবাষ্পের বিরুদ্ধে লেখকদের আওয়াজ তোলার জন্য জাফরি আহ্বান জানাচ্ছেন।

এই বইয়ের গল্পগুলোর নাম- উন্মাদ, লালবাগ, অমৃতসর: ভারত বিভাগের আগে, অমৃতসর: স্বাধীনতার পরে, পণ্ডিত নেহরু ও জিন্নাহর প্রতি পতিতার খোলা চিঠি, পেশোয়ার এক্সপ্রেস এবং জ্যাকসন। উন্মাদ গল্পটাতে একই মহল্লায় বসবাসরত সংখ্যালঘু দুই ঘর হিন্দু বাসিন্দাদের ওপর হামলার কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে।

বলা হয়েছে, ‘আসলে এমন কোনো বিধর্মী কি আছে, যাদের কাছে মুসলমানরা ধোঁকা খায়নি। হিন্দু মেয়েদের লজ্জা-শরমের বালাই নেই। তারা পর্দা করে না। মারপিট, হাঙ্গামা আর গন্ডগোল না হলে কোনো মজা নেই। শান্তি কমিটি হচ্ছে স্রেফ লোক দেখানোর জন্য। এই তো সেদিনকার কথা, সারা ভারতের ওপর আমরাই রাজত্ব করেছি। আর ডাল খাওয়া কাফেররা তখন আমাদের জুতোর নিচে বসে থাকতে আনন্দ পেত’।

‘লালবাগ’ গল্পে লালবাগ এলাকার চারজন মুসলমান হত্যার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে প্রত্যেককে খুন করার পারিশ্রমিক মাত্র পঞ্চাশ রুপি। চারজনের মধ্যে প্রথমজন একজন যুবক যার হাতে একটা তেলের শিশি ধরা। হয়তোবা তার মা তরকারি রান্না করার প্রয়োজনে আনতে পাঠিয়েছিল। দ্বিতীয়জন এলাকার ঠেলাগাড়িতে করে চীনাবাদাম বিক্রেতা শিধো যে সবার কাছেই সুপরিচিত ছিল।

তার জীবনটা ছিল পুরোনো বইয়ের ছেঁড়া পাতা। তার প্রতিটি পৃষ্ঠায় ফুটে ছিল ক্ষুধা, বেকারত্বে, রোগ, আর দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ ছবি। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এই কাঁদামাটিতে চলাফেরা করেছে। তার মুখে কোনো দিন দুবেলা আহার জোটেনি। তার কান কোনো দিন ইকবালের রচনা করা গান শোনেনি। আর তার চোখ জোড়া কখনো সুন্দর কোন দৃশ্য দেখেনি। তার এই ধারাবাহিক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়াকে কি জীবন নামে আখ্যায়িত করা যায়?

শিধোর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে এইভাবে, ‘তার সারাটা জীবন হিন্দুদের সঙ্গেই কেটেছে। তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন আর বৃদ্ধকাল কেটেছে তাদের সঙ্গে একই ছাদের নিচে। এই মহল্লাতেই তার বিয়ে হয়েছে। গুজরাটি শেঠরা তাকে বিয়ে উপলক্ষে পাঁচশ রুপি সাহায্য করেছে। তার বউ আর ছেলেপিলেরা নির্ভয়ে এলাকায় ঘোরাফেরা করত। সে লালবাগের সৃষ্টি এবং এই পরিবেশেরই অংশবিশেষ। তাদের আনন্দ, বেদনার অংশীদার সে। এদের ছেড়ে সে কোথায় যাবে। দাঙ্গা শুরু হলে অনেক মুসলমান তাকে লালবাগ ছেড়ে যেতে বলেছিল। কিন্তু শিধো তাদের কথায় কান না দিয়ে বলেছে, আমি হিন্দুদের মধ্যে থাকি। আমাকে কেউ কিছু বলবে না।’

এছাড়াও হত্যা করা হয় দুজন তরুণ তরুণীকে। ধারণা করা হচ্ছে তারা ছিলেন স্বামী স্ত্রী। তাদের অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠেছে- ‘অত্যাচারীরা, তোমরা একজন মুসলমানকে হত্যা করোনি, তোমরা একজন মানুষকে হত্যা করেছ, হিন্দুস্তানকে হত্যা করেছো। তোমরা তাজমহল, ফতেহপুর সিক্রি আর শালিমারবাগকে হত্যা করেছ।’

সন্ধ্যায় দৈনিক খবরের কাগজে এই খবরগুলো ছাপা হয় এইভাবে, ‘শুধু লালবাগে ছুরিকাঘাতের চারটি ঘটনা ঘটেছে। অন্য আর সব জায়গার পরিস্থিতি শান্ত ছিল।’ এভাবেই রাষ্ট্রযন্ত্র সবসময় খারাপ কাজগুলোকে স্বীকার করে নিয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিয়ে সেগুলোকে লাই দিয়ে যায়।

‘অমৃতসর’ নিয়ে দুটো গল্প আছে, ভারত বিভাগের আগে আর স্বাধীনতার পরে। দাঙ্গার সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে পাঞ্জাবের অমৃতসর ছিল অন্যতম। আমার মনে হয় তাই লেখক এই এলাকাটাকে বেছে নিয়েছিলেন তার কেস স্টাডির ক্ষেত্র হিসেবে। অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ হিন্দু, শিখ আর মুসলমান এক হয়ে প্রতিবাদ করেছিল ইংরেজি শাসনের।

তাদের হাতে কোনো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল না কিন্তু তাদের প্রখর চোখের চাহনি থেকে যেন উত্তপ্ত লাভা নির্গত হচ্ছিল। সেই হাজারো মানুষের ভিড়ে গুলিবর্ষণ করা হয়। তখন শিখের রক্ত মুসলমানের আর মুসলমানের রক্ত হিন্দুর রক্তের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এই বিশাল আকাশের নিচে একটি মাত্র লক্ষ্য ও আবেগের জন্য বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোকজনের জীবন উৎসর্গ করার ঘটনা বিরল।

একদিন রামদাস লেনের দুজন মুসলমান জয়নব আর বেগম, একজন হিন্দু পারুল আর একজন শিখ শ্যাম কাউর তরকারি কিনতে গিয়েছিল। ফেরার সময় কারফিউ শুরু হয়ে যায়। গোরা সৈন্যরা তাদের হাঁটু ঘষতে ঘষতে যেতে বললে শুরুতেই শ্যাম কাউর সোজা হেঁটে যায় এবং শহীদ হয়। এরপর জয়নব আর বেগমও একইভাবে যেতে শুরু করলে তারাও শহীদ হয়।

তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভীতু ছিল পারুল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারুলও গোরা সৈন্যদের মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়ে হাটতে শুরু করে এবং একই পরিণতি বরণ করে নেয়। ঘরের বউ, পর্দানশিন নারী, স্নেহময়ী মা, যাদের বুকগুলো স্বামীদের জন্য ভালোবাসা আর শিশুদের জন্য ময়-মমতায় ছিল ভরা, তারা গোরা সৈন্যদের নির্যাতনের শিকার হলো। তাদের শরীরগুলোতে ঝাঁজরা হয়ে গেলেও তাদের পাগুলো একটুও টলেনি।

এই গল্পটার একটা সমাপ্তি টেনেছেন লেখক এইভাবে, ‘শ্যাম কাউর, জয়নব, পারুল আর বেগম- আজ কেবল তোমরাই এই গলি দিয়ে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাওনি বরং তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র দেশও এগিয়ে গেছে। স্বাধীনতার ঝান্ডা আজ এই গলি দিয়ে অতিক্রম করেছে। আজ তোমার দেশ, তোমাদের সভ্যতা, তোমাদের ধর্মের মর্যাদাপূর্ণ রীতিনীতি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আজ মানবতার মস্তক গর্বে উঁচু হয়ে উঠেছে, তোমাদের আত্মার প্রতি হাজারো লাখো সালাম।’

ভারত বিভাগের আগে ভারতে মানুষে মানুষে এমনই দৃঢ় ছিল ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। কিন্তু স্বাধীনতার পরে সেই একই এলাকায় বিরাজ করে চরম বীভৎস পরিস্থিতি যেটা ফুটে উঠেছে পরের গল্পে। এই সেই পাঞ্জাব যেখানে তিন ধর্মের লোকের বসবাস ছিল। কিন্তু তাদের হৃদয় ছিল এক ও অভিন্ন। তাদের পোশাকপরিচ্ছদও একই ধরনের। এরপর পাঞ্জাবের কাগজের মানচিত্রের কালির দাগ দিয়ে তার হৃদয়কে চিরে দেওয়া হয়।

এরপর শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। তখন পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু নিয়ে যেসব ট্রেন আসতো তার গায়ে লেখা থাকতো ‘হত্যা করা পাকিস্তানের কাছ থেকে শিখে নাও’। আর ভারত থেকে আসা স্পেশাল ট্রেনে লেখা থাকতো ‘প্রতিশোধ কিভাবে নিতে হয় হিন্দুস্তানের কাছ থেকে শিখে নাও’। যাদের হত্যা করা হচ্ছিল এবং যাদের সম্ভ্রম লুট করা হচ্ছিল তাদের মধ্যে ছিল আমাদের আগের গল্পের জয়নবের মা’ও। তখন তার মনে এই প্রশ্ন খেলা করছিল যে জয়নব কি দেশের আজাদির জন্য জীবন উৎসর্গ করেনি।

সুজলা সুফলা পাঞ্জাবে আসলো স্বাধীনতার রাট। সেই রাতের বর্ণনা লেখক দিয়েছেন এভাবে, ‘দেওয়ালি উৎসবেও এত প্রদীপ জ্বলে না। কারণ দেওয়ালি উৎসবে তো শুধু প্রদীপ জ্বলানো হয়। এখানে বাড়ির পর বাড়ি জ্বলছে। দেওয়ালি উৎসবে আতশবাজি পোড়ানো হয়, পটকা ফোঁটানো হয়। এখন বোমা ফোঁটানো হচ্ছে, আর মেশিনগানের গুলি চলছে। ইংরেজ রাজত্বে কোনোক্রমে একটি পিস্তলও পাওয়া যেত না। আজাদির প্রথম রাতে এতগুলো বোমা, হাতবোমা, স্টেনগান, ব্রেনগান কোথা থেকে এল? এসব অস্ত্র ব্রিটিশ ও মার্কিন কোম্পানির তৈরি।’

পরের গল্পে একজন পতিতা খোলা চিঠি লিখেছেন পণ্ডিত নেহেরু ও জিন্নাহর প্রতি। সেই পতিতার আশ্রয়ে আছে দুজন মেয়ে শিশু যাদের নাম বতুল এবং বেলা। কিন্তু তারা দুজন দুই ধর্মের। বেলা হিন্দু আর বতুল মুসলিম। দুজনকে তিনি কিনেছেন দুজন দালালের কাছ থেকে। তারা তার বাড়িতে পেছনের ঘরে দুই সহোদর বোনের মতো থাকে। তিনি চান না মেয়ে দুটিকে পতিতার জীবন দিতে।

তিনি চান পন্ডিতজি বতুলকে কন্যা হিসাবে গ্রহণ করুক আর জিন্নাহ সাহেব বেলাকে দত্তক কন্যা হিসাবে নেন এবং তাদেরকে হেফাজতে রাখুন। তিনি সেই চিঠিতে তাদের নির্যাতিত মানুষের শোকগাথা শোনার আহ্বান জানিয়েছেন। যে ধ্বনি নোয়াখালী থেকে রাওয়ালপিন্ডি পর্যন্ত এবং ভরতপুর থেকে বোম্বাই পর্যন্ত গুঞ্জরিত হচ্ছে। নিশ্চয়ই তারা গভর্নমেন্ট হাউসে বসে এই আওয়াজ শুনতে পান না। তবে পতিতার দৃঢ় বিশ্বাস একদিন এই আওয়াজ তারা শুনতে পাবেন।

নাম গল্পটা আলোচনা করার আগে শেষের গল্প ‘জ্যাকসন’ এর দিকে আলোকপাত করতে চাই। যেখানে ভারতবাসীর প্রতি ইংরেজদের মনোভাব ফুটে উঠেছে। গল্পের মূল চরিত্র অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পুলিশ কর্মকর্তা জ্যাকসনের ভাষায়, ‘এই অসভ্য হিন্দুস্তানিরা সব জিনিসে ভেজাল দেয়। দুধে, চিনিতে, ঘিয়ে, কাপড়ে আর ফসলে-সবকিছুতেই। এমনকি রক্তেও তারা বাজে রক্ত মিশিয়ে দিয়েছে। শালার শুয়োরের।’

কিন্তু একটা সময় জ্যাকসনের ছোট মেয়ে রোজি আবিষ্কার করে ভারতবাসীর মহত্ত্ব। তার ভাষায়, ‘শেক্সপিয়ারের শ্রেষ্ঠত্ব, গ্যয়টের দর্শন আর শেলীর প্রেম-সবকিছু মেঘদূত-এ আছে। যে জাতি এমন কাব্যচর্চা করতে পারে, কবিতা লিখতে পারে, তাদের অসভ্য বলা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।’

নাম গল্প ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’ আসলে একটা ধাতব ট্রেনের স্বগতোক্তি। লেখক অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ট্রেনের অভিব্যক্তি বর্ণনা করেছেন। দাঙ্গার সেই সময়ে ট্রেনে করে সংখ্যালঘু উদ্বাস্তুদের একদেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তেমনি একটি ট্রেনের নাম পেশোয়ার এক্সপ্রেস। যেটা পাকিস্তানের পেশোয়ার থেকে যাত্রা শুরু করে ভারতে যেয়ে থামবে। এই গল্পে প্রতিটা স্টেশনের ভয়ের চিত্র, ট্রেনের ভেতরের যাত্রীদের চিত্র খুবই বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

বইয়ের ভাষায়, ‘ভয়ে-আতঙ্কে এসব পরিবার তাদের পুরোনো বসতবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। এখানে তারা হাজার বছর ধরে বসবাস করেছে। এখানকার পাহাড়ি জমি তাদের শক্তি-সাহস জুগিয়েছে, তার তুষার-ঝরনা তাদের তৃষ্ণা মিটিয়েছে এবং এই ভূমির রোদ-ঝলমল বাগান থেকে তোলা মিষ্টি আঙুরের স্বাদ ভরিয়ে দিয়েছে তাদের প্রাণ। হঠাৎ একদিন এই দেশ-গ্রাম তাদের কাছে অপরিচিত হয়ে গেলো।

গাড়ির প্রতিটি বগিতেই মৃত্যুর হিম স্পর্শ। মাঝখানে শোয়ানো মরদেহগুলো আর চারপাশের জীবন্ত মৃতেরা বসে আছে ট্রেনের সিটে। কোথাও একটা বাচ্চা কেঁদে উঠেছে। এক কোনায় মা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। স্বামীর মরদেহ আঁকড়ে ছিল মহিলা। ট্রেনের যদিও চোখ-কান কিছুই নেই, তবুও সেইসব দৃশ্য যেন ট্রেনটা দেখতে পেল এবং শুনতে পেল মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের কাতরধ্বনি। এক একটা স্টেশনে থামার পর যতক্ষণ পর্যন্ত শরণার্থীরা ঘৃণাকে বিদায় না জানায় ততক্ষণ পর্যন্ত সেই স্টেশন ছেড়ে যাত্রা করা ছিল খুবই দুষ্কর। এভাবেই ট্রেনের বুকে অনেক ক্ষত জমে এবং তার কাঠের শরীরে খুনিদের রক্তের দাগে ময়লা জমতে থাকে।

এরপর একটা সময় ট্রেনটা গন্তব্যে পৌঁছে এবং তাকে ধুয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে শেডের নিচে রাখা হয় কিন্তু সে ভুলতে পারে না দাঙ্গার বীভৎস রূপ যেটা সে তার যাত্রাপথে প্রত্যক্ষ করেছে। তাই সে আর এই ধরণের কোনো যাত্রার জন্য যেতে চায় না। বরং সে যেতে চায় কোন আনন্দযাত্রায় ঠিক যেমনটা আমরাও চাই, ‘আমি চাই, আমার প্রতিটি বগিতে সুখী চাষী ও শ্রমিকের দল এবং তাদের স্ত্রীদের কোলে থাকবে পদ্মফুলের মতো সুন্দর সব শিশু। ওরা মৃত্যুকে নয়, বরং আগামী দিনের জীবনকে মাথানত করে কুর্নিশ করবে। এই সব শিশুই এক নতুন জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলবে, যেখানে মানুষ হিন্দু ও মুসলমান হিসেবে পরিচিত হবে না। শুধু পরিচিত হবে একমাত্র মানুষ হিসেবে।’

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]