গাধার আত্মকথা-সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে ব্যঙ্গ

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ১১:২৪ এএম, ৩১ মে ২০২৩

কৃষণ চন্দর সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমে বিশ্বাসী ছিলেন। ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী। সম্ভবত কৃষণ চন্দর সেই মুষ্টিমেয় উর্দু লেখকদের অন্যতম যারা কেবল সাহিত্য রচনা করে পাওয়া অর্থের ওপর নির্ভর করেই জীবন ধারণ করেছেন। তিনি জীবনকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। জীবনকে তিনি হৃদয়ের মাধুরী মিশিয়ে কাব্যময় করে তুলতেন-গল্পের প্লট ও চরিত্রগুলোকেও।

রসাত্মক রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। গাধার আত্মকথা, গাধার প্রত্যাবর্তন, শয়তানের ইস্তফা, কিতাবের কাফন ইত্যাদি গ্রন্থ তার এ জাতীয় রচনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কৃষণ চন্দর আত্মকথায় লিখেছেন, তার ব্যাপারে পণ্ডিত নেহরুর এলার্জি ছিল, বিশেষত গাধার আত্মকথা বইটি লেখবার পর সেটা আরও বেড়ে যায়। এই বইয়ে পণ্ডিতজির সঙ্গে গাধার দেখা হওয়ার ব্যাঙ্গাত্মক সংলাপ আছে।

ব্যাঙ্গাত্মক রচনা লেখা আমার কাছে সবচেয়ে কঠিন কর্ম মনে হয়। এই ধরনের রচনা লিখতে গেলে সেই বিষয় সম্মন্ধে সম্যক জ্ঞান থাকা জরুরি। তা নাহলে সেটা একটা সময় গিয়ে সাধারণ বর্ণনামূলক রচনার রূপ নেয়। পরিচিত লেখকদের মধ্যে সমাজ সংস্কারক ব্যাঙ্গ একজনই লিখেছেন তিনি হচ্ছেন আবুল মনসুর আহমদ।

তবে উনার রচনার বিস্তৃতি সমাজের কোনো একটা অংশে সীমাবদ্ধ। পুরো একটা সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো ব্যাঙ্গাত্মক রচনা এই প্রথম পড়লাম। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পুরো সমাজব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এই ছোট্ট বইটা। সমাজের প্রত্যেকটা বিষয়কে অতি যত্ন সহকারে লেখক তুলে এনেছেন উপন্যাসধর্মী এই রচনায়। পড়তে গিয়ে বারবারই নিজের বা নিজেদের দৈনন্দিন কর্মপন্থা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছিল মনে। একজন গাধার দৃষ্টিতে পুরো সমাজকে দেখা এবং তার খুঁতগুলো তুলে ধরার ব্যাপারে লেখক পুরোপুরি সার্থক।

এই ছোট কলেবরের বইটাতে সমাজে বিদ্যমান প্রত্যেকটা বৈষম্যকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করেছেন। শুরুতেই গাধা তার পরিচয় দিচ্ছেন- ‘ভদ্রমহোদয়গণ, গোড়াতেই বলে রাখি, আমাকে কোনো সাধু-ফকির মনে করবেন না। আমি না কোনো পীর দস্তগীর, না স্বামী ঘমঘমানন্দ-এর চেলাচামুণ্ডা, না দোয়া তাবিজ দেনেওয়ালা সুফি গুরমুখ সিং মাঁঝিলা, না কোনো ডাক্তার, না হাকিম, না হিমালয়ের চূড়ায় আসীন কোনো মহাপুরুষ, না কোনো চিত্রতারকা, না রাজনৈতিক নেতা আমি নেহাত গোবেচারি এক গাধা।’

তার পরিচয়ে আরও বলা হয়েছে, সে শুধুই গাধা আর গাধাদের কোনো জাতিধর্ম হয় না। গাধার ভাষায়- ‘এক মুসলমান বা এক হিন্দু গাধা হতে পারে কিন্তু কোনো গাধা হিন্দু বা মুসলমান হয় না।’ আর গাধাদের কোনো আলাদা নাম পরিচয় থাকে না বংশানুক্রমিকভাবে সবাই গাধা। এতে লাভ হচ্ছে বংশ পরম্পরায় কুষ্ঠী মেলাতে সুবিধা হয়। আসলে গাধা যেন সমাজের নিচুতলার মানুষদের প্রতিনিধি। যাদের বংশপরিচয় নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তাদের জন্ম যেমন সবার অগোচরে তেমনই তাদের মৃত্যুও সবার অগোচরেই ঘটে থাকে।

সেই গাধা কীভাবে মানুষের ভাষা শিখলো তারও বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, ‘ছোট বেলায় ভুলক্রমে খবরের কাগজ পড়ার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলাম।’ তার প্রথম প্রভু ছিলেন একজন দিনমজুর ধন্নু কুমার। তাকে দিয়ে ইট টানার কাজ করাতেন। এরপর তার জীবন চলতে থাকে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বহতা নদীর মতো। আর জীবনের বাঁকে বাঁকে অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং সেই সম্মন্ধে তার মতামতের প্রতিফলনই এই বইয়ের বিষয়বস্তু। সমাজের নিচু শ্রেণির হাজার হাজার কোটি কোটি লোকের জীবন সত্যি গাধার জীবনের চাইতেও অধম।’

‘তাদের জীবন চলে প্রত্যেহ একই রুটিনে। তাদের এই অবস্থায় পতিত হবার জন্য গাধা পরিস্থিতিকে দায়ী করেছেন। তার ভাষায়, অপরাধ সম্ভবত পরিস্থিতির, যে পরিস্থিতি তাদের মানুষ থেকে পাশবিক জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে। সমাজের এই অবস্থাকে তো আর ডাণ্ডা পেটা করে ঠিক করা যায় না।’ তাই তারা দিনশেষে ঘরের বউ অথবা গাধা পিটিয়ে মনের রাগ মেটায়।

এরপর সবিস্তারে এসেছে তার দ্বিতীয় মালিক রামু ধোপার জীবনে গল্প। তারপর রামু ধোপাকে কুমিরে খেয়ে ফেললে গাধা সরকারের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে ধর্না দিয়েছেন। সরকারি এক কর্মচারী থেকে অন্য কর্মচারী, এক ডিপার্টমেন্ট থেকে অন্য ডিপার্টমেন্টে কীভাবে একজন সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির স্বীকার হতে হয় তার রূঢ় অথচ বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে টি বইয়ে। সেই বর্ণনা অত্যন্ত রসালো ভাষায় লেখক বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাটা গাধার কণ্ঠে হলেও সমাজের মানুষ বুঝতে পারবে এগুলো কতটা বাস্তব।

এভাবে একটা সময় তার দেখা হয়ে যায় তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরুর সঙ্গে। তার সাথে বাক্যালাপের কিছু অংশ এমন, ‘মাফ করবেন পণ্ডিতজী, আপনার রাজ্যে রামু ধোপা, জুমন চামার বা ডণ্ডমল মজদুরের মতো লোকদের সাথে আপনার দেখা মেলে না। যাদের দেখা মেলে তারা হলেন গাড়িওলা। গাধাওয়ালা একজনও পাওয়া যাচ্ছে না।’ আসলে এই দুনিয়াতে গাড়িওয়ালাদের দৌরাত্ম্যই বেশি, গাধাওয়ালাদের কোনো পজিশন নেই।

গাধা বলছেন যে তিনি কথা বলতে পারেন বলেই তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে কিন্তু লাখ লাখ মানুষ এমন আছে যারা আজীবন মানুষ হয়ে গাধার মতো কথা বলে চলেছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, আশরাফুল মখলুকাত। কিন্তু মানুষ আজ পুরোনো ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে মৃত্যুর মহা-গহ্বরের দিকে এগিয়ে চলেছে। তাদের মৃত্যুলীলায় কোটি কোটি মানুষ, গাধা, পশুপাখি, ঘরবাড়ি, গাছপালা, বনাঞ্চল সবকিছু একে একে ধ্বংস হতে যাচ্ছে। তাই মানুষের জন্য আজ সকল প্রাণিকুল ভীত-সন্ত্রস্ত। মানুষকে কেউ এই অধিকার দেয়নি যে, আণবিক শক্তির প্রতিযোগিতা করতে যেয়ে সারা বিশ্বের সবকিছু নিঃশেষ করে দেবে।

গাধা বলছেন, যদি মানুষ তার মানব-সুলভ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তাহলে তারা যেন গাধার বুদ্ধিতে, খরগোসের বুদ্ধিতে চলার চেষ্টা করে। তারা বনের পশুদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারে কীভাবে তারা নিজেদের শিশু সন্তানদের রক্ষা করে। এমনকি তারা চাইলে গাছের পাতার বুদ্ধিতেও চলতে পারে। আজ সমগ্র জীবজগৎ বিহবল চোখে মানুষের দিকে চেয়ে আছে। তারা তাদের কি দেবে- জীবন না অ্যাটম বোমা?

এরপর ঘটনাক্রমে গাধা এক সুন্দরী প্রতিযোগিতার প্রধান বিচারক বনে যান। তখন এই প্রতিযোগীদের যোগ্যতা মাপার মাপকাঠি তাকে প্রচন্ডভাবে আহত করে। তার মতে এটা মোটেও সঠিক মাপকাঠি নয়। তার মতে সৌন্দর্য মিশরের মমির মতো বিশেষ অস্তিত্ব নহে। তা হচ্ছে এক চলমান জীবনের বিবর্তিত রূপ। এটা কত নোংরা এবং অশালীন কথা হবে যদি রোমিও জুলিয়েট-এর প্রেমকে ফিতা দিয়ে পরিমাপ করার চেষ্টা করে অথবা প্যারিসের লোকেরা হেলেনের রূপকে কোন মেশিন দিয়ে পরিমাপ করার চেষ্টা করে অথবা সতীসাধ্বী সীতার সৌন্দর্যকে কোন পাথরের মূর্তির সাথে তুলনা করা হয় তাহলেই বা কেমন শোনায়!

গাধা বলছেন, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার সময় মেয়েদের কান দেখা হয় কিন্তু যেসব আওয়াজ কর্ণবিদীর্ণ করে তা বিচারকেরা শোনেন না। চোখ দেখেন কিন্তু চোখের লজ্জা দেখেন না। স্ফীত বক্ষ দেখেন কিন্তু হৃদয়ের লুকায়িত প্রেম-ভালোবাসা ও মায়ের মমতা দেখেন না।

এরপর গাধার সাথে পরিচয় হয় সাহিত্য, সংগীত এবং ললিতকলা একাডেমির। সেসব বিষয়েও গাধা তার ভাবনার কথা জানিয়েছেন অকপটে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যারা সহজ ভাষায় সাহিত্য লেখেন তাদের সাহিত্য একাডেমি এড়িয়ে চলছে। তারাই সাহিত্য একাডেমি চালাচ্ছেন যারা বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো কিছু লেখেননি এবং পনের বিশ বছর ধরে কোনো বই পড়েননি। তারা শুধু নিজেদের চিন্তাবিদ বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। সংগীতের বেলায়ও একই নিয়ম। তারা কোন পরিবর্তন গ্রহণ করতে নারাজ।

পাশাপাশি বিদেশি সংগীত এবং আধুনিক সংগীত শুনতেও নারাজ। লোক-সংগীত এবং ফিল্মি গান দেশের কোটি কোটি মানুষের মাঝে এবং ভারতের বাইরে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপে শনৈঃ শনৈঃ জনপ্রিয়তা অর্জন করার পরও সংগীত একাডেমি পড়ে আছে উচ্চাঙ্গ সংগীত নিয়ে। আর্টের ক্ষেত্রে অবস্থা আরও ভয়াবহ। এমনসব ছবি পুরুস্কৃত হচ্ছে যেগুলোর মাথা মুন্ডু কেউই কিছু বুঝেন না।

এই বইটা একইদিকে যেমন সুখপাঠ্য তেমনি অপরদিকে পাঠক নিজেকে বারবার প্রশ্ন করবেন নিজের জীবনযাপন প্রণালী নিয়ে। আমরা কি কালের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলবো না কি সেটা বদলানোর চেষ্টা করবো। পরিবর্তনের মধ্যে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ এগুলো নিয়ে পাঠক ভাবতে শুরু করবেন এই বইটা পড়ার শেষে। এই লেখাটা শেষ করতে চাই গাধার প্রথমবার হাতবদল হবার পরের ঘটনা দিয়ে। গাধা আগে একজন ব্যারিস্টারের যে ঘরে বই দেখেছিলেন হাত বদল হয়ে সেই ঘর যখন একজন ব্যবসায়ীর হাতে চলে যায় তখন সেটা পরিণত হয় ফলের আড়তে।

বইয়ের ভাষায়, শেক্সপিয়রের সেটের জায়গায় ভর্তি হলো তরমুজ আর দিওয়ানে গালিব-এর স্থলে জড় করা হল মালিহাবাদের আমি। যেখানে আফলাতুন সেখানে আলু বোখারা, যেখানে সক্রেটিস সেখানে সীতাফল, যেখানে জোকা সেখানে জ্যাম, যেখানে শেলী সেখানে শরীফা, কীট্স-এর স্থলে কাকড়ি। কৃষণ চন্দরের জায়গায় কলা আর ল, আহমেদ-এর স্থলে লেবু’

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]