প্রশ্ন করবেন নাকি চুপ থাকবেন

ধরুন, একজন মনোকষ্টে জর্জরিত ব্যক্তিকে আপনি প্রশ্ন করেন, তুমি কেন এত হতাশ? এই দুনিয়া কত সুন্দর, কত কিছু আছে! এ নিয়ে কেউ বসে থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি, প্রশ্নটা ওই ব্যক্তির কাছে অনেকটা অ্যাজমা রোগীকে, আপনার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কেন? দুনিয়াভরা কত অক্সিজেন, খোলা বাতাসে গিয়ে দাঁড়ালেই তো হয়! ঠিক এমনটাই হয়ে যাবে।
জ্বি, আপনার কাছে যেটা সমস্যা না সেটাই অন্যের কাছে গুরুতর সমস্যা হতেই পারে কারণ প্রতিটা মানুষের চিন্তাভাবনা, মন, মর্জি, বিচক্ষণতা আলাদা। শুধু শুধু না বুঝে প্রশ্ন করে অন্যকে বিব্রত বা বিরক্ত করবেন না।
শিষ্ঠাচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় দৈনন্দিন জীবনে। পড়াশোনা কিন্তু কমবেশি সবাই করেছি, কিন্তু ভদ্র, গ্রহণযোগ্য ব্যবহার খুব কম মানুষই জানেন এবং তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বহন করতে পারেন।
কারোর সমস্যা বুঝতে না পারলে চুপ থাকুন। অযথা প্রশ্ন করা থেকে দূরে থাকুন, আর প্রশ্ন করার পর যদি অন্যপাশ থেকে উত্তর না আসে তাহলে আরও চুপ থাকুন, এরপরেও না বুঝে একটার পর একটা প্রশ্ন করতে থাকবেন না। দুনিয়ায় সবাই সবকিছু বোঝার জন্য আসেনি, সবাই সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয় না। আপনি ফুটবল বুঝলে ফুটবল নিয়েই থাকুন, অর্থনীতি বুঝলে তা নিয়েই থাকুন, সাজগোজ বুঝলে সাজতে থাকুন, দুই চাকা বুঝলে বাইসাইকেল চালান। কেউ গোলাকার বললেই সেটা ফুটবল নাও হতে পারে, চাকাও গোলাকার।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমরা অনেকেই আসলে জানি না ভদ্র, সর্বজনীন গৃহীত ব্যবহার কাকে বলে! অনেকেই জানেন না কাকে কোন প্রশ্নটা করা উচিত আর কোনটা না, বা কাকে প্রশ্ন করা যাবে, কাকে যাবে না বা প্রশ্নের কোন পর্যায়ে থামতে হবে। কিছু একটা শুনেই পুরো অবস্থা না বুঝেই কাউকে প্রশ্ন করা একেবারেই অনুচিত।
অনেকেই আবার কলার উচু করে বলবে, হেহ আমি এমনই, কে কি ভাবলো তাতে আমার কিছু আসে যায় না। জ্বি, আপনার কিছু না আসলেও আপনি যে একটা ‘পনির’ সেটা যারা বোঝার তারা ঠিকি বুঝে যায়।
তবে কোনো ব্যক্তি যদি আপনাকে তার ব্যক্তিগত বা মানসিক সমস্যা নিজে থেকে বলে, তাহলে আপনি তাকে আপনার বুদ্ধিমত্তা অনুযায়ী মতামত জানাতেই পারেন, সেখানে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কাউকে, কী হয়েছে? মন খারাপ নাকি? আমাকে বলো শুনি কী কারণ? না বললে বুঝবো কীভাবে? ইত্যাদি বলে নিজেকে অন্যের চোখে ‘বিরক্তিকর’ বানানোর প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকুন। মন খারাপ থাকলে এমনিতেই কারোর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না কারো, এরপর কেউ যদি একটার পর একটা প্রশ্ন করতেই থাকে, তখন মন খারাপের সঙ্গে আরও দ্বিগুণ কষ্ট বিরক্তিসহ যোগ হয়।
একটা উদাহরণ দেই, ধরুন আপনার মা খুব অসুস্থ, হাসপাতালে... আপনার মন অবশ্যই খারাপ, কোনো বন্ধু তা শুনেছে কোনোভাবে, এরপর শুরু হলো কী হয়েছে? কোন হাসপাতালে? এখন কেমন আছে? ডাক্তার কি বলছে? তাকে কেন আগে জানাননি? তার পরিচিত চিকিৎসক ছিল, কথা হয়েছে কিনা মা এর সাথে, কি কথা হয়েছে? চিনতে পারে? তাহলে তো ভালোই আছে, এখন বয়স হইছে অসুখ বিসুখ হবেই, চিন্তার কিছু নাই। কি খাচ্ছেন এখন? কে রান্না করে দিচ্ছে? কিনে? কোনো আত্মীয় নাই? তুমি কিছু খেয়েছো? কাজে গিয়েছো নাকি ছুটি নিয়েছো?
ভাইরে ভাই, ছেড়ে দেন না, উঁনাকে কাইন্দা বাঁচতে দেন।
কতগুলো প্রশ্নের উত্তর দেবে? আপনি তো জীবনে একজন বন্ধু না, আরও অনেকেই আছেন। এ রকম একটা নাজুক পরিস্থিতিতে এসব প্রশ্নের কোনো কিছুই ওই ব্যক্তির মা কে নিয়ে তার মন খারাপ একটুও কমাবে না, উল্টো আপনার প্রতি বিরক্তি বাড়াবে।
আপনি ওই ব্যক্তির কাছে নির্ভরযোগ্য মানুষ হলে উনি নিজে থেকেই যা বলার বলবে, আপনার প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করবে না, নয়তো কিছুই বলবে না। যদি কিছু না বলে তো আপনিও চুপ থাকুন।
তবে পেশাগত দায়িত্বে যারা থাকেন তাদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা, যেমন চিকিৎসক, উকিল, পুলিশ, গোয়েন্দা বাহিনী, কেস অফিসার, মনোচিকিৎসক ও শিক্ষকরা অবশ্যই প্রশ্ন করবেন, এটাই তাদের কাজ। তারা প্রশ্নের উত্তরের ভিত্তিতেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেন এবং পরিবারে মা-বাবা অবশ্যই প্রশ্ন করতে পারেন।
উপরোক্ত বর্ণিত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ যদি খোঁজ নিতে গিয়ে একটার পর একটা প্রশ্ন করে তাহলে এটা তার একধরনের মানসিক সমস্যা। কোনো মানুষের যখন নিজস্বতায় (সেলফ এস্টিম) ঘাটতি থাকে তখন সে নিজেকে নিয়ে একধরনের হীনমন্যতায় ভোগে, সারাক্ষণ তার মনে হতে থাকে তার চেয়ে সবাই এগিয়ে বা ভালো কিন্তু সেটা তার মন মানতে চায় না, সেই সমস্যা ওভারকাম করতে গিয়ে সমাজের কাছে দূরের সবাইকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে নিজে যে অনেক জানে, বোঝে এমন পান্ডিত্ব জাহির করার এবং পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে জানেই না যে অপরপক্ষের পরিস্থিতি আসলে কোন পর্যায়ে, কিন্তু না বুঝে প্রশ্ন করতেই থাকে এবং দু’একটা উত্তর শুনেই দুম করে মতামতও দিয়ে বসে।
ওই সেই প্রথম লাইনের মতো, দুনিয়ায় কতকিছু আছে, এইটা নিয়ে তোমার মন খারাপ! বাদ দাও, চলো মাছ ধরতে যাই...!!! বুঝতেও পারে না যে এসব শুনে ওই ব্যক্তির মন আরও বেশি দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে যায় এবং প্রশ্নকারীর প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। মাথায় থাকলে ভালো যে দুনিয়ায় শুধু ফুটবল গোলাকার না, চাঁদ, তারা, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রও গোলাকার। তাই গোলাকার শুনেই আপনি যা ভেবেছেন, অন্য আরেকজন কিন্তু গোলাকার বলতে তা বোঝাননি, কি বুঝিয়েছেন সেটা তিনি ভালো জানেন তবে হাতে বানানো আটার রুটিও কিন্তু গোলাকার।
সুতরাং প্রশ্ন কম, অন্যকে প্রশ্ন যত কম করবেন ততই আপনার জন্য মঙ্গল, অন্যদের জন্যও।
এমআরএম/জেআইএম