সূর্য-দীঘল বাড়ী: বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী সৃষ্টি

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ১১:৩৬ এএম, ০২ ডিসেম্বর ২০২৩

আবু ইসহাক তার একমাত্র গোয়েন্দাকাহিনী ‘জাল’ এর ভূমিকায় লিখেছেন- ‘আমার প্রথম উপন্যাস সূর্য-দীঘল বাড়ী লেখা শেষ হয় ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে। তারপর চার-চারটে বছর প্রকাশকের সন্ধানে কলকাতা ও ঢাকায় ঘোরাঘুরি করেও বইটির প্রকাশক পাইনি। হতাশ হয়ে ভাবলাম, ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখলে হয়তো প্রকাশক পাওয়া যাবে।’

১৯৫৪ সালে তিনি জাল উপন্যাসটি লেখা শেষ করেন। এমন সময় হঠাৎ ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ উপন্যাসের প্রকাশক পাওয়া যায়। ১৯৫৫ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে উপন্যাসটি সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এখানে উল্লেখ্য মাত্র একুশ বছর বয়সে আবু ইসহাক এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন। এত তরুণ বয়সে জীবনের এত গভীরবোধকে ধারণ করা আমার কাছে পরম আশ্চর্যের বিষয় মনে হয়েছে। এইবার দৃষ্টি ফেরানো যাক উপন্যাসের দিকে।
‘আবার তারা গ্রামে ফিরে আসে। পেছনে রেখে আসে স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, মা-বাপ, ভাই-বোন। ভাতের লড়াইয়ে তারা হেরে গেলো।’

বিজ্ঞাপন

উপন্যাসের শুরুর দুটো লাইন পড়লেই লেখকের অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। মাত্র দুটো লাইনেই যেন মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় সংকটের এবং একইসাথে চালিকাশক্তির কথা বলে দেওয়া হয়েছে। এরপরও ক্ষুধার কথা বিভিন্নভাবে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে এই উপন্যাসে।

এক জায়গায় বলা হচ্ছে- ‘জীবন রক্ষা করাই ধর্মের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মূলমন্ত্র।...উদরের আগুন নেভাতে দোজখের আগুনে ঝাঁপ দিতেও তার ভয় নেই।...ক্ষুধার অন্ন যার নেই, তার আবার কিসের পর্দা, কিসের কি?’ অন্য এক জায়গায় বলা হচ্ছে- ‘না খাইয়া জানেরে কষ্ট দিলে খোদা ব্যাজার অয়। মরলে পরে খোদা জিগাইব, তোর আত-পাও দিছিলাম কিয়ের লেইগ্যা? আত দিছিলাম খাটবার লেইগ্যা, পাও দিছিলাম বিদ্যাশে গিয়া ট্যাকা রুজি করনের লেইগ্যা।’ এটাকে উপলক্ষ করে লেখক একটা গ্রাম্যগীতের কয়েকটা লাইনও তুলে দিয়েছেন:

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

‘আত আছিল, পাও আছিল,
আছিল গায়ের জোর,
আবাগী মরলো ওরে
বন্দ কইর্যা দোর।’

আবার উপন্যাসের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাংলাদেশের সমাজে প্রকটভাবে শ্রেণী বৈষম্য বিদ্যমান। লেখকের ভাষায় - 'অনেক আশা, অনেক ভরসা নিয়ে গ্রাম ছেড়ে তারা শহরের বুকে পা বাড়িয়েছিল। সেখানে মজুতদারের গুদামে চালের প্রাচুর্য, হোটেলে খাবারের সমারোহ দেখে দেখে তাদের জিভ শুকিয়ে যায়। ভিরমি খেয়ে গড়াগড়ি যায় নর্দমায়। এক মুঠো ভাতের জন্যে বড়লোকের বন্ধ দরজার ওপর মাথা ঠুকে ঠুকে পড়ে নেতিয়ে। রাস্তার কুকুরের সাথে খাবার কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়।

‘দৌলতদারের দৌলতখানার জাঁকজমক, সৌখিন পথচারীর পোশাকের চমক ও তার চলার ঠমক দেখতে দেখতে কেউ চোখ বোঝে। ঐশ্বর্যারোহীর গাড়ির চাকায় নিপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারায় কেউ বা।’ এইসব নিম্ন শ্রেণির মানুষ তবুও অহর্নিশ সংগ্রাম করে টিকে থাকার- ‘যারা ফিরে আসে তারা বুকভরা আশা নিয়ে আসে বাঁচবার। অতীতের কান্না চেপে, চোখের জল মুছে তারা আসে, কিন্তু মানুষের চেহারা নিয়ে নয়। তাদের শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে। পেট গিয়ে মিশেছে পিঠের সাথে। ধনুকের মত বাঁকা দেহ-শুষ্ক ও বিবর্ণ। তবুও তারা ভাঙা মেরুদণ্ড দিয়ে সমাজ ও সভ্যতার মেরুদণ্ড সোজা করে ধরবার চেষ্টা করে। ধুকধুকে প্রাণ নিয়ে দেশের মাটিতে প্রাণ সঞ্চার করে, শূন্য উদরে কাজ করে সকলের উদরের অন্য যোগায়। পঞ্চাশের মন্বন্তরে হুঁচোট-খাওয়া দেশ আবার টলতে টলতে দাঁড়ায় লাঠি ভর দিয়ে।’

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এইবার পরিচিত হওয়া যাক বইয়ের প্রধান চরিত্র এবং তাদের সামাজিক অবস্থানের সাথে। লেখকের ভাষায়- ‘দুটি ছেলে-মেয়ের হাত ধরে জয়গুনও গ্রামে ফিরে আসে। বাইরের ছন্নছাড়া জীবন এতদিন অসহ্য ঠেকেছে তার কাছে। কতদিন সে নিজের গ্রামে ফিরে আসার তাগিদ অনুভব করেছে, স্বপ্ন দেখেছে। ছায়া-সুনিবিড় একখানি বাড়ী ও একটি খড়োঘর তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে কতদিন! কিন্তু বৃথায় ডেকেছে। তার সে বাড়ি, সে ঘর আর তার নয় এখন। দুর্ভিক্ষের মহাগ্রাসে কোথায় গেলো বাড়ি আর কোথায় গেলো ঘর।’

‘বেচে নি:শেষ করে দিলো উদরের জ্বালা মেটাতে। জয়গুন গ্রামে আসে একটি মাত্র আশা নিয়ে। ছাড়া ভিটে আছে একটা। সে তার আট আনা অংশের মালিক। বাকি আট আনার অংশীদার তার নাবালেগ ভাই-পো শফী। শফীকে নিয়ে শফীর মা-ও আসে। তাদেরও মাথা গুঁজবার ঠাঁই নেই। শেষে স্থির হয়-এই ছাড়া ভিটেটার ঝোপ-জঙ্গল সাফ করে দু-ভিটেতে দু’খানা ঘর তুলে আবার তারা সংসার পাতবে।’ এর থেকে বোঝা যায় এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্ররা আমাদের সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা যাদের প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয় নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।

এইবার পরিচিত হওয়া যাক গরিবের হাতের পাঁচ সেই ভিটেটুকুর সাথে। এই ভিটেটা ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’। কেন এমন অদ্ভুত নামকরণ? সেটারও বিস্তারিত বিবরণ আছে এই বইতে। লেখকের ভাষায়- ‘পূর্ব ও পশ্চিম সূর্যের উদয়াস্তের দিক। পূর্ব পশ্চিম প্রসারী বাড়ির নাম তাই সূর্য-দীঘল বাড়ী। সূর্য-দীঘল বাড়ী গ্রামে ক্বচিৎ দু’একটা দেখা যায়। কিন্তু তাতে কেউ বসবাস করে না। কারণ, গাঁয়ের লোকের বিশ্বাস সূর্য-দীঘল বাড়ীতে মানুষ টিকতে পারে না। যে বাস করে তার বংশ ধ্বংস হয়। বংশে বাতি দেওয়ার লোক থাকে না। গ্রামের সমস্ত বাড়ীই উত্তর-দক্ষিণ প্রসারী।’

এরপর লেখক বাড়িটার বিস্তারিত বর্ণনাও দিয়েছেন- ‘বাড়িটার বড় আকর্ষণ একটা তালগাছ। এত উঁচু তালগাছ এ গাঁয়ের লোক আর কোথাও দেখেনি। কত শিশুর পরিচয় হলো তালগাছটির সঙ্গে। তারা বুড়ো হলো, জীবন লীলা সাঙ্গ করলো। তাদের কত উত্তরপুরুষও গেল পার হয়ে। কিন্তু তালগাছটি তেমনি দাঁড়িয়ে আছে প্রহরীর মতো। কালের সাক্ষী হয়ে ঝড়-ঝাপটা উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাথা উঁচু করে। তালগাছটি এ-এলাকার গর্বের বস্তু।’

বিজ্ঞাপন

এই উপন্যাসের দুটো দিক আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করেছে। প্রথমটা হলো এর ভাষারীতি এবং শব্দসম্ভার। ভাষারীতি কথ্য এবং এতে আঞ্চলিকতার টান আছে। ফলে দ্রুতই এর কথোপকথনগুলো মস্তিষ্কে জায়গা করে নেয়। একেবারে গ্রামীণ সহজ সরল ভাষায় এটার ঘটনাক্রম বর্ণনা করা হয়েছে।

আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি এই একই উপন্যাস যদি সাধু ভাষায় লেখা হতো তাহলে সেটা পাঠকের বোধগম্য হতে অনেক সময় লাগতো এবং পাঠক ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলতেন। এখানে কয়েকটা বাক্য তুলে দিচ্ছি। ‘বিছমিল্লা বুইল্যা মোখে দে। দেখবি এই দুগগায়ই প্যাট ভইরা যাইবো।’ ‘দুফরে যাবি জুমার ঘরে। আণ্ডা চাইড্যা দিয়া আ’বি।’ ‘হলুদ রঙের বাচ্চা দুটো কেমন সুন্দর হাঁটে আর চিঁপ-চিঁপ করে।’ ‘তোর মামু একটা ইলশা মাছ আনছিল দুই পয়সা দিয়া কিন্যা।’ ‘কচি ঘাড়টার ওপরেই জুলুমটা হয় বেশি।’

এই বইয়ে গ্রামীণ এমনসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যেগুলো শহুরে এবং ভদ্রলোকেদের কাছে অচল। এমনকি সময়ের স্রোতে অনেক শব্দ গ্রাম থেকেও হারিয়ে গেছে। যেমন- পিঁড়ে, আখা, বেবাক, পাতিহিয়াল, গন্ধভাদাল, অগ্রাণ, নওশা, হিড়িক, আবাগী ইত্যাদি।

আর দ্বিতীয়টা হলো, এই উপন্যাসে অনেক গ্রামীণ প্রবাদ, শ্লোক, ধাঁধা, পুঁথি এবং লোকসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের এক অন্যন্য উপাদান হতে পারতো এগুলো। কিন্তু বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের ঠুনকো অহংবোধের জন্য এগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়। এখানে বেশকিছু উদাহরণ তুলে দিচ্ছি।

‘পৌষের হিমে ভীম দমন,
মাঘের শীতে বাঘের মরণ।’

বিজ্ঞাপন

‘পুত্র সে হাতের লাঠি বংশের চেরাগ।
কন্যা সে মাথার বোঝা কুলে দেয় দাগ।।’

‘মাছ করে ঝক ঝক ছোট্ট এক ঝিলে
একটা মাছে টিপ দিলে বেবাকগুলা মিলে।’

‘বড়শী পুড়ি, বড়শী পুড়ি,
ট্যারা পড়শীর মোখ পুড়ি,
মাছ ধরমু দুই কুড়ি।।
লোয়ার বড়শী সূতার ডোর
পুঁডি পাবদা, শিং মাগুর।।
বড়শী আমার প্যাদা
ধইর্যা আনব ভ্যাদা-
ভ্যাদা মাছে ক্যাদা খায়,
পুঁডি মাছে পান চাবায়।’

বিজ্ঞাপন

এছাড়াও আছে গ্রামীণ লোকবিশ্বাস। যেমন ঈদের চাঁদের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে শফীর মা বলে দেয় কি ঘটনা ঘটতে পারে আসছে সময়ে। যেমন- ‘দক্ষিণ মুহী কাইত অইয়া ওঠলে আকাল অইবই। উত্তর মুহী কাইত অইয়া ওঠলে মড়ক লাগে, কলেরা-বসন্ত অয়, মানুষ মইর্যা সাফ অইয়া যায়।’

আমি এই আলোচনায় অত্যন্ত সচেতনভাবে এই বইয়ের কাহিনিটা বলা থেকে বিরত থেকেছি কারণ এই কাহিনি হাজার বছর ধরে চলা আবহমান গ্রাম বাংলার গল্প। দেশের মানচিত্র বদলায়, পতাকা বদলায়, শাসক বদলায় কিন্তু গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষের ভাগ্য বদলায় না। তাদের দারিদ্র্যকে পুঁজি করে ধনী মানুষদের আঙুল ফুলে রাতারাতি কলাগাছ হয়ে যায় কিন্তু তাদের পেট গিয়ে ঠেকে পিঠের সাথে।

লেখকের অন্যন্য বর্ণনায় কাহিনি এগিয়ে চলে নদীর গতিপথের মতো। বাঁক বদল করে কিন্তু থেমে থাকে না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এই বই বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী অমর সৃষ্টি। যতদিন বাংলাদেশ টিকে থাকবে, বাংলা ভাষা টিকে থাকবে ততদিন মানুষকে এই বইটি সূর্য-দীঘল বাড়ীর উঁচু তালগাছের মতো নীরব সাক্ষী হয়ে থাকবে এই বই। আমরা ভবিষ্যতের দিকে যতই এগিয়ে যাবো ততই এই বই সেই তালগাছের মতো আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকবে।

বিজ্ঞাপন

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com