ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস

স্বাপ্নিক এক জীবন দর্শনের গল্প

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০৮:৩৫ এএম, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩

‘ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস’ শাহাদুজ্জামানের গল্পগ্রন্থ ‘পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ’র শেষ গল্প। এই বইয়ের অন্যান্য গল্পগুলোর তুলনায় এই গল্পটি বেশ বড়। পুরো বইয়ের এক তৃতীয়াংশ জায়গা নিয়ে নিয়েছে গল্পটি। এই গল্প পড়ে যে কারো মনে হবে লেখক চাইলেই এই গল্পটাকে উপন্যাসে রূপ দিতে পারতেন। অবশ্য পরবর্তীতে এই গল্পটির ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন লেখক একটি চিত্রনাট্য লেখেন।

চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগটি সফল না হলেও চিত্রনাট্যটি আলাদা বই আকারে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে সুবচন নাট্যগোষ্ঠী ‘ষড়ভুজ’ নামে একটি মঞ্চনাটক প্রযোজনা করে। উপন্যাসে রূপ না দিলেও এই গল্প পড়ে পাঠক চমৎকৃত হন। ভাবতে বসেন নিজের জীবন নিয়ে। ঠিক যেমনটিভাবে এই গল্পের কথক যুবক চিকিৎসক।

ইব্রাহিম বক্সের আশ্চর্যরকম জীবনযাপন যেমন যুবক চিকিৎসককে আগ্রহী করে তোলে তার সম্মন্ধে জানার জন্য। আমরাও তেমনি পাঠ করতে করতে ঔৎসুক্য বোধ করি। ইব্রাহিম বক্সের জীবন আমাদের চেনাজানা জীবনের বাইরে নিয়ে এসে দাঁড় করায়। আমাদের মনে প্রশ্ন তৈরি করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনপ্রণালী নিয়ে।

গল্প থেকে টুকরো টুকরোভাবে ইব্রাহিম বক্সের যে পরিচয় পাওয়া তা আর দশটা গ্রামীণ মানুষের জীবনের থেকে পুরোপুরি আলাদা। সে-ই একমাত্র ছেলে যে গ্রাম থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেছিল। পড়াশোনার নেশা আছে তার। পড়াশোনার জন্য থানা লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পর্যন্ত নিয়ে আসে। নানা বিচিত্র খেয়ালের মানুষ সে। একবার খেয়াল চাপলো ক্যামেরায় ছবি তোলা, ওয়াশ করা শিখবে।

থানা শহরে গিয়ে এক স্টুডিওতে সেসব শিখেছিল কিন্তু পয়সার অভাবে সেটা আর বেশিদিন টেকেনি। অনেক ভালো খেলাধুলা করতো। ছোটবেলায় নিজের তৈরি একটা ফাঁদে গোটা কয় বাঘডাস ধরে গ্রামের সবার নজর কেড়েছিল। একবার গ্রামে ভারত থেকে খুব বড় একটা সার্কাস দল আসলে সে চলে যায় তাদের সাথে। এর বহুদিন পর সে আবার গ্রামে ফিরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। গ্রামের লোকের ভাষায়, চাইলে সে অনেক কিছু করতে পারতো।

অন্যদিকে যুবক চিকিৎসক শহরের মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ডাক্তার। গ্রামের মানুষের ভাষায় ‘ডাকতর’। গ্রামের যে পরিবেশে সে এসে পড়েছে সেই পরিবেশ মানুষের সাথে তার খুব একটা পরিচয় নেই। তার দাদাবাড়ি, নানাবাড়ি এমনকি নিজের বাড়িও গ্রামে নয়। গ্রামের মানুষ বলতে ড্রইংরুমে বেমানান দু-একজন আত্মীয়কে দেখেছেন শুধুমাত্র। আর ট্রেনের জানালা থেকে দেখেছেন চৌকো গ্রাম। যুবক চিকিৎসক প্রায়ই বুঝে উঠতে পারে না গ্রামের দরিদ্র, বিনম্র মানুষের রোগটা আসলে কি।

সে জানে না বিলের পানির মধ্যে থাকে মাওছা দেও। সে জানে না ঠাকুরের বিল পাহারা দেয় একজন ঠাকুর তাই গরুর মাংস খেয়ে ঠাকুরের বিল পাড়ি দিতে হয় না। যুবক চিকিৎসক ইব্রাহিম বক্সের পাশাপাশি আরও অনেকের কথায় বলেছেন। তাদের মধ্যে আছে ডিস্পেন্সারির ফার্মাসিস্ট আব্দুল মান্নান, বকরি বুড়ি, নিঃসম্বল জলিল মিয়া, মসজিদের মওলানা আনার আলী মুন্সি, ইয়াকুব মেম্বর ছাড়াও আছে গ্রামের নাম না জানা আরো অনেক মানুষ এবং শিশু। বকরি বুড়ির এহেন নামকরণের ইতিহাসও যুবক চিকিৎসক আমাদের জানায়।

তার একটি পোষা ছাগল ছিল। হঠাৎ একদিন তার ‘পেট কামড়ি’ রোগ হয়ে সেটা মারা যায়। তখন যদি ছাগলটির গুহ্যদ্বারে ইঁদুরের গর্তের মাটি ঢুকিয়ে দেওয়া যেত তা হলে সেটা ভালো হয়ে যেত। এরপর বকরি বুড়ি সেই মৃত ছাগলের চামড়া ছাড়িয়ে রেখে দিয়েছে স্মৃতি হিসাবে। ছাগলের স্মৃতি মনে হলেই সেটাতে সে হাত বোলায়। তার কাছে কোন শোকই দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় না। তার আরেকি শখ হলো কথায় কথায় শ্লোক বলা। তার একটি শ্লোক নিচে তুলে দেয়া হলো-

‘আঙ্খির মধ্যে পঙ্খির বাসা
দুব্বা জালাইল শালে
দোপায়া নিপায়া নিল ডালে
বলো ডাকতর বিবরণ
ইন্দুরে বিড়াল মারে কী কারণ।’

জলিল মিয়া একজন গরিব কৃষক। একদিন যুবক চিকিৎসক তার বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে জলিল মিয়া একটু বসে যেতে বলেন। এটা গ্রাম বাংলার খুবই চিরায়ত দৃশ্য। তার বাড়িতে ঢুকে ধাতস্ত হতে যুবকের একটু সময় লাগে। বাইরের উজ্জ্বল এল থেকে জলিল মিয়ার বেড়ার ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ তাকে অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। পাশের বাড়ি থেকে চেয়ার আনার জন্য হৈ চৈ পড়ে যায়।

অবশ্য যুবক চিকিৎসক চৌকির ওপরেই বসে পড়ে। সেই চৌকির ওপর একটি কাঁথা বিছানো, দুটো মলিন বালিশ। শিয়রে বেড়া কেটে বানানো একটি জানালা। সেটি দিয়ে একখণ্ড রোদ এসে পড়েছে বালিশের ওপর। একপাশে বাঁশের মাচার একটি ঝাঁকায় খড়ের ওপর বসে ডিমে তা দিচ্ছে একাগ্র একটি মুরগি। মাচার নিচে একটি ছাগল বসে জাবর কাটছে। বেড়ার গায়ে শিকায় ঝোলানো নানা আকারের ওষুধের বোতল ঘরের সৌন্দর্যবর্ধন করছে। এভাবেই গ্রামীণ গরিব মানুষদের ঘরের একটা নিখুঁত ছবি এঁকেছেন লেখক।

ইয়াকুব মেম্বার একজন মাঝবয়সী মানুষ। তার সাথে যুবক চিকিৎসকের দেখা হয় থানা সদরে। এরপর দুজন প্রায় মাইল পাঁচেক পথ একসঙ্গে হেঁটে আসেন। এতটা পথ হাঁটার ব্যাপারে যুবক চিকিৎসক সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সের একজন মানুষের প্রস্তাবে আর না করতে পারেননি। ইয়াকুব মেম্বার দেশ ও দশের খবর রাখনে।

তার ভাষায়- মিলিটারি দেশ শাসন করলে দেশের কোন ভবিষ্যৎ নেই। তার একটি চপলা কন্যা আছে। যে অসুখ সেরে যাওয়ার অছিলায় যুবক চিকিৎসকের জন্য গরমকালের ঝালপিঠা করে আনে। পিঠে দিতে এসে বিস্তর কথা বলে মেয়েটি। ঢাকায় সে কবার গেছে, কোনো নায়িকা তার প্রিয় ইত্যাদি আলাপ করে সে। কথাবার্তায় গ্রাম্য আড়ষ্টতা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা। সে যুবক চিকিৎসককে তাদের বাড়িতে টেলিভিশন দেখার আমন্ত্রণ জানায়।

বকরি বুড়ির ভাষায়- ‘মেম্বরের মেয়ে কইলাম সুবিধার না।’ ফার্মাসিস্ট আব্দুল মান্নান মর্জিমতো ডিসপেন্সারিতে আসে। পল্লী ডাক্তার হিসাবে তার পসার বেশ ভালো। থানা প্রশাসনকে ধরপাকড় করে নতুন ডিসপেন্সারির ফার্মাসিস্টের চাকরিটা সে নিয়েছে। অধিকাংশ সময় গ্রামে সাইকেল চালিয়ে রোগী খুঁজে বেড়ায়। রোগী দেখে ওষুধ দেয় সে। সেই ওষুধগুলোর মধ্যে কিছু আবার ডিসপেন্সারি থেকে ফাঁকফোকরে সরিয়ে নেওয়া।

সে যুবক চিকিৎসককে এক ধরনের প্রশ্রয় মেশানো সম্মান দেখিয়ে চলে। তাকে সে বদলি হতে পরামর্শ দেয়। গ্রামের মানুষেরা কতটা নির্বোধ নানা দৃষ্টান্ত দিয়ে সেটি বোঝানোর চেষ্টা করে সে। যদিও গ্রামের মানুষের সারল্য নিয়ে হাসাহাসি করা যুবক চিকিৎসক বিশেষ পছন্দ করে না। সে ডিসপেন্সারিতে অধিকাংশ সময় কাটায় নামাজ পড়ে। নিজেকে কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য এটা তার একধরণের অজুহাত।

মওলানা আনার আলী মুন্সি ধর্মপ্রাণ মানুষ। সে যখন গ্রামের মহিলাদের কাছ থেকে জানতে পারে তার স্ত্রী জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য তার জরায়ুতে ‘কপারটি’ পরা অবস্থায় মারা গেছে তখন সে তাকে কবর দিতে নিষেধ করে দেয়। তার ভাষায় এই আংটি বের না করা পর্যন্ত তাকে কবরে নামানো যাবে না। এরপর ডাকপড়ে যুবক চিকিৎসকের। কিন্তু যুবক চিকিৎসক নিজে ছেলে হয়ে এই কাজটি করা থেকে বিরত থাকে।

তার মনেহয় তার চেয়ে বরং মওলানাকে এই পদ্ধতি উদ্ভাবনের ইতিহাসটা বলা যেতে পারে। আরব বেদুঈনরা লম্বা কাফেলায় যাওয়ার আগে সব মাদি উটের জরায়ুর ভেতরে একটা করে পাথর ঢুকিয়ে রাখত যাতে করে উটগুলো গর্ভবতী হয়ে না পড়ে। মওলানার স্ত্রীকে কাঁঠাল গাছের নিচে শুইয়ে রাখা হয়। দুপুরের রোদের ভেতর যখন ধুলো উড়ছে চারদিকে তখন লেখকের মনে হয় এ যেন লু হাওয়া আর কাঁঠালতলায় ঘুমিয়ে আছে ক্লান্ত একটি উট।

আবার ফিরে আসা যাক ইব্রাহিম বক্সের কাছে। গ্রামের একজন মানুষের কাছ থেকে আমরা ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে শুরু করে বর্তমান বিশ্বের প্রায় সব খবরই পাই। এমনকি এমন অনেক বিষয়ে তিনি আলোকপাত করেন যেগুলো খুব সাধারণ কোন তথ্য নয়। সে বাড়িতে মৌচাক বানিয়ে মধু উৎপাদন করে। যদিও তার আসল উদ্দেশ্য মধু থেকে ঔষুধ তৈরি করা।

তার ভাষায়- ‘আয়ুর্বেদের প্রায় সব ওষুধেই অনুপাত হিসেবে মধু খাওয়ার কথা বলা আছে। প্রাচীন সব চিকিৎসক মধু দিয়ে চিকিৎসা করতেন, ইবনে সিনা, গ্যালেনের সব প্রেক্রিপশনে মধু থাকত।’ এছাড়াও মৌমাছি নিয়ে অনেক নতুন তথ্য পাই আমরা। মৌচাকে অন্যান্য মৌমাছিদের সাথে থাকে একদল পুরুষ মৌমাছি যাদের কাজ হলো রানীকে গর্ভবর্তী করা। কিন্তু মাত্র একটা পুরুষ মৌমাছি সেই সুযোগ পায় বাকিরা বিরহে আত্মহত্যা করে।’

‘এছাড়াও মৌচাকে রানী মৌমাছি সকল প্রকার শক্তির উৎস হিসাবে কাজ করে। বৈজ্ঞানিকরা এখনও তার স্পষ্ট পরিচয় জানেনা। তারা নাম দিয়েছে 'কুইন্স সাবস্ট্যান্স।’

ইব্রাহিম বক্সের আসল আগ্রহ প্রকৃতিতে এবং প্রকৃতির নানা রহস্যে। তারমতে পশুপাখিরা অনেক কিছুই টের পে। ইঁদুর জানতে পারে কখন ভূমিকম্প হবে। পিঁপড়া বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা টের পায় অনেক আগে এবং তাদের ডিম, খাবার সব সরিয়ে রাখে নিরাপদ জায়গায়। ব্যাঙ আগে থেকেই টের পায় মাছ কখন ডিম পাড়বে আর সময় বুঝে সেসব মাছের আশপাশে ঘুরে বেড়ায়। সাইবেরিয়ার হাঁস হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসে এদেশে।

প্রজাপতি পাকা পেঁপের রস খেতে চায় বলেই সেই পেঁপের উপর বসে পাখির দৃষ্টি আকর্ষণ করে কারণ পেঁপের ত্বক ভেদ করা রস খাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। পাখি ঠোকর দিয়ে সেটা খাবার পর সেখানে বসে সে রস আস্বাদন করে। সে আরো জানায়, প্রতিবন্ধীরা খুব সৎ আর নিষ্ঠাবান হয়, আর ওদের থাকে অন্যের জন্য নিখাদ ভালোবাসা। তার ভাষায়, গ্রামের মানুষের সবকিছু নিয়ে একটা নিজস্ব বুঝব্যবস্থা আছে, তাদের চিন্তার একটা গণ্ডি আছে। তার মতে, শহরে থাকে শিক্ষিত, ক্ষমতাবান মানুষেরা। তারা চোরকেও ক্ষমা করে, কিন্তু নতুন কথা নিয়ে হাজির হলে তাকে ক্ষমা করে না।

ইব্রাহিম বক্সের আফসোস, মানুষ প্রকৃতি থেকে বড় বেশি দূরে সরে যাচ্ছে। এটা খুবই ভুল হচ্ছে। তার মতে, মানুষের রোগ যতই জটিল হোক সেটাকে ভালো করতে হবে শরীরের নিজের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে যেটাকে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় ইমিউনিটি। সেই প্রাকৃতিক ইমিউনিটি বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিতে হবে। বাইরে থেকে বুলেটের মতো ট্যাবলেট ছুড়ে আর তীরের মতো ইনজেকশন ঢুকিয়ে কোন কাজ হবে না। তার মতে, অধিকাংশ মানুষই তো জানে না, পৃথিবীতে কি তার কাজ, একটা ফরমায়েশি জীবন কাটিয়ে দেয়। মানব জীবনের রূঢ় বাস্তবতায় যেন এটা।

চেঙ্গিস খাঁ তার রাজত্বে সার্কাস নিষিদ্ধ করেছিল কারণ সার্কাস মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে। যারা সার্কাস দেখে, তারা একজন মানুষকে চোখের সামনে একটা বিপদ অতিক্রম করতে দেখে, তাদের সাহস বেড়ে যায়। আসলেই বর্তমানের পৃথিবীতে তাবৎ উপাদান লেগে আছে আমাদের কাছ থেকে আত্মবিশ্বাসটুকু কেড়ে নেয়ার তালে। তাহলে আমাদেরকে যেভাবে খুশি সেভাবে চালানো যাবে।

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]