শহীদ জিয়া এবং ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ১২:৪৮ পিএম, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫
রহমান মৃধা

১৯৮০ সালের কোনো এক সময় বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মাগুরা জেলার বাটাজোড় গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নবগঙ্গা নদীর তীরে হেলিকপ্টারে অবতরণ করেন। তখন তিনি দেশে খাল খননের কাজ এবং গ্রাম সরকার গঠনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের খোঁজ নিতে তিনি গ্রামগঞ্জে ভ্রমণ করতেন।

এছাড়া, মাগুরা মহকুমায় বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে তৎকালীন সংস্থাপনমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার মেজর জেনারেল মজিদ-উল-হকের আমন্ত্রণে তিনি বাটাজোড়ে আসেন।

মেজর জেনারেল মজিদ-উল-হক ছিলেন মাগুরার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সক্রিয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় ছিল, এই সভার আয়োজন নহাটা বাজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে না করে বাটাজোড়ের মতো অপেক্ষাকৃত অখ্যাত স্থানে করা হয়। নহাটা ছিল রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের একটি শক্ত ঘাঁটি, যা সামরিক শাসনের সময়ও আওয়ামী লীগপন্থি সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিল।

সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এলাকাবাসীদের মধ্যেও বিভক্তি দেখা গিয়েছিল। অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বিএনপির প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের আগমন উপলক্ষে এক সপ্তাহ আগে জেনারেল মজিদ-উল-হক নহাটা বাজারে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। সেই সমাবেশে আমার চাচা, বীর প্রতীক গোলাম এয়াকুব মিয়া, নহাটার পক্ষ থেকে হোস্ট হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। আমি সেদিন সেখানেই জেনারেল হকের সঙ্গে ছিলাম এবং জানতে পারি যে জিয়াউর রহমান বাটাজোড়ে আসবেন।

সপ্তাহখানেক পর, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাটাজোড়ে এসে পৌঁছান। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক হিসেবে নয় বরং রাষ্ট্রপতিকে কাছ থেকে দেখার আগ্রহে জনসভায় যোগ দিই। সেদিনের সেই জনসভার দৃশ্য আজও আমার মনে স্পষ্ট—শৃঙ্খলাপূর্ণ সমাবেশ, জিয়াউর রহমানের দৃঢ় বক্তৃতা এবং এলাকাবাসীর নীরব প্রতিক্রিয়া সবই ছিল মনে রাখার মতো।

জনসভা শেষে হঠাৎ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সিদ্ধান্ত বদল করলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন, হেলিকপ্টারের পরিবর্তে গ্রামের রাস্তা ধরে হেঁটে মাগুরা দেখবেন এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন। পরবর্তী জনসভা হবে শত্রুজিৎপুর মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। বাটাজোড় থেকে শত্রুজিৎপুরের দূরত্ব সাত মাইল, আর সেখান থেকে মাগুরা শহরের দূরত্ব আরও সাত মাইল।

রাষ্ট্রপতির আকস্মিক এই সিদ্ধান্ত আমাকে মুগ্ধ করেছিল। স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় জেনারেল মজিদ-উল হক আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি তাদের সঙ্গে হাঁটতে চাই? সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হলাম। হাঁটার সময় আমি প্রত্যক্ষ করলাম সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা—কেউ মাটি দিয়ে হাড়ি-পাতিল বানাচ্ছেন, কেউ বাঁশ দিয়ে কুলা ও ধামা তৈরি করছেন। জিয়াউর রহমান তাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন এবং তাদের দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামের কথা জানতে চাইছিলেন। তার এই সরল ও মানবিক আচরণ আমাকে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল করে তোলে।

শত্রুজিৎপুর মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ে পৌঁছানোর পর জনসভা ও খাবারের বিশেষ আয়োজন করা হয়। তবে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সবার বিস্ময় সৃষ্ট করে বললেন, তিনি শুধু লেবুর শরবত খেতে চান। এই ঘোষণা শুনে প্রশাসন ও স্থানীয় নেতারা লেবু জোগাড় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। গ্রামের মানুষ শেষমেশ লেবু সরবরাহ করলেও এ ঘটনাটি আমার কাছে এক অনন্য অভিজ্ঞতা হয়ে রয়ে গেছে।

শত্রুজিৎপুর থেকে আমি সরাসরি বাড়ি ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ পর, জিয়াউর রহমান সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় ফিরে যান। তার সঙ্গে হাঁটার অভিজ্ঞতা আমার জীবনের এক স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।

পরে, ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জিয়াউর রহমানের আকস্মিক মৃত্যুর খবর আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। সেই মুহূর্তে স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠেছিল বাটাজোড় থেকে শত্রুজিৎপুর পর্যন্ত তার সঙ্গে হাঁটার সেই দিনটি। তার সহজ-সরল আচরণ, মানুষের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা এবং মানুষের কষ্টকে নিজের করে দেখার চেষ্টা আমার মনে চিরকালীন দাগ কেটে গিয়েছিল।

১৯৮৩-৮৪ সালে, যখন আমি ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়তাম, তখন প্রায়ই বেগম খালেদা জিয়াকে কলেজে আসতে দেখতাম। কারণ তারেক রহমানও তখন সেখানে পড়তেন, বাসা থেকে স্কুলে যাতায়াত করতেন। খালেদা জিয়া প্রায়ই কলেজের অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন এবং তাকে দেখে আমার মনে হঠাৎ করে জিয়াউর রহমানের স্মৃতি জেগে উঠত। মনে পড়ত তার সঙ্গে সেই হাঁটার সময়ের কথা—যে সময়ে তিনি সরল, সহজ, মানবিক আচরণ দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করেছিলেন। তার প্রতি সেই শ্রদ্ধা এবং ভালো লাগা তখন আরও গভীর হতো।

রাজনীতির সঙ্গে কখনো সরাসরি যুক্ত হইনি। ১৯৮৪ সালে এইচএসসি পাস করার পরই আমি প্রবাসজীবন শুরু করি। তবে ছোটবেলায় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আমার সরাসরি সম্পৃক্ততা, জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশ গঠনের স্বপ্নে অংশ নেওয়া এবং খাল খনন প্রকল্পের অভিজ্ঞতা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। পরে প্রেসিডেন্ট এরশাদের সময়ে তাকে কাছ থেকে দেখা, তার কবিতা লেখার গল্প এবং আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানের আমন্ত্রণে তার মার্কিন ভ্রমণের সময় কবিতা প্রকাশের ঘটনা আজও আমার মনে গভীরভাবে গেঁথে রয়েছে।

এখনও স্পষ্টভাবে মনে পড়ে, খাল খননের সময় জিয়াউর রহমানের সেই রেই-ব্যান সানগ্লাস পরা ছবির কথা। তার চোখে সেই রেই-ব্যান পাইলট সানগ্লাস দেখার পর থেকেই আমারও সেই ধরনের সানগ্লাস পরার শখ জন্মেছিল। পরবর্তীতে সেই শখ পূর্ণ হয়েছিল। এখনো আমি সুইডেনের গ্রীষ্মে রেই-ব্যান সানগ্লাস পরি।

বিশেষ করে, যখন আমি সুইডেনের গ্রামে শাকসবজি চাষ করি। আমি এখানে ছোট্ট একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি, যেখানে স্থানীয় সুইডিশদের সঙ্গে মিলে শাকসবজি চাষ করি। তখন আমার ছোটবেলার সেই স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে—যেমন মাহবুব আলম চাষি যখন নহাটা ইসামতি বিল ভ্রমণ করেছিলেন, আমি তার সঙ্গে ছিলাম, তার পর প্রেসিডেন্ট জিয়ার খাল খননের কাজে যুক্ত হয়েছিলাম এবং সর্বোপরি আমার বাবা যখন ছুটিতে বাড়ি আসতেন, কী চমৎকারভাবে বাড়ির চারপাশে নানা ধরনের গাছপালা রোপণ করতেন, যা আমাকে আরও অনুপ্রাণিত করেছে।

কিছুদিন আগে মরহুম জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলাম। সেই উপলক্ষে তার সরলতা, মানবিকতা এবং দুর্নীতিমুক্ত ব্যক্তিত্বের কথা আবার গভীরভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছিল। এত বছর পরেও তার কোনো কাজ বা আচরণ আমার স্মৃতিতে কলঙ্কিত হয়নি। যদিও শুনেছি, শেখ মুজিবুর রহমানকে খুন করার ষড়যন্ত্রে তারও কিছু ভূমিকা ছিল, আবার এও শুনেছি প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যার পেছনে প্রেসিডেন্ট এরশাদের হাত ছিল—তবে এর সত্যতা আজও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। একটি বিষয় পরিষ্কার করা জরুরি ছিল— কীভাবে এবং কেন জেনারেল মুঞ্জুরের মৃত্যু হলো, বিষয়টি আসলে মরীচিকার মতোই, যার সমাধান আজও অজ্ঞাত!

এখন, বহু বছর পরেও, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো আমার জীবনে এক অমূল্য অভিজ্ঞতা হয়ে রয়ে গেছে। তার মানবিকতা, সাদাসিধে জীবনযাপন এবং দেশের প্রতি অঙ্গীকার আমাকে বরাবরই অনুপ্রাণিত করেছে। তার আদর্শ, ত্যাগ এবং মানুষের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা কখনোই আমাদের স্মৃতিতে হারিয়ে যাবে না, যদিও তার রাজনৈতিক জীবন নানা বিতর্ক এবং বিভক্তির মাঝে হারিয়েছে।

শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ছিল, কারণ তিনি আমাদের স্বাধীনতার পথপ্রদর্শক। কিন্তু তার পরিবারের কিছু সদস্যের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড এবং নির্দয় কাজের কারণে, আজ তার নাম আমার হৃদয়ে কম্পিত হয়ে পড়ে। তার জন্য শ্রদ্ধা ছিল, কিন্তু তার পারিবারিক কার্যকলাপ আমাকে মর্মাহত করেছে, যা আজ তাকে হৃদয় থেকে ঝরে পড়তে বাধ্য করেছে।
ইতিহাস কখনো একপক্ষীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত নয়। এটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং জনগণের অনুভূতির ওপর নির্ভর করে। সুতরাং, সময়ের পরিক্রমায়, প্রেসিডেন্ট জিয়া তার মানবিকতার কারণে আজও আমার হৃদয়ে অমলিন স্থান করে রেখেছেন এবং তার আদর্শ আজও আমাকে পথ দেখায়।

এই লেখাটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতির অংশ। এখানে রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ জিয়াউর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট এরশাদ—তিনজনই আমার জীবনের বিভিন্ন সময়ে প্রভাব ফেলেছেন। তাদের প্রসঙ্গ আনায় কারও মতের সঙ্গে দ্বিমত হতে পারে, তবে এটি ইতিহাসের প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা।
তবে প্রেসিডেন্ট জিয়া আজও আমার কাছে একজন মহান নেতা এবং তার আদর্শ, তার ত্যাগ আমাদের সামনে এক দীপ্ত দীপের মতো জ্বলছে।

তার পরিবারের প্রতি আমার একটাই কামনা, তারা যেন শহীদ জিয়ার মহান আদর্শকে সমুন্নত রাখে এবং তার জীবনের চেতনাকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। তাহলেই, তার স্মৃতি চিরকাল বেঁচে থাকবে আমাদের হৃদয়ে, ঠিক যেমনটি তিনি আমাদের মধ্যে রেখে গেছেন—একটি আদর্শ এবং শক্তিশালী দেশ গঠনের স্বপ্ন।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন) [email protected]

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]