অভিবাসী চাপে স্পেনের বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জ

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:০৭ পিএম, ২৩ অক্টোবর ২০২৫
ছবি-এআই দিয়ে বানানো

ভূমধ্যসাগরীয় অভিবাসন রুটগুলোর মধ্যে প্রধান রুট হয়ে দাঁড়িয়েছে আলজেরিয়া থেকে স্পেনের বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জের রুটটি। বিশেষ করে তিউনিশিয়া, মরক্কো ও মৌরিতানিয়া হয়ে ইউরোপমুখী পথগুলোতে নজরদারি জোরদার হওয়ায় এখন তুলনামূলক কম পর্যবেক্ষণাধীন বালিয়ারিক রুটে বেড়েছে অভিবাসীদের অনিরাপদ যাত্রা।

চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ছয় হাজারেরও বেশি অনিয়মিত অভিবাসী নৌকায় করে এই দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেছেন। যা আগের সব বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে এবং দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসনিক ও মানবিক সক্ষমতাকে চরম পরীক্ষার মুখে ফেলেছে।

মায়োরকা দ্বীপের রাজধানী পালমা উপকূলের পাশে সারি সারি ছোট নীল রঙের ফাইবারের নৌকা পড়ে আছে৷ নৌকাগুলো উদ্ধারের পর ফেলে রাখা হয়েছে সামরিক বাহিনীর পুরনো সন তুস ঘাঁটিতে। সেখানেই এখন সংরক্ষিত হয় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া এসব নৌকা। যেগুলো উদ্ধার করে আনে স্পেনের সমুদ্র উদ্ধার সংস্থা ‘সালভামেন্তো মারিতিমো’ এবং সিভিল গার্ড।

প্রতিটি নৌকার গায়ে লেখা থাকে উদ্ধারের তারিখ যেমন: ‘এসএম ১০/২০২৫’ অথবা ‘জিসি ২০/৬/২০২৫’৷ যার অর্থ ওইদিন উদ্ধার অভিযান পরিচালিত হয়েছিল।

রেকর্ড অভিবাসী আগমন

স্পেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেছেন ছয় হাজার ১০৪ জন অনিয়মিত অভিবাসী। যা গত বছরের তুলনায় ৭৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের শুরু পর্যন্ত ৩৩০টিরও বেশি নৌকা পৌঁছেছে। পুরো ২০২৪ সালের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে এই পরিসংখ্যান।

বালিয়ারিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং অভিবাসন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক মার্গালিদা ক্যাপেয়া ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‌এই গ্রীষ্মে সত্যিই এক ধরনের বিশৃঙ্খলা ছিল।’

বিপুল আগমনের এই পরিস্থিতিতে ১৬ সেপ্টেম্বর স্পেন সরকার দ্বীপপুঞ্জে ‘অভিবাসন জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছে।
সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, দ্রুত অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র ও জরুরি সেবা স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

প্রায় সাত মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে নতুন আশ্রয়কেন্দ্র তৈরির জন্য। ইবিজায় ১২০ জন এবং ফরমেন্তেরায় ২০ জনকে অস্থায়ীভাবে রাখার জন্য বড় সাদা তাঁবু স্থাপন করা হচ্ছে। পালমায় সবচেয়ে বেশি অভিবাসী পৌঁছানোয় সেখানে নতুন কেন্দ্র তৈরিতে দেরি হচ্ছে। এরই মধ্যে বন্দর এলাকার একটি টার্মিনাল রাতে খোলা রাখা হচ্ছে, যেন অভিবাসীরা অন্তত আশ্রয় পেতে পারেন।

রুটের পরিবর্তন ও নতুন বাস্তবতা

‘আলজেরিয়া রুট’ নতুন নয় কিন্তু এর জনপ্রিয়তা আগে এতটা ছিল না। এখন পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আগত বহু মানুষ এই পথ বেছে নিচ্ছেন।

এর কারণ, মৌরিতানিয়ার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও স্পেনের নতুন সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ চুক্তির ফলে অন্যান্য রুটে নজরদারি বেড়েছে।

২০২৩ সালে বালিয়ারিকে পৌঁছানো অভিবাসীদের ৭৩ শতাংশই ছিলেন আলজেরিয়ার নাগরিক। ২০২৫ সালে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশে।

বাকিদের বেশিরভাগই সাব-সাহারান আফ্রিকার মালি, সেনেগাল, গাম্বিয়া, বুরকিনা ফাসো, সোমালিয়া থেকে এসেছেন। এমনকি পাকিস্তান থেকেও অনেকে এসেছেন।

দাতব্য সংস্থার রেড ক্রসের বালিয়ারিক সমন্বয়ক আনা এসপিনোসা জানান, ‌সংস্থার পালমা কেন্দ্রে ৪৪ জনের জায়গা থাকলেও এখন তা যথেষ্ট নয়। আমরা বাধ্য হয়ে শহরের একটি হোটেলে অতিরিক্ত ২০টি আশ্রয়স্থান ভাড়া নিয়েছি।

মৃত ও নিখোঁজদের সংখ্যা বাড়ছে

বালিয়ারিক সরকারের হিসাব অনুযায়ী, বছরের শুরু থেকে সমুদ্রপথে ৪৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এবং ১২ থেকে ১৫ জন নিখোঁজ রয়েছেন।

এনজিও ‘কামিনান্দো ফ্রন্তেরাস’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এই আলজেরীয় রুটে অন্তত ৫১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আরও শতাধিক নিখোঁজ রয়েছেন।

আলজেরীয় তরুণ দানি এখন নিখোঁজ অভিবাসীদের খোঁজে কাজ করেন। তার খাতায় নৌকায় থাকা প্রতিটি নিখোঁজ ব্যক্তির নাম ও যাত্রার তারিখ নথিভুক্ত থাকে।

নভেম্বর মাসে এই রুটে যাত্রা সবচেয়ে বেশি হয় বলে জানা যায়। রেড ক্রস এবং স্থানীয় সংগঠনগুলো এখন প্রস্তুত। তবে সবাই উদ্বেগের মধ্যেই আছেন।

মার্গালিদা ক্যাপেয়া বলেন, ‘গত দুই মাসে আশ্রয়ব্যবস্থা কিছুটা উন্নত হয়েছে কিন্তু এখনও অনেক কিছু করা বাকি।’ বালিয়ারিকের স্থানীয় সরকারের প্রেসিডেন্ট মারগা প্রোয়েন্স ইউরোপীয় কমিশনের কাছে ফ্রন্টেক্স মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ‘বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জ এখন ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে অনিয়মিত অভিবাসনের প্রধান প্রবেশদ্বার।’

ইইউর অভ্যন্তরীণ বিষয় ও অভিবাসন কমিশনার মাগনুস ব্রুনার জানান, স্পেন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করলে ফ্রন্টেক্স মোতায়েনের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রস্তুত।

সূত্র: ইনফোমাইগ্রেন্টস

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]