মাকে খুব মনে পড়ছে আজ

ওমর ফারুকী শিপন
ওমর ফারুকী শিপন ওমর ফারুকী শিপন , সিঙ্গাপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৮:৩৪ পিএম, ১০ মে ২০২০
ফাইল ছবি

৯ বছর হলো মা নেই। তিনি আমাদের অসহায় করে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। এই ক’বছর যখনই মায়ের কথা মনে পড়েছে তখনই নিজের অজান্তে চোখের পাতা দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে।

যেদিন মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনেছিলাম সেদিন প্রতিদিনের মতো অফিস থেকে ফিরে সবেমাত্র খেতে বসেছিলাম। ঠিক তখনই দেশ থেকে কল দিয়ে ভগ্নিপতি বলেছিলেন, ‘ভাই আম্মা মারা গেছেন’। যখন শুনেছিলাম আমার মা আর পৃথিবীতে নেই। তখন মনে হয়েছিল আমি আমার সেরা সম্পদ হারিয়ে ফেললাম।

বিজ্ঞাপন

নিজের অজান্তে দু’চোখ দিয়ে অনবরত গরম অশ্রুজল গড়িয়ে পড়তে লাগল। তখন মনে হয়েছিল আমার দেহ থেকে আত্মা আলাদা হয়ে গেছে। আমি শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছি৷ আমি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে গেছি।

তখন আমার বুকের ভেতর প্রবল জলোচ্ছ্বাসে শুরু হয়েছিল। মনে হয়েছিল আমার সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেছে৷ আশ্চর্য হলেও সত্য ঠিক সেই সময় বাহিরের পৃথিবীতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমার ভেতরের জলোচ্ছাসের খবর কেউই টের পায়নি। রুমমেটরা সবাই যার যার মতো খাওয়া দাওয়া করে হাসিঠাট্টায় মেতেছিল। কেউবা জোকস বলে হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ছিল। তারা কেউ বুঝতে পারেনি আমার কী অবস্থা হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আমি খাবার ফেলে দিয়ে বিছানায় এসে কাঁত হয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ দুটি বন্ধ করে কাল্পনা করতে করতে দেশে চলে গেলাম। সেই মুহূর্তে এছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। প্রবাসীদের জন্য কাল্পনিকভাবে দেশে যাওয়াটাই সবচেয়ে সহজ। এভাবে দেশে যেতে টিকিট, পাসপোর্ট কিছুই লাগে না। আট দশ ঘণ্টা সময় লাগে না। মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই দেশে পৌঁছে যায়।

আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল মায়ের নিথর দেহটি। উঠনে খাটের উপর শুয়ে রাখা হয়েছে। তাকে ঘিরে প্রিয়জনরা কান্না করছে। মায়ের মুখটি দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। কাল্পনিকভাবে অন্যদিকে সরে গেলাম।আমি আশ্চর্য হলাম, আমার মা মারা গেছেন অথচ বাহিরের পৃথিবীতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। সবকিছু আগের মতোই আছে মুদির দোকানিরা আগরবাতি জ্বালিয়ে সন্ধ্যাকে স্বাগত জানাচ্ছেন।

অদূরে মন্দিরগুতে শোনা যাচ্ছে ঘণ্টার আওয়াজ, পূজারীরা পূজা করছেন। কোথাও কোথাও ভক্তির গানও হচ্ছে৷ মসজিদে মুসল্লিরা ওজু করে নামাজে দাঁড়িয়েছেন। গির্জাগুলিতে শান্ত গম্ভীর পরিবেশে চলছে সুমহান গান। কষ্টে জর্জরিত, অসুস্থ, অনাহারক্লিষ্ট মানুষগুলো সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করছে একটু পরিত্রাণ পাবার আশায়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

গ্রামের নির্জন জায়গাগুলোতে মাতালরা গাজা খেয়ে জ্ঞানগর্ব ভাষণ দিচ্ছে, জুয়াড়িরা লাভক্ষতির হিসেব করছে, প্রকৃতি-প্রেমিরা অপূর্ব আকাশ দেখে আনন্দিত হয়ে বলছে আহা! কি অপূর্ব এই পৃথিবী! কী মনোরম দৃশ্য।

গ্রামগুলোতে রমণীরা সন্ধ্যা বাতি জ্বালাচ্ছে। কেউ কেউ রান্না ঘরের পাশে বসে ছাই দিয়ে মাছ কুটছে। গৃহপালিত হাঁস মুরগিগুলো দলবল নিয়ে শব্দ করে খোয়াড়ে প্রবেশ করছে। বৃদ্ধরা প্রার্থনা করছেন। ছাত্রছাত্রীরা পড়ার টেবিলে পড়ার আয়োজন করছে৷

অথচ তারা কেউ জানে না আমার বুকের ভেতরটা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে, সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত আমার পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই৷ সন্ধ্যা, আলো, অন্ধকার প্রকৃতি চলছে স্ব স্ব নিয়মে এতবড় পৃথিবী প্রকৃতির কোথাও কোনো পরিবর্তন হয়নি। অথচ মা হারিয়ে গেলেন নীরবে, নিভৃতে।

বিজ্ঞাপন

আবারও চলে এলাম মায়ের মৃতদেহের পাশে। মাকে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মৃতদেহ কবরে নামানো হবে। মাকে এভাবে নীরবে চলে যেতে দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। আমার কান্না শুনে রুমমেটরা আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। একজন কাঁধেচাপা দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ভাই এভাবে কাঁদছো কেন? কী হয়েছে তোমার? তার কথায় কাল্পনিক জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসি। তখন তার গলা জড়িয়ে কান্নায় ফেটে পড়ি। মায়ের মৃত্যুর কথা শুনে সেদিন সবাই ব্যথিত হয়েছিল।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

আজ ৯ বছর হলো মা নেই। তবুও সেই পূরনো ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি। আজকাল চোখ বন্ধ করে মায়ের মুখটা কল্পনা করলে মায়ের আবছা অবয়ব ভেসে উঠে৷ মা যেন আমার জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে৷ অথচ এমনটা হবার কথা ছিল না। মা আমাকে ক্ষমা করে দিও। মা তোমাকে কখনো বলা হয়নি, বড্ড ভালোবাসি তোমায়।

এমআরএম/এমকেএইচ

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com