বিলাসিতা ছেড়ে শ্রমিকদের দু’বেলা খাওয়াচ্ছেন প্রবাসী দম্পতি
মো. শরীফ উদ্দিন
সিঙ্গাপুরে সার্কিট ব্রেকারের সময় এখন অবরুদ্ধ। এমন অবস্থায় জীবনের তোয়াক্কা না করেই প্রবাসী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন কবির হোসেন। স্ত্রী নুরিয়া তার এমন কাজের অনুপ্রেরণা ও সার্বক্ষণিক সহযোগী। গত রমজান থেকেই নিয়মিত প্রবাসীদের বিনামূল্যে ইফতার ও শুকনো খাবার দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন এ দম্পতি।
মহামারিকালে মানবতার এই ফেরিওয়ালা কবির হোসেনের বাড়ি বাংলাদেশের কুমিল্লার চান্দিনায়। পড়াশোনা শেষে ২০০০ সালে কর্মসংস্থানের উদ্দেশে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান। সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে প্রতিযোগিতামূলক এই অট্টালিকার শহরে প্রতিষ্ঠিত করেন নিজেকে। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিক।
নিজের গাড়ি, বাড়ি ও ছোট্ট একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। ২০১২ সালে এক ভারতীয় নারীকে। দুই সন্তান নিয়ে সুখের সংসার তাদের। তবে করোনা মহামারিতে জীবন যখন থমকে গেল তখন একদিন ছোট্ট একটি ঘটনা কবির হোসেনের মনকে আলোড়িত করে। হৃদয়কে অনেক প্রসারিত করে দেয় অনেকখানি।
কবির একদিন থার্মোমিটার কেনার জন্য সিঙ্গাপুর ভিরাসামি রোডে যাওয়ার পথে লক্ষ্য করেন ছোট্ট একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁ ‘কৃষ্ণা’চ কিচেনে’ এক দম্পতি ফ্রি খাবার বিতরণ করছেন। তা দেখে কবিরের খুব ভালো লাগে। উৎসুক হয়ে কাছে গিয়ে তাদেরকে কিছু অর্থ দান করেন।
ফিরে আসার সময় একটা ভিডিও তৈরি করে নিজের ফেসবুক ওয়ালে দেন যেন বিপদগ্রস্ত প্রবাসীরা সেই রেস্তোরাঁ থেকে ফ্রি খাবার সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু ভিডিওটি আপলোড দেওয়ার পর প্রচুর মানুষের সাড়া পড়ে তার মন্তব্যের ঘরে। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন, কারণ সেই রেস্তোরাঁয় এত মানুষের খাবার ফ্রি দেওয়া সম্ভব ছিল না।
তিনি ঘরে ফিরে বিষয়টা স্ত্রী নুরিয়াকে জানান। নুরিয়া তাকে উৎসাহ দেন প্রবাসীদের পাশে গিয়ে সহযোগিতা করতে। এছাড়া তার স্ত্রীও নাকি ভেবে রেখেছিলেন রমজান মাসে প্রবাসী মুসলিমদের ইফতার দিয়ে সহযোগিতা করবেন। তারপর শুরু হয় তাদের নতুন এক পথচলা। তৈরি হয় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর গল্প।
নিজেদের গড়া ব্রুকলিনজ কমিউনিটি সাপোর্ট থেকে অর্থ উত্তোলন করে লরি নিয়ে নেমে পরেন প্রবাসী শ্রমিকদের বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণের কাজে। পরিচিতজনরাও অর্থ দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। সন্তানদেরকে রেখে আসেন তাদের নানীর কাছে। তারপর এই দম্পতি ছুটে চলেন মানবতার পাশে একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে।
বিপন্ন এ সময়ে যখন মানুষ বেঁচে থাকার নেশায় আতঙ্কিত। প্রতিটা দিন কাটছে অস্থিরতায়। মানুষ যখন ঘরমুখী, প্রতিদিন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ঠিক সেই সময় কবির হোসেন বিএমডব্লিউ ছেড়ে লরি ড্রাইভ করে তরমুজ এবং শুকনো খাবার নিয়ে ঘুড়ে বেড়ান শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
আর এই সময়ে পাশে থেকে তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেন সহধর্মিণী নুরিয়া। তাদের এই মহানুভবতা দেখে তাদের কোম্পানির সিঙ্গাপুরিয়ান ম্যানেজার মার্টিনও বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত। তারা একেবারে কাছ থেকে অনুভব করেন সঞ্চয়হীন সংকটে পতিত প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখ কষ্ট আর বেদনাময় বাস্তব বন্দি জীবনের চিত্র।
প্রতিদিন ছয় থেকে সাতশ শ্রমিকের কাছে বিভিন্ন খাবার পৌঁছে দেন তারা। সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি চলে স্বামী-স্ত্রীর এই ছুটে চলা। কখনো গাড়িতে বসেই ইফতার করেন, নামাজও আদায় করতে পারেন না ঠিক সময়ে। নিজেরা ক্ষুদার্থ থাকলেও অচেনা এই মানুষগুলো পাশে দাঁড়িয়ে মহত্ত্ববোধ তারা দেখিয়েছেন তা সত্যিই বিরল।
আর প্রবাসীরাই কি কখনো ভেবেছিলো একজন ভিনদেশী মমতাময়ী বোন তাদের জন্য নিজ হাতে কেক বানিয়ে তাদের খাওয়ানোর জন্য ছুটে আসবেন? বোধহয় এটাই সত্যিকারের মানবতাবোধ, সত্যিকারের মানবপ্রেম। মহামারিকালে স্বেচ্ছাসেবীর কাজে এগিয়ে এসে এক ব্যতিক্রম উদাহরণ তৈরি করেছেন এই দম্পতি।
সিনেমা নয় বাস্তব জীবনের এসব চরিত্রই হয় সমাজের প্রকৃত ‘হিরো’। কবির যখন চার পাঁচ কেজি ওজনের এক একটি তরমুজ সীমানা প্রাচীরের উপর দিয়ে শ্রমিকদের
দিচ্ছেলেন দূর থেকে তার স্ত্রীর চোখে এই মানুষটির প্রতি নিশ্চয়ই ভালোবাসা নিশ্চয় বাড়ছিল। হয়তো কবিরের এমন কাজ দেখে চোখের কোণে জল এসেছিল নুরিয়ার।
মহামারির এই সময়ে সমাজে কবির হোসেনদের মতো দম্পতির বড্ড প্রয়োজন। যারা একজনের কাঁধে আরেকজন ভর করে বেঁচে থাকাকে আনন্দময় করেন তোলেন। পৃথিবী হয় আরও সুন্দর, আরও মানবিক। মহামারি একদিন শেষ হবে, কিন্তু অসহায় এসব মানুষের হৃদয়ে কবির দম্পতি অনুপ্রেরণার আলো হয়ে বেঁচে থাকবে।
এসএ/এমআরএম/এমকেএইচ