কানাডার মাটি আমায় আজও টানে না

মো. মাহমুদ হাসান, কানাডা থেকে
জন্মভূমির মাটি ছেড়েছি চৌদ্দ বছরেরও বেশি। রকি মাউন্টেইনের পাদদেশ অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, দৃষ্টিনন্দন ও পরিকল্পিত শহর ক্যালগেরিতে আমার বসবাস। কানাডা আমাকে অঢেল দিয়েছে। তবুও দেশটির মাটি আমায় আজও টানে না।
কানাডার মাটি কেন আজও আমার আপন হয়ে উঠেনি? এর কোনো ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ বা সদুত্তর আমি খুঁজে পাইনি। আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগরে পরিবেষ্টিত আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম দেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ সকল মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা সংবলিত কল্যাণ রাষ্ট্র বলে পরিচিত দেশটি।
যে মাটিতে আমার জন্ম, যে বাতাসে আমার বেড়ে উঠা, যে পলিমাটি আমাকে একদিন কর্দমাক্ত করেছিল। সীসা আর দূষণের মাত্রায় যে দেশটির শহর বসবাসের অনুপযোগী বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা আছে, সে দেশের মাটি আমাকে এত টানে কেন?
বোন-ভাই, মেয়ে-ছেলে ভাগ্নে-ভাগ্নি, স্ত্রী, মহীয়সী মাসহ নিকটাত্মীয়ের প্রায় সকলেই যখন উত্তর আমেরিকারই বাসিন্দা, কোন অদৃশ্য শক্তি অনিয়ম, দুর্নীতি, আর অনৈতিকতার হাজারো অভিযোগে অভিযুক্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশটির প্রতি আমাকে এত দুর্বার গতিতে আকর্ষণ করতে থাকে?
আর এই চুম্বকীয় শক্তি মাঝেমধ্যে যখন আমায় নিদ্রাহীন করে তোলে রক্তচাপটিও তখন আমাকে প্রতারিত করে, কৃত্রিমতার আড়ালে বিষণ্নতার চাপ লুকিয়ে রাখা বড় বেশি কঠিন হয়ে উঠে। গাড়ি-বাড়ি বিলাসী আবাস কোনো কিছুই তখন এই রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণের পথ্য হয়ে উঠে না।
গত একযুগে প্রিয় দেশটির অগ্রগতি অনেক। সূচকে বিস্ময়কর সাফল্য আছে। প্রায় সকল আন্তর্জাতিক উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানই বলছে, এভাবে এগিয়ে গেলে ২০৩৫ এর আগেই ২৩তম অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সুশাসন, চিকিৎসা, শিক্ষার মান নিয়ে মত ভিন্নতা থাকলেও উন্নয়ন নিয়ে সংশয় নেই।
নৈতিক আর সামাজিক মূল্যবোধের ভয়ঙ্কর অধোগতি কোনোভাবেই টেকসই উন্নয়নের অনুকূলে নয়। বৈষম্য দূরীকরণে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ ছাড়া সুষম উন্নয়নের পথ কোথায়? করোনাকালে স্বাস্থ্যসহ সেবা খাতের বেহাল দশা তো পুরো জাতিকেই লজ্জিত করেছে। তবুও সেই দেশটির প্রতি নিষ্ঠুর এক অমোঘ ভালোবাসা আমায় এত ব্যাকুল করে কেন?
বাঙালি আর বাংলাদেশিদের বিচরণ আজ কোথায় নেই? আমার শহর ক্যালগেরিতেও আজ হাজার হাজার বাংলাদেশি। আশার কথা ভাবমূর্তির বিচারে এখানকার বাংলাদেশিরা যথেষ্ট সম্মানজনক অবস্থানকেই ধরে রেখেছে। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনসহ আছে নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় সংগঠনও।
ব্যতিক্রমী ভালোবাসায় পারস্পরিক সম্প্রীতিও আছে। সবার ভালোবাসায় গড়া বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন তো দেশ আর সংস্কৃতির ভালোবাসায় ছায়া হয়েই আছে। ঈদ, পূজা-পার্বণে বাঙালি সংস্কৃতি, আর ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের ও ঘাটতি থাকে না। তবুও এসব দিনে যেন বিষণ্নতা আমায় আরও আকড়ে ধরে।
একি শুধু আমারই নিয়তি নাকি নিয়তির এমন নিষ্ঠুর খেলায় আমার মতো হাজারো প্রবাসীর হ্রদয় প্রতিনিয়ত-ই দগ্ধ হয়? কোন কোন বন্ধু স্বজন অভিযোগ করেন, স্বার্থের নেশায় হাজারো বাঙালি প্রবাসী হয়! এর কোনো যথার্থ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আমার কাছে নেই। তবে অভিযোগটি সত্যি হলে মাটির দহনে দগ্ধ হতে আপত্তি নেই।
নিউ ইয়ার্স ইভ মানে ৩১ ডিসেম্বর শেষে নববর্ষের প্রথম পক্ষে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নব আনন্দে জেগে উঠে বিশ্ব। ২০১৬ সাল থেকেই এ দিনটি আমার জন্য বড় বেশি বিষাদময় হয়ে উঠে। আনন্দে উদ্বেলিত বন্ধু, শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের অক্ষমতা আমাকে ব্যথিত করে।
এ দিনটিতে আমার শিক্ষক পিতার নিস্প্রাণ দেহ আমার মানসপটে ভেসে উঠে। ঋণ শোধের অক্ষমতা আমায় বড় বেশি ভারাক্রান্ত করে। পিতার শায়িত কবরে একমুঠো মাটি দিতে না পারার ব্যর্থতা আমাকে নিদারুণ উৎকণ্ঠিত করে।
প্রত্যাশা করি, কোভিড-১৯ এর উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আর সকল হতাশাকে পেছনে ফেলে ২০২১ এর বিশ্ব শান্তিময় হয়ে উঠুক। বিধাতার অমোঘ কৃপায় স্বজন হারানোর ব্যথা কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক মানবসমাজ।
লেখকঃ কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
এমআরএম/এমকেএইচ