শ্রাবণের ধারার মতো - কাজী মিতুলের ছোট গল্পের সংকলন
শ্রাবণের ধারার মতো বন্ধু মিতুলের ছোট গল্পের সংকলন। এটা তার প্রকাশিত তৃতীয় বই। অপ্রকাশিত বইয়ের তালিকা অনেক দীর্ঘ। আমি বলেছিলাম ‘তুই আমাদের জীবনানন্দ’। তুই লিখে এখনকার ডিজিটাল ট্রাংক গুগল ড্রাইভে রেখে দিচ্ছিস। পরে আমাকে ভূমেন গুহ হয়ে সেগুলো প্রকাশের দায়িত্ব নিতে হবে। যাইহোক শ্রাবণের ধারার মতো কাছে ফিরে আসি।
এই বইয়ে মোট গল্প আছে তেইশটি একটার কথা সূচিপত্রে উল্লেখ নাই। গল্পগুলো পরিসরে আসলেই অনেক ছোট। কয়েকটা গল্প আছে মাত্র এক পাতার তবে কয়েকটা আছে একটু বড় পরিসরের। ছোট হোক বড় হোক বা ন্যানো আকারের গল্প হোক প্রত্যেকটা গল্পই বিষয়বস্তু বিবেচনায় অন্যন্য। একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উঠা মুশকিল।
প্রথম কয়েকটা গল্প আধুনিক জীবনযাত্রার অপ্রিয় প্রতিচ্ছবি। বর্তমানের ডিজিটাল দুনিয়ায় মেকি সুখের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে আমরা কিভাবে শেকড় থেকে দিনে দিনে দূরে সরে যাচ্ছি আছে সেই বিবরণ। খুব সহজেই বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের পাঠক নিজেকে রিলেট করতে পারবেন। বাবা দিবস, মা দিবস এবং অমানুষ গল্পগুলো আসলে আপনাকে ভাবাবে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে।
এরপর আছে দুটো ন্যানো আকারের গল্প মিষ্টি এবং ফাউন্ডেশন। এই গল্প দুইটা আমাদের মানসিকতায় দিনে দিনে যে অবক্ষয় ঢুকে পড়েছে সেগুলোরই বাস্তব প্রতিফলন। আমার মনে হয়েছে মূল গল্পগুলো শুরু হয়েছে সহমর্মী থেকে। শুরুর পাঁচটা গল্প পার হয়ে যখন আপনি সহমর্মীতে আসবেন তখন আপনি ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন লেখকের ভাবনার গভীরতা। শব্দ এবং ভাষার প্রয়োগের মাত্রা।
সহমর্মী, প্রতিদান, মায়ের শাড়ি, প্রতিজ্ঞা ১৯৭১, আড়ালে, ফানুস, প্রেম অথবা মাতৃত্বের গল্প, রাণুর চিঠি, বিষাক্ত আসলে কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি। এক একটা গল্প শেষ করার পর মাথার মধ্যে চরিত্রগুলো কথা বলতে থাকে। আর ছোট গল্পের ধর্ম অনুযায়ী গল্পগুলোর বর্ণনা এবং উপসংহার এমনভাবে টানা হয়েছে যে পাঠ করতে করতে আপনাকে মোটেও একঘেয়েমি পেয়ে বসবে না। পাঠের পুরো সময়টা আপনি উপভোগ করবেন সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
কয়েকটা গল্পের কথা আলাদাভাবে বলতেই হচ্ছে। ১৯৭১ আমাদের জীবনে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় কিন্তু অনেক লেখকই এটা নিয়ে লিখতে যেয়ে ভাষার সৌন্দর্য রক্ষা করতে তখনকার বিভৎসতাকে খাটো করে দেখান কিন্তু এই লেখক সেটা করেননি। সামান্য একটা ছোট গল্পের মাধ্যমেই পুরো একাত্তরের বিশালতার পাশাপাশি বিভৎসতা এবং বাংলাদেশিদের চারিত্রিক দৃঢ়তার ব্যাপারটা ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই গল্পটা শেষ করার পরও গল্পের চরিত্রগুলো মাথার মধ্যে জীবন্ত হয়ে চলাফেরা করে।
আড়ালে গল্পটা পড়লে মনে হবে এটা নিয়ে একটা দীর্ঘ গোয়েন্দা উপন্যাস লেখা সম্ভব। বিষাক্ত গল্পটা একটা দুর্দান্ত থ্রিলার গল্পের প্লট। টানটান উত্তেজনা নিয়ে পাঠ করতে হয়। শেষ না করা পর্যন্ত মনে শান্তি পাওয়া যায় না। মায়ের শাড়ি লেখাটার বিষয়বস্তু আপনাকে কাঁদাবে নিশ্চিত এবং ভাবতে বাধ্য করবে যে ভোটের রাজনীতির জন্য আমাদের তৈরি বিভাজন আসলে কতখানি দরকারি।
ফানুস গল্পটাও আপনাকে ভাবাবে। মেয়েদের আলাদা করে দেখার আমাদের চিরায়ত ভাবনায় এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? এমন প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসবে পাঠকের মনে। আধুনিক নগর ব্যবস্থার অন্ধকার রূপের প্রতিফলন প্রেম অথবা মাতৃত্বের গল্প। তবে গল্পটা পড়া শুরু করার এবং শেষ করার পরের অনুভূতি কিন্তু একেবারেই আলাদা।
রাণুর চিঠি দেশভাগের বিষয়টাকে সামনে নিয়ে আসবে। মুক্তি এবং বৃষ্টিভেজা মুখ গল্প দুটো পাঠককে কাঁদাবে নিশ্চত। আর শেষ গল্প যেটার নাম বইটার নামকরণঃ শ্রাবণের ধারার মতো। এই যে আমাদের নিত্যদিনের ব্যস্ততা, স্বপ্নকে তাড়া করে ফেরা। এভাবে আসলে আমরা জীবনের কাছে কি পেতে চাইছি। আর এইভাবে অষ্টপ্রহর দৌড়ে আমরা আসলে কিইবা অর্জন করছি। আমরা যা অর্জন করছি তার বিনিময়ে আমরা কি তার চেয়ে বড় কোন কিছু হারাচ্ছি জীবন থেকে?
যাইহোক, ছোট গল্পের ধর্ম মেনেই গল্পগুলো আপনাকে আকৃষ্ট করবে। পাঠ করতে যেয়ে আপনি কখনও হাসবেন আবার কখনও কাঁদবেন। কখনও ভেবে বসবেন এভাবে আর না, নতুন করে শুরু করতে হবে। সোজা কথায় পাঠ সময়টা আপনি উপভোগ করবেন এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়।
এমআরএম/জিকেএস