ঈদে দেশে টাকা পাঠানোই প্রবাসীদের বড় আনন্দ

ঈদ আনন্দের ধরন বয়সের সঙ্গে পরিবর্তন হয়। শিশুরা ঈদের জন্য কেনা জামা লুকিয়ে রেখে আনন্দ পায়। সে আরেকটু বড় হলে ঈদের সালামি তুলে আনন্দ করে। কিশোর বেলা একটু দূর-দূরান্তে ঘুরে আসতে পারলে ঈদের আনন্দ আরও বেড়ে যায়। দূরের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন, নিজের এলাকার বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ঈদ এলে সবাই একসঙ্গে হবে, এটাই যেন বড় পাওয়া।
চাকরির কারণে নিজের শহর থেকে দূরে গেলে, ঈদ উপলক্ষে পরিবারের সবার দেখা হবে এটাই যেন আরেকটা ঈদ। কোনো আনন্দই একা উদযাপন করা যায় না। পরিবার-পরিজন বন্ধু-বান্ধব ছাড়া কোনো আনন্দই যেন পূর্ণতা পায় না।
বাংলাদেশের অন্তত দুই কোটি মানুষ প্রবাসে জীবন-যাপন করে। তার বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্য বা অন্যান্য দেশের যেখানে পরিবার পরিজন নিয়ে যাওয়া যায় না অতি সহজে। তাদের কাছে ঈদ মানে সেই গতানুগতিক জীবন। কাজ বাসা এবং মাস শেষে দেশে টাকা পাঠানো। ঈদ আসলে আর একটু বাড়তি চাপ।
প্রিয়জনদের জন্য বাড়তি টাকা পাঠাতে হবে। ঈদের খরচ। দেশে একটু বেশি করে টাকা পাঠাতে পারলে বাড়ির মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পরিজন, সন্তান-সন্ততি ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন সবাই তাদের পছন্দমতো কেনাকাটা ও ঘোরাফেরা করতে পারবে। সবার মন আনন্দে ভরে উঠবে।
ইউরোপ আমেরিকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে যাওয়া গেলেও ঈদের প্রকৃত আনন্দ কি তারা পায়? মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীরা ঈদে বাড়তি কিছু বোনাস পেলেও ইউরোপ আমেরিকায় সেই সুযোগ নেই। এখানে কাজ নেই তো টাকাও নেই। চাইলেই ঈদের দিন ছুটি পাওয়া যাবে সেই সুযোগও নেই।
তারপরেও কেউ কেউ নানান কায়দা করে ঈদের দিন ছুটির ব্যবস্থা করে ফেলেন। যারা পারেন না তারা কাজের ফাঁকে ঘণ্টাখানেক ছুটি নিয়ে ঈদের নামাজ শেষ করে আসেন। এই নামাজে কি ঈদে আনন্দ পাওয়া যায়? ঈদের নামাজ মানেই তো বন্ধু-বান্ধব পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে দীর্ঘসময়ের কোলাকুলি। কোরবানির ঈদে গরু-ছাগল কোরবানি দেওয়ার জন্য ছুরি চাকু শাল দিয়ে রাখা; নিজেরাই চামড়া ছিলানো আর গোস্ত কেটে দিলি বণ্টন করা। এসবেই তো ঈদের আনন্দ থাকে।
এই প্রবাসে এ ধরনের ঈদ আনন্দের তেমন সুযোগ আসে না। গ্রোসারি দোকানগুলো এখানে কোরবানির অর্ডার নেয়। ঈদের আগে থেকে নাম লিখিয়ে রাখতে হয়। এক নামে শরিক হতে চাইলে তিন থেকে চারশো ডলার। গোসারির কর্মচারীরা ঈদের দিন টুকরো করা মাংসের পুটলা ধরিয়ে দেয় কুরবানি দেওয়া ব্যক্তির কাছে।
অনেকটা নিত্যদিনের মাংস কেনার মতোই। সহিভাবে কোরবানি দেওয়া মাংস না হয় পেলো কিন্তু এসব বিলি বণ্টন করবে কোথায়? বিলিয়ে দেওয়ায়ই তো কোরবানি ঈদের মূল আনন্দ। সেই হিসেবে বেশিরভাগ মানুষই দেশে কোরবানি দিয়ে থাকেন।
ঈদের নামাজ পড়া, নিজের জন্য নতুন জামা কাপড় কেনা, কোরবানি দেওয়া এসব কোথাও যেন প্রবাসীরা প্রকৃত আনন্দ খুঁজে পান না। তাহলে তাদের ঈদের আনন্দ কিসে? আমি দেখেছি প্রবাসীদের ঈদের বড় আনন্দ দেশে টাকা পাঠানোটাই। দেশের টাকা পাঠানোর এজেন্সিগুলোতে দীর্ঘ লাইন দেখি ঈদের আগে আগে।
টাকা পাঠানোর পর তাদের মুখে যে সুখের আভা দেখা যায় তা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। টাকা পাঠানোর পর তার মা-বাবা, ভাই-বোন, ভাগিনা-ভাতিজা-ভাস্তি অথবা নিজের স্ত্রী পুত্র কন্যা যে আনন্দ করতে পারবে এটাই যেন তার নিজের আনন্দ। যে আনন্দ একা অথবা গুটি কয়েক মানুষ নিয়ে সে এই প্রবাসে উদযাপন করতে পারে না।
তোফাজ্জল লিটন। নাট্যকার ও সাংবাদিক
এমআরএম/জিকেএস