কোনো এক একুশে ফেব্রুয়ারি
আমার এখনই হলে ফিরতে ইচ্ছে করছে না

ক খ হাসান
সামনের দিকের সারিতে বসা একজন বিদেশি মাঝ-বয়সী সালোয়ার কামিজ পরিহিতা নারী বেশ কিছুক্ষণ ধরেই চেষ্টা করছিল সঞ্চালকের দৃষ্টি আকর্ষণের। তাকে বলার সুযোগ দিতেই ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন, আমি একজন জাপানিজ নাগরিক।
আপনাদের দেশে একটা বেসরকারি উন্নয়ণ সংস্থায় জাপানিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কাজ করছি গত কয়েক বছর ধরে। এ দেশে আপনাদের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগে।
সত্যি বলতে কি মাতৃ ভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা করেই পৃথিবীর অনেক দেশই শিল্পোন্নত হয়েছে- যেমন জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ আরও অনেক দেশ। তাই আমি বলব আপনারা মাতৃভাষায় জোর দেবেন- আপনারাও একদিন উন্নত জাতি বা দেশ হিসাবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশ করতে পারবেন বলে আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি।
জাপানিজ নারীর মতামতের পরই সঞ্চালক জানতে চাইলেন এ ব্যাপারে আর কারও কোনো বক্তব্য বা মন্তব্য আছে কিনা। কেউ কিছু বলছে না দেখে তপু কথা বলার এই সুযোগটা নিলো। ও জাপানিজ নারীর উদ্দেশে বললো, আপনার আমাদের দেশীয় ধরনের পোশাক আর মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা দেখে আমার ভালো লেগেছে। তবে আপনারা কি বিদেশি অন্যকোনো ভাষা যেমন ইংরেজী শেখেন না?
উত্তরে জাপানিজ নারী আবারও ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন, কি যে বলেন না? বেশ কিছু বছর হলো জাপানের স্কুলগুলোতে ইংরেজী বাধ্যতামূলক বিষয় হিসাবে পড়ানো হয়ে থাকে।
আলোচনা সভা শেষে ওরা বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখলো সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়া শুরু করেছে। তপু রিমাকে কিছু একটা বলতে যাবে আর তখনই রিমা বলে উঠলো, আচ্ছা, তপু আজ সভাতে আমাদের উপাচার্য আর বিজ্ঞ সাংবাদিক যা বললেন আমার তো মনে হয় খুব সহজেই আমরা এগুলোর বাস্তব রূপ দিতে পারি, তাই না?
অবশ্যই, আর সেটাইতো দেশমাতৃকার কাছে আমাদের আজকের দিনের প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত- ধীর কিন্তু স্থির কণ্ঠে তপু বলে উঠলো। মিনিট কয়েক হাঁটতেই ওরা মিলনায়তনের পশ্চিম পাশের খোলা ময়দানের প্রান্তে এসে পৌঁছালো। আর রিমা কিশোরী বালিকার মতো বলে উঠল।
দেখো দেখো- ময়দানের মাঝখানটাতে আমাদের ক্যাম্পাসের নিয়মিত চটপটির বুড়ো চাচা আজ এখানে চটপটি বিক্রি করছে।
তাই তো। তুমি নিশ্চয় চটপটি খেতে চাও, তাই না?
সেটা কি আর বলতে?'
ওরা মনোযোগ সহকারে চটপটি খেয়ে চলেছে। হঠাৎই রিমা বললো, আমার না মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আচ্ছা, আমরাও কি ঢাকার ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র মতো প্রতি বছর ভাষার এই মাসে আমাদের ক্যাম্পাসে ছোট পরিসরে বইমেলার আয়োজন করতে পারি না?
অবশ্যই, কিন্তু একই মাসে বইমেলার আয়োজন করলে আমার মনে হয় না ঢাকা থেকে কোনো প্রকাশনা সংস্থা এখানে আসবে।
তাহলে কিছুই কি করার নেই?
আমার মনে হয় আমরা ফেব্রুয়ারি মাসকে বাদ দিয়ে মার্চ মাসের শেষ দুই সপ্তাহে ‘ভাষা ও স্বাধীনতা বইমেলা’ নামে একটা উদ্যোগ নিতে পারি।
এটা খুবই ভালো প্রস্তাব। আমরা আমাদের ছাত্র সংসদের সদস্যদের সঙ্গে এটা নিয়ে আলোচনা করতে পারি, তাই না?
ওদের চটপটি খাওয়া শেষ হতে না হতেই রিমা তপুকে বললো,
আগের পর্ব পড়ুন: আমিও তোমার মতো একটা বর্ণমালাময় পাঞ্জাবি কিনতে পারতাম!
আমার না কেন জানি এখনই হলে ফিরতে ইচ্ছা করছে না। চল না ঘাসের ওপর একটু বসি।
তপুও মনে মনে এমনটাই ভাবছিল আর ওরা উভয়েই ঘাসের ওপর বসে পড়লো। এরই মাঝে ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বন্ধু-বান্ধবী যেন হাওয়া থেকে উদয় হয়ে গোল হয়ে একত্রে বসে পড়লো। তপু ওদের উদ্দেশে বললো,
আমরা কিন্তু তোদের আজকের আলোচনা সভায় দেখেছি। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে তোদের কাউকেই আর দেখলাম না।
ওদের মাঝ থেকে একজন বান্ধবী হাসতে হাসতে বললো
তোমারতো নিজেদের মাঝে ভাবের আদান-প্রদানে ব্যস্ত ছিলে তাই অন্য কাউকেই তোমাদের চোখে পড়েনি।
এবারে ভাব-গম্ভীর স্বভাবের এক বন্ধু বললো,
আজে বাজে কথা তোরা রাখ তো। তা এবারে বলতো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ব্যাপারে দেশে আইন-কানুন আছে কিন্তু ভাষা আন্দোলনের এত বছর পরেও কেন আমরা এর সঠিক প্রয়োগ করতে পারিনি?
এ প্রশ্নের পর ওদের আড্ডায় কেন জানি ছন্দপতন ঘটলো। একটু উসখুস করে রিমা বললো,
দেখো, এটা সত্যি যে ভাষা আন্দোলনের পর অনেকগুলো বছর পঞ্জিকার পাতা থেকে ঝরে গেছে। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে ওই আন্দোলনের সফলতাই আমাদের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি।
আর আইন-কানুনের কথা বলছো- আমাদের দেশে এটার কোনো অভাব কোনোকালেই ছিল না হয়ত হবেও না। আমার মনে হয় আমাদের অভাব হলো আইনের যথাযোগ্য প্রয়োগের আর জনগণের বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজের সদিচ্ছার।
অধ্যাপক ক খ হাসান, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালগারি, কানাডা
এমআরএম/এএসএম