আমার বন্ধু পল

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০২:২৩ পিএম, ২৫ জুলাই ২০২৩
লেখকের বন্ধু পল

পলের সঙ্গে ঠিক কবে যে পরিচয় হয়েছিল সেটা এখন আর নির্দিষ্ট করে মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে পল আমাদের আরেক বন্ধু সানজাদের কাছে প্রোগ্রামিং শিখতে আসতো। সেখান থেকেই প্রথম পরিচয় হয়েছিল হয়তোবা। তবে পলকে চিনতাম তারও আগে থেকে। কলেজ জীবনটা আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো ক্ষণস্থায়ী ছিল। কিন্তু সেই দুটো বছরের প্রভাব আছে আমাদের বাকি জীবনজুড়ে। কলেজ জীবনে উঠেই প্রথম রাজনীতির সাথে পরিচয় হলো। সেখানে সাহসী নেতৃত্ব ছিল পলের।

সত্যি কথা বলতে তাই পল সর্ম্পকে মনের মধ্যে কখনও ভালো মনোভাব ছিল না। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় পল হয়ে উঠলো প্রিয় বন্ধু, আদরের বোনজামাই। সে গল্পই আজ শোনাবো আপনাদের। পলের মুখের ভাষা হচ্ছে আমাদের কুষ্টিয়ার স্থানীয় কথ্য ভাষায়। ভদ্রলোকেরা মনে করেন কুষ্টিয়ার ভাষা মানেই ব্যাকরণের প্রচলিত প্রমিত ভাষা। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক তেমন নয়। কুষ্টিয়ার শহর অঞ্চলের মানুষেরা সেই ভাষাটা চর্চা করলেও কুষ্টিয়ার মানুষদের আঞ্চলিক একটা ভাষাও আছে। আর সেটা ভদ্রলোকদের কাছে মোটেও সমাদৃত নয়।

jagonews24রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতুতে বন্ধুদের সাথে পল

বিজ্ঞাপন

মানুষকে সম্বোধন করার পলের একটা নিজস্ব স্টাইল আছে হোক সেটা ফোনে অথবা সামনাসামনি। পলের সামনে গেলেই হেড়ে গলায় ডেকে উঠবে, উরে আমার বান্দির বাচ্চা আইছে দেখো। অথবা কল দিলেই বলে উঠবে, কি রে বান্দির বাচ্চা এতদিন পর মনে পড়লো এই ভাতারের কথা। শুরুতে মনে মনে ভাবতাম ও হয়তোবা আমাকে ছোট করার জন্য এমন বলছে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, এটাই ওর স্বাভাবিক ডাক। এই ডাকের মধ্যে এমন একটা প্রাণচাঞ্চল্য আছে যে এখন ওর মুখ থেকে এই ডাকটা না শুনলে বুকটা খালি খালি লাগে।

পলের কাছ থেকে কত বিষয় যে শিখছি। এখানে ছোট পরিসরে কয়েকটার উদাহরণ দেওয়া যাক। পল নাদিরা ভাবিকে বিয়ে করেছিল ভালোবেসে। আমি অবশ্য নাদিরা ভাবি না বলে মেয়ে বলে সম্বোধন করি। কারণ উনার বাসা আমাদের এলাকাতেই। আর সেই সূত্রেই উনি আমার বোন এবং পল বোনজামাই। সেখান থেকে সংক্ষিপ্ত রূপে জামাই। পলের সাথে দেখা হলেই আমি জামাই বলে ডাকি। এমন বোনজামাই পাওয়া আসলে অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার। নাদিরা আপা পরিবারের বড় মেয়ে সেই হিসাবে পল পরিবারের বড় জামাই। পল এই দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলেছে।

jagonews24
লেখকের বন্ধু পল

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বুয়েট থেকে পাশ করে সিমেন্স হয়ে ততদিনে বাংলালিংক মোবাইল কোম্পানিতে যোগদান করেছি। অপটিক্যাল ফাইবারের কাজে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত দৌড়ে বেড়াচ্ছি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম লিংকের কাজ শেষ হয়ে শুরু হলো চট্টগ্রাম শহর রিংয়ের কাজ। আমি ঢাকা সকালে থেকে রওয়ানা দিয়ে সন্ধ্যায় বা রাত্রে চট্টগ্রাম পৌঁছে উঠি পলের জি ই সি মোড়ের বাসায়। শহরের মধ্যে অপটিক্যাল ফাইবারের রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু হয় রাত্রি সাড়ে নয়টার পর। তাই আমাকে সারারাত সাইটে থাকতে হয়।

আরও পড়ুন: সাঁজাল তাপানোর দিনে

এই অবস্থায় পল আমাকে ওর বাসার চাবির একটা আমাকে দিয়ে দিল যাতে করে আমি যেকোনো সময় আসা যাওয়া করতে পারি। আর খাওয়াদাওয়া অবধারিতভাবেই ওর খরচে করতাম। আমাকে অফিস থেকে ঢাকার বাইরে থাকা খাওয়ার জন্য প্রতিদিন একগাদা করে টাকা দেওয়া হতো। পলের ওখানে থাকাতে আমার প্রায় সব টাকায় বেঁচে যেত। কিন্তু পলকে কখনোই একটা টাকা দিতে পারিনি খরচ বাবদ। দিতে গেলেই বলতো, বান্দির বাচ্চা খুব বড়লোক হয়ে গিছিস মনে হচ্ছে। এরপর আমি আর কথা বাড়াতাম না। এই হচ্ছে আমার বন্ধু পল। একবার শুধুমাত্র আমরা সব বন্ধু মিলে রাঙামাটি বেড়াতে গিয়েছিলাম।

jagonews24রাঙামাটিতে বন্ধুদের সাথে পল

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

তবে পলের কাছ থেকে আমি যে শিক্ষাটা নিতে পারিনি সেটা হলো পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য। ছোটবেলায় স্কুলের বাংলা পাঠ্যবই ‘আমার বই’তে একটা কবিতা ছিল ‘মাতৃভক্তি’ শিরোনামে। যার বিষয়বস্তু ছিল, হজরত বায়েজিদ বোস্তামির নিকট একরাত্রে তার মা পানি খেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ঘরের মধ্যে পানি পেলেন না। অবশেষে মায়ের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য রাতের অন্ধকারেই দূরের ঝর্ণা হতে পানি ভরে আনলেন। আনার পর দেখলেন মা তার আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন তিনি পানির গ্লাস হাতে মায়ের শিয়রে দাঁড়িয়ে রইলেন সারারাত।

ভোরে ঘুম ভেঙে মা দেখলেন, তার ছেলে পানির গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তখন মনে পড়লো ঘুমের মধ্যে তিনি একবার পানি খেতে চেয়েছিলেন। তখন তিনি বায়েজিদ বোস্তামিকে কোলে নিয়ে চুমু দিয়ে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই কোনো সাধারণ শিশু নও। খোদার কাছে দোয়া করি তুমি যেন জগৎ পূজ্য হও। এরপরের গল্প আমাদের সবারই জানা। পলের যে বিষয়ে পড়াশোনা ছিল ও চাইলেই ভালো কোন ক্যারিয়ার বেছে নিতে পারতো। দিতে পারতো দেশ পাড়ি। কিন্তু পল সেটা করেনি।

দেশেই নিজের একটা ছোটখাটো সফটওয়ার ফার্ম দিয়েছে। সেখানেও বেশ কয়েকজন ছেলেকে চাকরিও দিয়েছে। এতে করে ওর যা আয় হয় তাতেই ভালোভাবে চলে যায়। আর দেশে থাকাতে যেকোনো সময় দেশের যেকোনো প্রান্ত কুষ্টিয়া চলে যেতে পারে যখন তখন। আর কেউ না জানলেও আমি জানি এর সবচেয়ে বড় উপলক্ষ ওর মা। বিদেশ বিভুঁয়ে এসে আব্বা মা আত্মীয় স্বজনের কথা বেশি বেশি মনে পড়ে এখন।

বারবার মনে হয় যদি আমি বুয়েটে না পড়তাম। যদি আমি একটা সাধারণ ডিগ্রি নিয়ে কুষ্টিয়ার কোন স্কুল বা কলেজের শিক্ষকতা করতাম। তাহলে অন্ততঃপক্ষে পলের মতো আব্বা মায়ের কাছাকাছি তো থাকতে পারতাম। কিন্তু সেটা আর হবার নয়। সময়ের এবং দূরত্বের কারণে পলের সঙ্গে এখন যোগাযোগ স্বাভাবিকভাবেই কমে এসেছে। তবুও দেশে গেলেই ওর সাথে অন্ততঃপক্ষে একবার হলেও দেখা করি। আর দেখা হলেই সেই প্রাণস্পর্ষী ডাকটা শুনতে পাই- উরে আমার বান্দির বাচ্চা আইছে দেখ।

jagonews24
নৌবিহারে বন্ধুদের সাথে পল

বিজ্ঞাপন

সামনে আসছে বন্ধু দিবস। এর আগে অনেক বন্ধুকে নিয়েই লিখেছি। সামনে আরও অনেককে নিয়েই লিখবো। আমি বলি আমার এই জীবনটা ধারে পাওয়া। এখানে সবকিছুই বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নেওয়া। কারো কাছ থেকে বই ধার নিয়ে পড়েছি। কারো কাছে থেকে পড়াশোনা করেছি। চাকরি করতে গিয়েও ওদের কাছে ফ্রিতে থেকেছি।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

তবে পলের কাছ থেকে যে শিক্ষাটা পেয়েছি সেটা প্রত্যেক সন্তানেরই অবশ্য কর্তব্য। পল বন্ধু আমার যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস। আর তোকে যে বাবা মা জন্ম দিয়েছেন তাদের জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শুভকামনা। উনারা ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। এই দোয়া সর্বদা।

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com